শাবানের মধ্যরাত্রি উদযাপন করা যাবে কিনা?
উত্তর: শাবানের মধ্যরাত্রি পালন করার কী হুকুম এ নিয়ে আলেমদের মধ্যে তিনটি মত রয়েছে:
এক. শাবানের মধ্য রাত্রিতে মাসজিদে জামাতের সাথে সালাত ও অন্যান্য ইবাদত করা জায়েয। প্রসিদ্ধ তাবেয়ী খালেদ ইবন মিদান, লুকমান ইবন আমের সুন্দর পোশাক পরে, আতর-খুশবু, সুরমা মেখে মাসজিদে গিয়ে মানুষদের নিয়ে এ রাত্রিতে সালাত আদায় করতেন। এ মতটি ইমাম ইসহাক ইবন রাহওয়ীয়াহ থেকেও বর্ণিত হয়েছে। (লাতায়েফুল মাআরেফ পৃ:- ১৪৪)
তারা তাদের মতের পক্ষে কোনো দলীল পেশ করেন নি। আল্লামা ইবন রাজাব (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) তাদের মতের পক্ষে দলীল হিসাবে বলেনঃ তাদের কাছে এ ব্যাপারে ইসরাইলি তথা পূর্ববর্তী উম্মাতদের থেকে বিভিন্ন বর্ণনা এসেছিল, সে অনুসারে তারা আমল করেছিলেন। তবে পূর্বে বর্ণিত বিভিন্ন দুর্বল হাদীস তাদের দলীল হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকবে।
দুই. শাবানের মধ্যরাত্রিতে ব্যক্তিগতভাবে ইবাদত বন্দেগী করা জায়েয। ইমাম আওযায়ী, শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া এবং আল্লামা ইবন রজব রাহমাতুল্লাহি আলাইহিম এ মত পোষণ করেন।
যে সমস্ত হাদীস দ্বারা এ রাত্রির ফযীলত বর্ণিত হয়েছে সে সমস্ত সাধারণ হাদীসের উপর ভিত্তি করে তারা তাদের মতের পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে ইবাদত করাকে জায়েয মনে করেন।
তিন. এ ধরনের ইবাদত সম্পূর্ণরূপে বিদআত- চাই তা ব্যক্তিগতভাবে হোক বা সামষ্টিকভাবে। ইমাম আতা ইবন আবি রাবাহ, ইবন আবি মুলাইকা, মদীনার ফুকাহাগণ, ইমাম মালেকের ছাত্রগণ ও অন্যান্য আরো অনেকেই এ মত পোষণ করেছেন। এমনকি ইমাম আওযায়ী যিনি শাম তথা সিরিয়াবাসীদের ইমাম বলে প্রসিদ্ধ তিনিও এ ধরনের ঘটা করে মাসজিদে ইবাদত পালন করাকে বিদআত বলে ঘোষণা করেছেন।
তাদের মতের পক্ষে যুক্তি হলো:
১। এ রাত্রির ফযীলত সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো দলীল নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রাত্রিতে কোনো সুনির্দিষ্ট ইবাদত করেছেন বলে সহীহ হাদীসে প্রমাণিত হয়নি। অনুরূপভাবে তার কোনো সাহাবী থেকেও কিছু বর্ণিত হয়নি। তাবেয়ীনদের মধ্যে তিনজন ব্যতীত আর কারো থেকে বর্ণিত হয়নি।
আল্লামা ইবন রজব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, শাবানের রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অথবা তার সাহাবাদের থেকে কোনো সালাত পড়া প্রমাণিত হয়নি। যদিও শামদেশীয় সুনির্দিষ্ট কোনো কোনো তাবেয়ীন থেকে তা বর্ণিত হয়েছে। (লাতায়েফুল মাআরিফ : ১৪৫)
শাইখ আব্দুল আযীয ইবন বায রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, এ রাত্রির ফযীলত বর্ণনায় কিছু দুর্বল হাদীস এসেছে যার উপর ভিত্তি করা জায়েয নেই, আর এ রাত্রিতে সালাত আদায়ে বর্ণিত যাবতীয় হাদীসই বানোয়াট, আলেমগণ এ ব্যাপারে সতর্ক করে গেছেন।
২ । হাফেজ ইবন রজব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি যিনি কোনো কোনো তাবেয়ীনদের থেকে এ রাত্রির ফযীলত রয়েছে বলে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, ঐ সমস্ত তাবেয়ীনদের কাছে দলীল হলো যে তাদের কাছে এ ব্যাপারে ইসরাইলি কিছু বর্ণনা এসেছে।
তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, যারা এ রাত পালন করেছেন তাদের দলীল হলো যে তাদের কাছে ইসরাইলি বর্ণনা এসেছে, আমাদের প্রশ্ন: ইসরাইলি বর্ণনা এ উম্মাতের জন্য কিভাবে দলীল হতে পারে?
