আশূরার গুরুত্ব ইসলামে অপরিসীম। আশূরার তাৎপর্য সম্পর্কে আমাদের বিস্তারিত জানা দরকার। দ্বীনে ইসলামে কিছু পর্ব বা দিবস আছে। যেগুলো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নির্ধারণ করেছেন ইবাদত-বন্দেগী বা নেক আমল করার জন্য। এমনি একটা দিবসের নাম আশূরা। হিজরী সনের প্রথম মাস মুহাররমের দশ তারিখ। যা মুসলিম উম্মাহর দ্বারে প্রতি বছর ঘুরে ঘুরে আসে।
এ মাস আমাদের স্বরণ করিয়ে দেয়, আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হিজরত ও তার দাওয়াতী জিন্দেগী শুরু ও ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কথা। এ মাসে রয়েছে এমন একটি দিন, দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে যে দিনে নবী মুসা (আঃ). এর বিজয় হয়েছিল। পতন হয়েছিল তখনকার সবচেয়ে শক্তিশালী জালেম সম্রাট ফেরআউন ও তার সাম্রাজ্যের। সে দিনটিই হল আশূরা; মুহাররম মাসের দশ তারিখ। এ দিনটি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে খুবই প্রিয়। তাই তিনি এ দিনে রোযা পালন করলে বহুগুণ সওয়াব প্রদান করে থাকেন। যেমন হাদীসে আসছে
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللَّهِ الْمُحَرَّمُ وَأَفْضَلُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الْفَرِيْضَةِ صَلَاُة اللَّيْلِ ” رواه مسلم
“আবু হুরাইরাহ (রাঃ). থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেনঃ রমযানের পর সর্বোত্তম রোযা হল আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা । এবং ফরজ নামাযের পর সর্বোত্তম নামায হল রাতের নামায (তাহাজ্জুদের নামায)। (মুসলিম: ১১৬৩)
আশূরার বৈশিষ্ট্য
আশূরার বৈশিষ্টের মধ্যে রয়েছে এ দিনে আল্লাহ তায়ালা তার নবী মুছা (আঃ) ও তার অনুসারী ঈমানদারদের ফেরআউনের জুলুম থেকে নাজাত দিয়েছেন এবং ফেরআউনকে তার বাহিনীসহ সমুদ্রে ডুবিয়ে মেরেছেন । সাহাবী ইবনে আব্বাস (রাঃ). থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় আগমন করলেন তিনি আশূরার দিনে ইহুদীদের রোযা পালন করতে দেখলেন। যেমন হাদীসে আসছে
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رضي الله عنهما: أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَدِمَ الْمَدِينَةَ، فَوَجَدَ الْيَهُودَ صِيَامًا يَوْمَ عَاشُورَاءَ، فَقَالَ لَهُمْ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : “مَا هَذَا الْيَوْمُ الَّذِي تَصُومُونَهُ؟” فَقَالُوا: هَذَا يَوْمٌ عَظِيمٌ، أَنْجَىَ اللهُ فِيهِ مُوسَىَ وَقَوْمَهُ، وَغَرَّقَ فِرْعَوْنَ وَقَوْمَهُ، فَصَامَهُ مُوسَىَ شُكْرًا، فَنَحْنُ نَصُومُهُ. فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : “فَنَحْنُ أَحَقُّ وَأَوْلَىَ بِمُوسَىَ مِنْكُمْ”. فَصَامَهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ. رواه البخاري و مسلم
