Originally posted 2013-05-19 06:33:02.
কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে যাকাত-সদকা ইত্যাদির কথা বুঝার জন্য ইনফাক ফী সাবিলিল্লাহ (আল্লাহর রাস্তায় খরচ করা) বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে আবার বলা হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় যা-ই খরচ করবে তা আল্লাহর কাছে করযে হাসান (ধার) হিসেবে মওজুদ থাকবে। এক কথায় এটা দ্বারা ঠিক আল্লাহকে ধার দেয়া হয়, আর আল্লাহ মানুষের কাছে ঋণী হন। অনেক স্থানে একথাও বলা হয়েছে যে,আল্লাহর রাস্তায় তোমরা যা কিছু দেবে তার বিনিময় দেয়ার দায়িত্ব আল্লাহর তিনি তোমাদের শুধু ততটুকু পরিমাণই ফিরিয়ে দেবেন না; তদপেক্ষা অনেক বেশি পরিমাণ দান করবেন। কুরআন মজীদের উল্লেখিত কথাগুলো বাস্তবিকভাবেই প্রণিধানযোগ্য। আকাশ ও পৃথিবীর মালিক কি কখনও মুখাপেক্ষী হতে পারে? মানুষের কাছে থেকে সেই মহান পবিত্র আল্লাহর টাকা ধার নেয়ার কি প্রয়োজন থাকতে পারে? সেই রাজাধিরাজ সীমাসংখ্যাহীন ধন ভাণ্ডারের একচ্ছত্র মালিক আল্লাহ কি মানুষের কাছে নিজের প্রয়োজন ধার চান? কখনও নয়, তা হতেই পারে না। তাঁর দানেই দুনিয়ার জীব-জন্তু বস্তুনিচয় জীবন ধারণ করছে, তাঁর দেয়া জীবিকা দ্বারাই মানুষ বাঁচে।
দুনিয়ার প্রত্যেক ধনী ও গরীবের কাছে যা কিছু আছে, তা সব তাঁরই দান। একজন অসহায় গরীব থেকে শুরু করে কোটিপতি পর্যন্ত প্রত্যেকেই তাঁর অনুগ্রহের মুখাপেক্ষী। কিন্তু তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি মানুষের কাছে ধার চাইবেন এবং নিজের জন্য মানুষের সামনে হাত প্রসারিত করবেন- তার আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। মূলত মানুষেরই কল্যাণের জন্য, মানুষের কাজে ব্যয় করার জন্যই তিনি আদেশ করেন। আর সে ব্যয়টাকেই তিনি তাঁর পথে খরচ কিংবা ধার বলে গণ্য করেন। বস্তুত এটাও তাঁর আর এক কল্যাণ কামনার বাস্তব প্রকাশ-এটাও তাঁর এক প্রকার বড় অনুগ্রহ বিশেষ। তিনি বলেন, তোমরা তোমাদেরই সমাজের অভাবগ্রস্ত গরীব এবং আর এক কল্যাণ কামনার বাস্তব প্রকাশ-এটাও তাঁর এক প্রকার বড় অনুগ্রহ বিশেষ। তিনি বলেন, তোমরা যেসব লোককে অর্থ সাহায্য কর,এর বিনিময় তারা কোথা থেকে দেবে? এর প্রতিদান আমিই দান করবো। তোমরা ইয়াতিম,বিধবা,অসহায়, বিপদগ্রস্ত এবং নিসম্বল পথিক ভাইদেরকে যা কিছু দান করবে তার হিসেব আমার নামে লিখে রেখো এর তাগাদা তাদের কাছে নয় বরং আমার কাছে কারো। আমি তা পরিশোধ করবো। তোমরা তোমাদের গরীব ভাইদের ধার দাও কিন্তু তাদের কাছ থেকে সুদ গ্রহণ করে না,এর তাগাদা করে তাদেরকে অপ্রস্তুত ও বিব্রত করো না। তারা ঋণ শোধ করতে না পারলে সে জন্য তাদেরকে সিভিল জেল পাঠিয়ো না,তাদের কাপড়-চোপড় এবং ঘরের আসবাবপত্র ক্রোক করো না, তাদের অসহায় সন্তানদেরকে ঘর থেকে বের করে আশ্রয়হীন করে দিও না। কারণ তোমাদের ঋণ আদায়ের দায়িত্ব তাদের নয়- আমার, তারা যদি মূল টাকা আদায় করে দেয়, তবে তাদের পক্ষে থেকে সুদ আমি আদায় করবো আর তারা যদি আসল টাকাও না দিতে পারে,তাহলে আসল ও সুদ সবই আমি শোধ করবো। এভাবে নিজেদের সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে মানুষের উপকারার্থে তোমরা যা খরচ করবে, তার লাভ যদিও তোমরাই পাবে;কিন্তু সেই অনুগ্রহ আমার ওপর করা হবে, আমিই তার লাভসহ পূর্ণ হিসেব করে তোমাদেরকে ফেরত দেব।