৩। যে সমস্ত তাবেয়ী থেকে এ রাত উদযাপনের সংবাদ এসেছে তাদের সমসাময়িক প্রখ্যাত ফুকাহা ও মুহাদ্দিসীনগণ তাদের এ সব কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছেন। যারা তাদের নিন্দা করেছেন তাদের মধ্যে প্রখ্যাত হলেন- ইমাম আতা ইবন আবি রাবাহ, যিনি তার যুগের সর্বশ্রেষ্ট মুফতি ছিলেন, আর যার সম্পর্কে সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছিলেন, তোমরা আমার কাছে প্রশ্নের জন্য একত্রিত হও, অথচ তোমাদের কাছে ইবন আবি রাবাহ রয়েছে।
সুতরাং যদি ঐ রাত্রি উদযাপনকারীদের পক্ষে কোনো দলীল থাকত, তাহলে তারা আতা ইবন আবি রাবাহর বিপক্ষে তা অবশ্যই পেশ করে তাদের কর্মকাণ্ডের যথার্থতা প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন, অথচ এরকম করেছেন বলে প্রমাণিত হয়নি।
৪। পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে যে, যে সমস্ত দুর্বল হাদীসে ঐ রাত্রির ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, তাতে শুধুমাত্র সে রাত্রিতে আল্লাহর অবতীর্ণ হওয়া এবং ক্ষমা করা প্রমাণিত হয়েছে, এর বাইরে কিছুই বর্ণিত হয়নি। মূলতঃ এ অবতীর্ণ হওয়া ও ক্ষমা চাওয়ার আহবান প্রতি রাতেই আল্লাহ তা‘আলা করে থাকেন। যা সুনির্দিষ্ট কোনো রাত বা রাতসমূহের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়।
এর বাইরে দুর্বল হাদীসেও অতিরিক্ত কোনো ইবাদত করার নির্দেশ নেই।
৫। আর যারা এ রাত্রিতে ব্যক্তিগতভাবে আমল করা জায়েয বলে মন্তব্য করেছেন তাদের মতের পক্ষে কোনো দলীল নেই। কেননা এ রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বা তার সাহাবা কারো থেকেই ব্যক্তিগত কিংবা সামষ্টিক কোনো ভাবেই কোনো প্রকার ইবাদত করেছেন বলে বর্ণিত হয়নি।
এর বিপরীতে শরীয়তের সাধারণ অনেক দলীল এ রাত্রিকে ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে, তন্মধ্যে রয়েছে:
আল্লাহ বলেন,
ٱليَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ ﴾ المائدة: ٣
“আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম”। (সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৩ )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ، فَهُوَ رَدٌّ
“যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটাবে যা এর মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৬৯৭)
তিনি আরো বলেছেন,
مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ
“যে ব্যক্তি এমন কোনো কাজ করবে যার উপর আমাদের দ্বীনের মধ্যে কোনো নির্দেশ নেই তা অগ্রহণযোগ্য”। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৭১৮)
শাইখ আব্দুল আজীজ ইবন বায রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আর ইমাম আওযায়ী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি যে এ রাতে ব্যক্তিগত ইবাদত করা ভাল মনে করেছেন, আর যা হাফেয ইবন রাজাব পছন্দ করেছেন, তাদের এ মত অত্যন্ত আশ্চর্যজনক বরং দুর্বল; কেননা কোনো কিছু যতক্ষণ পর্যন্ত না শরীয়তের দলীলের মাধ্যমে জায়েয বলে সাব্যস্ত হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো মুসলিমের পক্ষেই দ্বীনের মধ্যে তার অনুপ্রবেশ ঘটানো বৈধ হবে না। চাই তা ব্যক্তিগতভাবে করুক বা সামষ্টিক- দলবদ্ধভাবে। চাই গোপনে করুক বা প্রকাশ্যে। কারণ বিদআতকর্ম অস্বীকার করে এবং তা থেকে সাবধান করে যে সমস্ত প্রমাণাদি এসেছে সেগুলো সাধারণভাবে তার বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। (আত্তাহযীর মিনাল বিদআ: ১৩)
৬। শাইখ আব্দুল আযীয ইবন বায রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আরো বলেন, সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لَا تَخْتَصُّوا لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ بِقِيَامٍ مِنْ بَيْنِ اللَّيَالِي، وَلَا تَخُصُّوا يَوْمَ الْجُمُعَةِ بِصِيَامٍ مِنْ بَيْنِ الْأَيَّامِ، إِلَّا أَنْ يَكُونَ فِي صَوْمٍ يَصُومُهُ أَحَدُكُمْ