“ইবনে আব্বাস (রাঃ). থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় এসে ইহুদীদেরকে আশূরার দিনে রোযাপালন করা অবস্থায় পেলেন। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন “এটা কোন দিন যে তোমরা রোযাপালন করছ? তারা বলল এটা এমন এক মহান দিবস যেদিন আল্লাহ তায়ালা মুছা (আঃ) ও তার সম্প্রদায়কে নাজাত দিয়েছেন এবং ফেরআউনকে তার দলবলসহ ডুবিয়ে মেরেছেন। অতএব মুছা (আঃ) শুকরিয়া হিসেবে এ দিনে রোযাপালন করেছেন। এ কারণে আমরাও রোযাপালন করে থাকি। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন “তোমাদের চেয়ে আমরা মুছা (আঃ). এর অধিকতর ঘনিষ্ট ও নিকটবর্তী।” অতঃপর রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রোযাপালন করলেন ও অন্যদেরকে রোযাপালনের নির্দেশ দিলেন। বুখারী ও মুসলিম
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহুদীদের কথা বিশ্বাস করে সওম পালন করেছেন এমন নয়। সম্ভবত আল্লাহ তায়ালা অহীর মাধ্যমে ইহুদীদের এ বক্তব্যের সত্যতা জানিয়েছেন অথবা তিনি বিশ্বস্ত সূত্রে এর সত্যতা উপলদ্ধি করেছেন।
এ দিনের রোযা র ফযীলত সম্পর্কে বহু হাদীস এসেছে। যেমন
عن أبي قتادة رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أن رسول الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : سئل عن صيام يوم عاشوراء، فقال يكفر السنة الماضية. رواه مسلم والترمذي
আবু কাতাদাহ (রাঃ). থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আশূরার রোযা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হল, তিনি বললেন “ বিগত এক বছরের গুনাহকে মুছে দেয়।” মুসলিম , তিরমিজী
অন্য বর্ণনায় এসেছে আশূরার দিনের রোযাকে আল্লাহ তায়ালা বিগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন।” রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রোযা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে পালন করতেন। যেমন হাদীসে এসেছে
قال ابن عباس رضى الله عنهما : ما رأيت النبي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يتحرى صيام يوم فضله على غيره إلا هذا اليوم يوم عاشوراء وهذا الشهر يعني شهر رمضان. رواه البخاري و مسلم
ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন আমি রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে কোন রোযার উপর অন্য কোন দিনের রোযাকে এত গুরুত্ব দিতে দেখিনি কিন্তু এই দিনের রোযা। অর্থাৎ আশূরার দিনের রোযা। আর এই মাস অর্থাৎ রমজান মাস।
আশূরার রোযার ইতিবৃত্ত ও তার বিধান
ইসলামের সূচনা থেকে তার পরিপূর্ণতা লাভ পর্যন্ত আশূরার রোযার বিধান এক ধরনের ছিলনা সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এরও পরিবর্তন হয়েছে :
১. ইসলামের সূচনাতে মক্কায় থাকাকালীন অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশূরার রোযা পালন করতেন, কিন্তু অন্যকে এ রোযা পালন করতে হুকুম করেননি ।
২. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনাতে আগমন করলেন তিনি ইহুদীদের রোযা পালন করতে দেখলেন তখন তিনিও রোযা পালন করলেন অন্যদেরও রোযা পালন করতে নির্দেশ দিলেন। এমনকি যারা আশূরার দিনে আহার করেছিলেন তাদের দিনের বাকী সময়টা পানাহার থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিলেন। আর এটা ছিল হিজরতের দ্বিতীয় বছরে। কেননা তিনি হিজরতের প্রথম বছর মুহাররম মাস শেষ হওয়ার একমাস পর অর্থাৎ রবিউল আউয়াল মাসে মদীনাতে আগমন করেছিলেন।
৩. হিজরতের দ্বিতীয় বছর যখন রমযান মাসের রোযা ফরজ করা হল তখন আশূরার রোযার ফরজিয়্যত (অপরিহার্যতা) রহিত হয়ে গেল এবং তা মুস্তাহাব হিসেবে গণ্য হতে লাগল। অতএব বলা যায় এক বছরের জন্য এ রোযা পালনের ফরজ নির্দেশ জারী হয়ে ছিল (ফতহুল বারী