একমাত্র দয়াময়, রাজাধিরাজ আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহের যথার্থতা এখানেই মানব জাতির কাছে যা কিছু আছে, তা সব তাঁরই দান- অন্য কোথাও থেকে বা অন্য কারো কাছ থেকে তোমরা তা পাও না। তাঁরই ভাণ্ডার থেকে তোমরা নিয়ে থাক, কিন্তু যা কিছু দাও, তাকেঁ নয়-তোমাদরই আত্মীয়, এগানো, ভাই, বন্ধু ও নিজ জাতির লোকদেরকেই দিয়ে থাক। কিংবা নিজেদের সামাজিক কলাণমূলক কাজে ব্যয় কর, যার ফলও শেষ পর্যন্ত তোমরাই পেয় থাক। কিন্তু সেই মহান দাতার অসীম বদান্যতা লক্ষ্য কর, তিনি এ সকল দান সম্পর্কে বলেন যে, এটা তাঁকে ঋণ দেয়া হয়েছে, তাঁরই পথে খরচ করা হয়েছে, তাঁকে দেয়া হয়েছে-এর ফল আমিই তোমাদেরকে দেব। বস্তুত বদান্যতার এ অতুলনীয় পরাকাষ্ঠা একমাত্র আল্লাহ তাআলারই পক্ষে শোভা পায়, কোনো মানুষ এর ধারণাও করতে পারে না। ভাবার বিষয় এই যে, আল্লাহ তাআলা মানুষের মধ্যে দানশীলতা ও বদান্যতার উৎস সঞ্চার করার জন্য এ পন্থা অবলম্বন করলেন কেন? এ বিষয়ে যতই চিন্তা করা যায়, ইসলামের উন্নত শিক্ষার অন্তনির্হিত পবিত্র ভাবধারা ততই সুস্পষ্টরূপে হৃদয়ঙ্গম করা যায়; মন উদাত্ত কন্ঠে বলে উঠে –এ অতুলনীয় শিক্ষা আল্লাহ ছাড়া আর কারো হতে পারে না।
মানুষ যে স্বভাবাতই কিছুটা যালেম এবং জাহেল হয়ে জন্মগ্রহণ করে, তার সকলেরই জানা কথা। তার দৃষ্টি অত্যন্ত সংকীর্ণ। বেশী দূর পর্যন্ত তা পৌঁছায় না। তাদের দিল খুবই ক্ষুদ্র, তার মনে বড় এবং উচ্চ ধারণার খুব কমই সংকুলান হয়ে থাকে। মানুষ ভয়ানক স্বার্থপর, কিন্তু সেই স্বার্থপরতা সম্পর্কেও কোনো ব্যাপক ও বিরাট ধারণা তার মন-মস্তিষ্কে স্থান পায় না। মানুষ অবিলম্বেই সবকিছু পেতে চায়: প্রতিটি কাজের ফল এবং পরিণাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাভ করতে সে প্রয়াসী। যে ফল তার সামনে অবিলম্বে আসে এবং নিজের চোখ দ্বারা দেখতে পায়, তাই তার কাছে একমাত্র ফল ও পরিণাম। সুদূরপ্রসারী ফলাফল পর্যন্ত তার দৃষ্টি মোটেই পৌঁছায় না। উপরন্তু যে ফল খুব বড় আকারে সামনে আসে এবং যে ফলের ক্রিয়া বহুদূর পর্যন্ত পৌঁছায়, মানুষ তা অনুভব পর্যন্ত করতে পারে না। বস্তুত এটা মানুষের এক স্বাভাবিক দুর্বলতা বিশেষ। এ দুর্বলতার কারণে মানুষ নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। আর তাও আবার যেসব স্বার্থ ছোট আকারে এবং খুব দ্রুত লাভ করা যায়, তারই প্রতি তার দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে। সে বলে আমি যা উপার্জন করেছি বা আমার বাপ-দাদার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যা পেয়েছি তা একান্তভাবে আমার, অন্য কারো কোনো অংশ বা অধিকার তাতে নেই। কাজেই আমি কেবল নিজের প্রয়োজনে, নিজের ইচ্ছায় এবং নিজের আরাম আয়েশের কাজে