“তোমরা জুম‘আর রাত্রিকে অন্যান্য রাত থেকে ক্বিয়াম/ সালাতের জন্য সুনির্দিষ্ট করে নিও না, আর জুম‘আর দিনকেও অন্যান্য দিনের থেকে আলাদা করে সাওমের জন্য সুনির্দিষ্ট করে নিও না, তবে যদি কারো সাওমের দিনে সে দিন ঘটনাচক্রে এসে যায় সেটা ভিন্ন কথা”। (মুসলিম, হাদীস নং: ১১৪৪, ১৪৮)।
যদি কোনো রাতকে ইবাদতের জন্য সুনির্দিষ্ট করা জায়েয হতো তবে অবশ্যই জুম‘আর রাতকে ইবাদতের জন্য বিশেষভাবে সুনির্দিষ্ট করা জায়েয হতো; কেননা জুম‘আর দিনের ফযীলত সম্পর্কে হাদীসে এসেছে যে,
خَيْرُ يَوْمٍ طَلَعَتْ عَلَيْهِ الشَّمْسُ يَوْمُ الْجُمُعَةِ
“সূর্য যে দিনগুলোতে উদিত হয় তন্মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন, জুমু‘আর দিন”। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৮৪)।
সুতরাং যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমআর দিনকে বিশেষভাবে ক্বিয়াম/ সালাতের জন্য সুনির্দিষ্ট করা থেকে নিষেধ করেছেন, সেহেতু অন্যান্য রাতগুলোকে অবশ্যই ইবাদতের জন্য সুনির্দিষ্ট করে নেয়া জায়েয হবে না। তবে যদি কোনো রাত্রের ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো দলীল এসে যায় সেটা ভিন্ন কথা। আর যেহেতু লাইলাতুল ক্বাদর এবং রমযানের রাতের ক্বিয়াম/ সালাত পড়া জায়েয সেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ রাতগুলোর ব্যাপারে স্পষ্ট হাদীস এসেছে।
শাবানের মধ্যরাত্রির পরদিন কী সাওম রাখা যাবে?
উত্তরঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বহু সহীহ হাদীসে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি শাবান মাসে সবচেয়ে বেশী সাওম রাখতেন। (এর জন্য দেখুন: সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯৬৯, ১৯৭০, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৫৬, ১১৬১, মুসনাদে আহমাদ ৬/১৮৮, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ২৪৩১, সহীহ ইবন খুযাইমা, হাদীস নং ২০৭৭, সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ৬৫৭)
সে হিসাবে যদি কেউ শাবান মাসে সাওম রাখেন তবে তা হবে সুন্নাত। শাবান মাসের শেষ দিন ছাড়া বাকী যে কোনো দিন সাওম রাখা জায়েয বা সাওয়াবের কাজ। তবে সাওম রাখার সময় মনে করতে হবে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু শাবান মাসে সাওম পালন করেছিলেন তাকে অনুসরণ করে সাওম রাখা হচ্ছে।
অথবা যদি কারও আইয়ামে বিদের নফল সাওম তথা মাসের ১৩, ১৪, ১৫ এ তিনদিন সাওম রাখার নিয়ম থাকে তিনিও সাওম রাখতে পারেন। কিন্তু শুধুমাত্র শাবানের পনের তারিখ সাওম রাখা বিদআত হবে। কারণ শরীয়তে এ সাওমের কোনো ভিত্তি নেই।
আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর রাসূলের পরিপূর্ণ পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলার তাওফিক দিন। আমীন!
পরিশেষে বলতে চাই: যদি শাবানের মধ্যরাত্রিকে উদযাপন করা বা ঘটা করে পালন করা জায়েয হতো তাহলে অবশ্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে আমাদের জানাতেন। বা তিনি নিজেই তা করতেন। আর যদি এমন কিছু তিনি করে থাকতেন তাহলে সাহাবাগণ অবশ্যই তা উম্মাতের কাছে বর্ণনা করতেন। তারা নবীদের পরে জগতের শ্রেষ্ঠ মানুষ, সবচেয়ে বেশি নসীহতকারী, কোনো কিছুই তারা গোপন করেন নি। (আত তাহযীর মিনাল বিদা‘আ ১৫, ১৬)
উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে কুরআন, হাদীস ও গ্রহণযোগ্য আলেমদের বাণী থেকে আমরা জানতে পারলাম শাবানের মধ্য রাত্রিকে ঘটা করে উদযাপন করা চাই তা সালাতের মাধ্যমে হোক অথবা অন্য কোনো ইবাদতের মাধ্যমে অধিকাংশ আলেমদের মতে জঘন্যতম বিদআত। শরীয়তে যার কোনো ভিত্তি নেই। বরং তা সাহাবাদের যুগের পরে প্রথম শুরু হয়েছিল। যারা সত্যের অনুসরণ করতে চায় তাদের জন্য দ্বীনের মধ্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা করতে বলেছেন তাই যথেষ্ট।