৪. আশূরার রোযা পালন সুন্নাত। আর তার সংখ্যা হবে দুটি। মুহাররম মাসের নবম ও দশম তারিখে অথবা দশম ও একাদশ তারিখে।
এ চারটি ইতিবৃত্ত আলোচনা করা হল তা বহু সংখ্যক হাদীস দ্বারা প্রমাণিত । যেমন
عن عائشة رضى الله عنها قالت : كانت قريش تصوم عاشوراء في الجاهلية وكان رسول الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يصومه، فلما هاجر إلى المدينة صامه وأمر بصومه، فلما فرض شهر رمضان قال : ( من شاء صامه ومن شاء تركه) رواه البخاري ومسلم
‘আয়েশা (রাঃ). থেকে বর্ণিত তিনি বলেন জাহেলী যুগে কুরাইশরা আশূরার রোযা পালন করত এবং রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও রোযা পালন করতেন। যখন তিনি মদীনায় হিজরত করলেন তখন তিনি এ রোযাপালন করলেন ও অন্যদের পালন করতে আদেশ দিলেন। যখন রমযান মাসের সওম ফরজ হল তখন তিনি আশূরার রোযা সম্পর্কে বললেনঃ “যার ইচ্ছা আশূরার রোযা পালন করবে, আর যার ইচ্ছা ছেড়ে দিবে।” বুখারী ও মুসলিম
عن جابر بن سمرة رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قال: كان رسول الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يأمرنا بصيام يوم عاشوراء، ويحثنا عليه، ويتعاهدنا عنده، فلما فرض رمضان لم يأمرنا ولم ينهنا عنه. رواه مسلم
সাহাবী জাবের ইবনে সামুরা (রাঃ). বলেন রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আশূরার দিনে রোযা পালনের জন্য আমাদের হুকুম দিতেন, উৎসাহিত করতেন, আমাদের ওয়াদা নিতেন। কিন্তু যখন রমযানের রোযা ফরজ হল তখন তিনি আমাদের আদেশও দিতেন না আর তা থেকে নিষেধও করতেন না। মুসলিম
তাই সর্ব-সম্মত কথা হল আশূরার রোযা প্রথমে ফরজ ছিল, এখন তা ফরজ নয়, সুন্নাত।
ইবনে আব্দুল বার (রহঃ) বলেন আশূরার রোযা মুস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারে উলামায়ে উম্মাতের ইজমা (ঐক্যমত) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।
ইবনে আব্বাস (রাঃ). আরো বলেন; যারা বলে যে, আশূরার রোযা তেমন গুরুত্বপূর্ণ মুস্তাহাব নয়, সাধারণ মুস্তহাব। তাদের এ কথা ঠিক নয়। আসল কথা হল এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ মুস্তহাব আমল। তাইতো আমরা দেখতে পাই আল্লাহর রসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রত্যেক আশূরাতে রোযা পালন করতেন। এমনকি ইন্তেকালের বছরও তিনি বলেছিলেন:
لئن عشت إلى قابل لأصومن التاسع والعاشر . رواه مسلم
“যদি আমি আগামি বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকি তাহলে অবশ্যই আগামী বছর মুহাররম মাসের নবম ও দশম তারিখে রোযা পালন করব।” মুসলিম
এবং এ রোযা দ্বারা এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করা হয় । এ সকল হাদীস দ্বারা আশূরার রোযার গুরুত্ব উপলদ্ধি করা যায় ।
আশূরার সওমের ব্যাপারে ইহুদীদের বিরোধিতা করার নির্দেশ