খরচ করবো। কিংবা যেসব কাজের ফল অবিলম্বে আমার হাতে ফিরে পাব কেবল সেই কাজে নিয়োগ করবো। আমি যদি টাকা খরচ করি তবে এর বিনিময় আমার মান-সম্মান বৃদ্ধি পাওয়া কিংবা কোনো খেতাব লাভ করা একান্তই আবশ্যক। মানুষ যেন আমার সামনে মাথা নত করে, লোকের মুখে যেন আমার নামের চর্চা হয়। এসব জিনিসের কোনোটাই যদি আমি না পাই, তবে আমি টাকা খরচ করবো কেন? আমরা নিকটবর্তী কোনো গরীব-দু:খী বা ইয়াতীম মিসকিন যদি না খেয়ে মরে যায়, তবুও আমি কেন তাঁকে খাদ্য যোগাড় করে দেব? তার প্রতি তার পিতার কর্তব্য ছিল নিজের সন্তানের জন্য কিছু রেখে যাওয়া।
আমার পাড়ার কোনো বিধবার যদি দু:খে দিন কাটে তবে আমার তাতে কি আসে যায়? তার জন্য তার স্বামীর চিন্তা করা উচিত ছিল। কোনো প্রবাসী যদি সম্বলহীন হয়ে পড়ে, তবে তার সাথে আমার কি সম্পর্ক থাকতে পারে? সে পথের ব্যবস্থা না করেই ঘর থেকে বের হয়ে বড় নির্বুদ্ধিতার কাজ করেছে। অন্য কোনো ব্যক্তি যদি দূরবস্থায় পড়ে তবে তার প্রতি আমার কী করণীয় থাকতে পারে? আমার ন্যায় তাকেও আল্লাহ তাআলা হাত-পা দিয়েছেন। নিজের প্রয়োজন পরিমাণ উপার্জন করা তার নিজেরই কর্তব্য। আমি তার সাহায্য করবো কেন? আর একান্তই আমি তাকে যদি কিছু টাকা-পয়সা দেই তবে ঋণ হিসেবেই দেব এবং আসল টাকার সাথে এর সুদও নিশ্চয়ই আদায় করবো। কারণ, বিনা পরিশ্রমে তো টাকা উপার্জিত হয়নি। সেই টাকা আামার কাছে থাকলে কত কাজেই না লাগাতে পারতাম-দালান-কোঠা তৈরি করতে পারতাম, মোটর গাড়ি কিনতে পারতাম কিংবা অন্য কোনো লাভজনক কাজে খাটাতে পারতাম। সে যদি আমার টাকা দিয়ে কোনো উপকার লাভ করতে পারে, তবে আমি আমার টাকা দ্বারা কিচু না কিছু লাভ করতে পারবে না কেন? তা থেকে আমার অংশই বা আমি আদায় করবো না কেন?
এরূপ স্বার্থপর মনোবৃত্তির কারণে প্রথমত মানুষ ধনপিশাচে পরিণত হয়। সে তা খরচ করলে ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যই করবে। যে কাজে কোনো স্বার্থ দেখতে পাবে না, সেখানে এক পয়সাও খরচ করবে না। কোনো গরীবের সাহায্য যদি সে করেও, তবে মূলত তা দ্বারা সেই গরীবের কোনো সাহায্য হবে না, বরং তাকে আরো বেশী করে শোষণ করবে এবং তাকে যা দেবে তদপেক্ষা অনেক বেশী আদায় করবে। কোনো মিসকীনকে কিছু দান করলে সে এ ব্যক্তির প্রতি নিজের অনুগ্রহ দেখিয়ে তাকে কাতর করে ছাড়বে এবং তাকে এতদূর অপমানিত ও লাঞ্চিত করবে যে, তার মধ্যে আত্মসম্মানবোধটুকুও অবশিষ্ট থাকতে দেবে না। কোনো জাতীয় কাজে অংশ গ্রহণ করলে এ ধরনের মানুষ সর্বপ্রথম নিজের স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি দেবে। যেসব কাজে নিজের স্বার্থ লাভের সম্ভবনা থাকবে না, সেই কাজে একটি পয়সাও দিতে প্রস্তুত হবে না।