যে সকল বিষয়ে কোন শরয়ী হুকুম অবতীর্ণ হয়নি মদীনায় আসার পর সে সকল বিষয়ে নবী কারীম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইহুদীদের অনুরূপ আমল করা পছন্দ করতেন। যেমন তিনি মসজিদুল আকসাকে কিবলা হিসেবে গ্রহণ করলেন। উদ্দেশ্য ছিল ইহুদীরা যেন ইসলামকে নিজেদের ধর্মের মতই মনে করে, ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। পরে যখন সত্য ধর্ম ইসলাম গ্রহণের পরিবর্তে ইহুদীদের অবাধ্যতা, হিংসা, বিশ্বাস-ঘাতকতা, ও চরম সাম্প্রদায়িকতা প্রকাশ পেল তখন সকল ব্যাপারে তাদের বিরোধিতা করার নির্দেশ দেয়া হল এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ব্যাপারে তাদের সাথে সাদৃশ্যতাপূর্ণ সকল আমল ও আচরণ করতে নিষেধ করা হল।
তাই রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সংকল্প করলেন আশূরার দিনে তিনি ইহুদীদের মত আর একটি করে রোযা পালন করবেন না। বরং এ রোযার সাথে মুহাররম মাসের নবম তারিখে একটি রোযা বাড়িয়ে রাখার মাধ্যমে ইহুদীদের ধর্ম ও সাংস্কৃতির বিরোধিতা করবেন। যেমন হাদীস আসছে।
عن ابن عباس رضى الله عنهما أنه قال: حين صام رسول الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يوم عاشوراء وأمر بصيامه، قالوا إنه يوم تعظمه اليهود والنصارى، فقال رسول الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ( فإذا كان العام المقبل إن شاء الله صمنا اليوم التاسع) قال : فلم يأت العام المقبل حتى توفي رسول الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – رواه مسلم
ইবনে আব্বাস (রাঃ). বলেন, যখন রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আশূরার রোযা পালন করলেন ও অন্যকে পালন করার নির্দেশ দিলেন তখন সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ). বললেন “এটা তো এমন এক দিন যাকে ইহুদী ও খ্রিস্টানরা সম্মান করে থাকে।” তখন রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন; “আগামী বছর আসলে ইনশা আল্লাহ আমরা নবম তারিখেও সওম পালন করব।” ইবনে আব্বাস (রাঃ). বলেন “পরবর্তী বছর আসার পূর্বেই রাসূলে কারীম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইন্তেকাল করেন।” মুসলিম
অন্য হাদীসে এসেছে
عن ابن عباس رضى الله عنهما قال: قال رسول الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: صوموا يوم عاشوراء وخالفوا فيه اليهود، وصوموا قبله يوما أو بعده يوما. رواه أحمد
ইবনে আব্বাস (রাঃ). থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- যে, রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন “তোমরা আশূরার দিন রোযা পালন কর ও এ ক্ষেত্রে ইহুদীদের বিরোধিতা কর। তাই তোমরা আশূরার একদিন পূর্বে অথবা একদিন পরে রোযা পালন কর। আহমদ
এ হাদীসে কয়েকটি বিষয় স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ঃ
১. রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আশূরার দিনে রোযা পালন করতে বলেছেন। তাই আশূরার দিনকে বাদ দিয়ে রোযাপালন করলে তা আশূরার রোযা হবে না।
২. আশূরার রোযা পালনের ক্ষেত্রে ইহুদীদের বিরোধিতা করতে হবে। তাই ইহুদীদের মত দশম তারিখে একটি মাত্র রোযা পালন করা যাবে না।
৩. আশূরার একদিন পূর্বে রোযা পালন করতে হবে।
৪. যদি আশূরার পূর্বের দিন রোযা পালন করা কোন কারণে সম্ভব না হয় তাহলে আশূরা ও তার পরের দিন রোযা পালন করতে হবে।
বুঝা গেল আশূরার রোযা পালনের তিন পদ্ধতি
(ক) মুহাররম মাসের নবম ও দশম তারিখে রোযাপালন করা। এ পদ্ধতি অতি উত্তম। কারণ রসূলে কারীম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এভাবেই আশূরার রোযা পালনের সংকল্প করেছিলেন। যেমন ইতোপূর্বে আলোচিত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর হাদীস প্রমাণ করে।
(খ) মুহাররম মাসের দশম ও একাদশ দিবসে রোযা পালন করা। এ পদ্ধতিও হাদীস দ্বারা সমর্থিত।
(গ) শুধু মুহাররম মাসের দশম তারিখে রোযা পালন করা। এ পদ্ধতি মাকরূহ। কারণ এটা ইহুদীদের আমলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
শরীয়তের মানদণ্ডে আশূরার প্রচলিত আমলসমূহ
মুসলিম জনসাধারণের দিকে তাকালে আপনি দেখবেন যে, তারা এ আশূরাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের কাজ-কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এবং এ কাজগুলো তারা আশূরার আমল মনে করেই করে থাকে। যেমন আশূরার রাত্রি জাগরণ, বিভিন্ন প্রকার উন্নত খাবারের ব্যবস্থা, পশু জবেহ, আনন্দ-ফূর্তির প্রকাশ, আবার কারবালায় ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাতের স্মরণে মাযারের প্রতিকৃতি বানিয়ে তা নিয়ে মাতম ও তাযিয়া মিছিল বের করা, মাহফিল ও আলোচনা সভা ইত্যাদি। এগুলো বিভ্রান্ত শিয়া ও রাফেজীদের কাজ হলেও দুঃখজনক ভাবে আমাদের সাধারণ মুসলিম জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই আমাদের জেনে নিতে হবে কোনটা আশূরা সম্পর্কিত আমল আর কোনটা ভেজাল বা বিদ‘আত।
যদি আমাদের আমলগুলো শরীয়ত সম্মত হয় তা হলে তা দ্বারা আমরা আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য ও সওয়াব লাভ করতে পারব। আর যদি আমলগুলো শরীয়ত সমর্থিত না হয়, বিদ‘আত হয়, তাহলে তা পালন করার কারণে আমরা গুনাহগার হবো। অতএব তা থেকে দূরে সরে পড়ব।
আমাদের সর্বদা ভাল করে মনে রাখতে হবে যে, যে কোন আমল আল্লাহ তায়ালার কাছে কবুল হওয়ার জন্য দুটো শর্ত রয়েছে।
একটি হলঃ আমলটি একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করতে হবে।
দ্বিতীয়টি হলঃ আমলটি অবশ্যই আল্লাহর রসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নির্দেশিত পদ্ধতিতে হতে হবে।
সোজা কথায় রাসূলের তরীকায় হতে হবে। যদি আমরা আশূরার অতীত ও বর্তমানের প্রচলিত কাজ-কর্মের দিকে তাকাই তাহলে দেখব যে, এ সকল কার্যাবলী ও অনুষ্ঠানাদি দু ভাগে বিভক্ত ।
১. প্রচলিত আমলগুলো ইবাদত হিসেবে স্বীকৃত কিন্তু সেগুলো এ দিনের সাথে খাছ (সংশ্লিষ্ট) নয়। যেমন আশূরার রাতে জাগ্রত থেকে নফল সালাত আদায় করা, কবর যিয়ারত করা, দান-ছদকাহ করা, যাকাত আদায় করা, খিচুরী বা বিরিয়ানী পাক করে মানুষদের মাঝে বিলি করা ইত্যাদি। যদিও এ কাজগুলো স্বতন্ত্রভাবে বিদ‘আত নয় কিন্তু এগুলো আশূরার দিনের সাথে খাছ করা বিদ‘আত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বা তাঁর রাসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অথবা সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ). এ কাজগুলো আশূরার দিনের সাথে খাছ করেননি।
২. যে সকল কাজ ইবাদত নয়, মানুষের অভ্যাসের অন্তর্রগত। যেমন এ দিনে গোসল করা, সুরমা ব্যবহার করা, উন্নত মানের খাবার-দাবার আয়োজন করা, গরু ছাগল জবেহ করা, মেলার আয়োজন করা ইত্যাদি। এগুলো শিয়া ও রাফেজী সম্প্রদায়ের কার্যকলাপ থেকে এসেছে। তারা হুসাইন (রাঃ). এর শাহাদাত স্মরণে শোক প্রকাশ ও মাতম করে থাকে। তারা আশূরা উপলক্ষ্যে এমন কিছু আচার অনুষ্ঠান যোগ করেছে যা ইসলাম ধর্মে নেই। বরং এগুলো ইহুদী ও মুশরিকদের উৎসবের অনুকরণ। মোট কথা হল আশূরার সাথে রোযা ব্যতীত অন্য কোন আমলের সম্পর্ক নেই। আশূরার আমল শুধু একটা। তা হল রোযা পালন করা। এটাই হল রসূলে কারীম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রদর্শিত পথ ও তার আদর্শ। হাঁ অন্য দিনের তুলনায় আশূরার দিনে নিজের পরিবার পরিজনের জন্য উদারহস্তে খরচ করার ফযীলতের উপর হাদিস পাওয়া যায়। যেমন
عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ :مَنْ وَسَّعَ عَلى عِيَالِه فِي النَّفَقَةِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَسَّعَ اللّهُ عَلَيْهِ سَائِرَ سَنَتِه . قَالَ سُفْيَانُ: إِنَّا قَدْ جَرَبْنَاهُ فَوَجَدْنَاهُ كَذلِكَ. رَوَاهُ رَزِيْنٌ
‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি ‘আশূরার দিন নিজের পরিবার পরিজনের জন্য উদারহস্তে খরচ করবে আল্লাহ তা‘আলা গোটা বছর উদারহস্তে তাকে দান করবেন। সুফইয়ান সাওরী বলেন, আমরা এর পরীক্ষা করেছি এবং কথার সত্যতার প্রমাণ পেয়েছি। (রযীন)
এ হাদীসটি কিছুটা দুর্বল হলেও যেহেতু তার উপর সালফে সালেহীনদের আমল রয়েছে সেহেতু আমল করা যায়। অতএব রোযা আর পরিবার পরিজনের জন্য উদারহস্তে খরচ করা ছাড়া আশূরাকে কেন্দ্র করে যা কিছু করা হবে সবই বিদ‘আত হিসেবে গণ্য হবে। যা পরিত্যায্য।
আশূরা সম্পর্কে প্রচলিত ভুল আকীদাহ-বিশ্বাস
শিয়া সম্প্রদায়ের লোকদের যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন ‘আশূরা কি?’ তারা উত্তরে বলবে এ দিনে আমাদের মহান ইমাম হুসাইন আ. কারবালাতে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছেন। তাই এ দিনটি পবিত্র।
যদি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের কোন আলেমকে জিজ্ঞেস করেন ‘আশূরার তাৎপর্য কি?’
তখন তিনি এর সাথে এমন কিছু কথা বলবেন যার সমর্থনে কুরআন বা সহীহ হাদীসের কোন প্রমাণ নেই। তাদের বক্তব্য শুনে মনে হবে বিশ্বের সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ আশূরাতে ঘটিয়েছেন ও আগত ভবিষ্যতের সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এ আশূরাতে সংঘটিত করাবেন। পৃথিবীর সৃষ্টি ও ধ্বংস সবই নাকি এ দিনে হয়েছে ও হবে। বলা হয়ে থাকে এ দিনে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে। আদম আঃ. এর সৃষ্টি এ দিনে হয়েছে। আদম আঃ. কে এ দিনে দুনিয়াতে প্রেরণ করা হয়েছে। এ দিনে আদম ও হাওয়ার মিলন হয়েছিল আরাফাতের ময়দানে। উভয়ের তাওবা কবুল হয়েছিল এ দিনে। নূহ আঃ. এর প্লাবন এ দিনে হয়েছিল। প্লাবন শেষে নূহ আঃ. এর নৌকা এ দিনে জুদী পাহাড়ে ঠেকে গিয়েছিল। মাছের পেট থেকে ইউনূছ আঃ. এর মুক্তি লাভ এ দিনে হয়েছিল। মুছা আঃ তাওরাত লাভের জন্য তূর পাহাড়ে এ দিনে গমন করেছিলেন। এ দিনে কিয়ামত সংঘটিত হবে । আরো কত কিছু যে এ দিনে ঘটেছিল। এগুলির সত্যতার সঠিক ও বিশুদ্ধ কোন প্রমাণ পাওয়া যায়না। না আল-কুরআনে না রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর হাদীসে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে এই পবিত্র দিনে তথা আশূরাকে কেন্দ্র করে সাঠিক আমলগুলো করার তাওফীক দান করুন। আমীন