এধরনের মনোবৃত্তির পরিণাম কত ভয়াবহ তা ভেবে দেখেছেন কি? এর ফলে গোটা সমাজ জীবনই যে চুরমার হয়ে যাবে তাই নয়, বরং শেষ পর্যন্ত সেই ব্যক্তির অবস্থাও অত্যন্ত মারাত্মক হয়ে পড়বে, সন্দেহ নেই। কিন্তু এদের দৃষ্টি অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং তারা অতীব মূর্খ বলে এটা থেকেও তাদের নিজেদেরই উপকারিতার আশা করে থাকে। এ ধরনের হীন মনোবৃত্তি যখনই মানুষের মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে তখন সমাজের খুব অল্প সংখ্যক লোকের হাতে সমগ্র জাতীয় সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে এবং অসংখ্য লোক একেবারে নিরুপায় ও উপর্জনহীন হয়ে পড়তে বাধ্য হয়। অর্থশালী লোক অর্থের বলে আরও বেশী পরিমাণ অর্থ শোষণ করে, গরীব লোকদের জীভন ক্রমশ আরও বেশী খারাপ হয়ে যায়। যে সমাজে দারিদ্র একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক স্বাস্থ্য-ধৈর্য চূর্ণ হয়, নানা প্রকার দুরারোগ্য ব্যাধি সমাজ দেহে আক্রমণ করে, ফলে তারা কাজের ও উৎপাদনের শক্তি হারিয়ে ফেলে। তাদের মধ্যে মূর্খতা ও অশিক্ষা বৃদ্ধি পায়, নৈতিক স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। তারা নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য অপরাধ প্রবণ হতে বাধ্য হয় এবং শেষ পর্যন্ত লুটতরাজ করতেও পশ্চাৎ পদ হয় না।
সমাজে এক সর্বব্যাপী বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়, ধনী লোক গরীবদের হাতে নিহত হতে শুরু করে, তাদের ঘর-বাড়ী লুণ্ঠিত হয়, অগ্নিদগ্ধ হয় এবং তারা চিরতরে ধ্বংস হতে বাধ্য হয়।সমাজ বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে প্রত্যেকটি মানুষের ব্যক্তিগত কল্যাণ তার সামাজিক বৃহত্তর কল্যাণের সাথে ওতপ্রোত জড়িত। একজনের কাছে যে অর্থ আছে তা যদি অন্য এক ভাইয়ের সাহায্যার্থে ব্যয়িত হয় তবে এ অর্থই আবর্তিত হয়ে অভাবিতপূর্ব কল্যাণ নিয়ে পুনরায় তার হাতেই ফিরে আসবে। পক্ষান্তরে নিতান্ত সংকীর্ণ দৃষ্টির বশবর্তী হয়ে যদি সে তার নিজের কাছেই সঞ্চয় করে রাখে, কিংবা নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থজনিত কাজে ব্যয় করে, তবে ফলত সে অর্থ ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, একটি ইয়াতীম শিশুকে আপনি যদি লালন-পালন করে এবং উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে উপার্জনক্ষম করে দেন, তবে তাতে সামাজিক সম্পদ বৃদ্ধি পাবে। আপনিও তা থেকে অংশ লাভ করতে পারবেন। কারণ, আপনিও সেই সমাজেরই একজন লোক। হতে পারে সেই ইয়াতীমের বিশেষ যোগ্যতার ফলে আপনি যে অর্থ লাভ করেছেন তা কোনো হিসেবের সাহায্যে হয়ত আপনি যে অর্থ লাভ করেছেন তা কোনো হিসেবের সাহায্য হয়ত আপনি আদৌ জানতে পারেননি। কিন্তু প্রথমেই তার লালন-পালন করতে এবং তাকে শিক্ষা-দীক্ষা দিতে আপনি যদি অস্বীকার করেন এবং বলেন যে, আমি তার সাহায্য করবো কেন, তার পিতারই কিছু না কিছু ব্যবস্থা করে যাওয়া উচিত ছিল, তবে তো সে উদভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াবে, ছন্নছাড়া হয়ে নিরুদ্দেশ হাতড়িয়ে মরবে, অকর্মণ্য হয়ে যাবে এবং সামাজিক সম্পদ বৃদ্ধি করার মতো কোনো যোগ্যতাই সে লাভ করতে পারবে না। বরং সে অপরাধ প্রবণ হয়ে একদা স্বয়ং আপনার ঘরেই সিঁদ কাটতে প্রস্তত হবে। এর অর্থ এ দাঁড়ায় যেআপনি সমাজেরই এক ব্যক্তিকে অকর্মণ্য ও অপরাধ প্রবণ বানিয়ে কেবল তারই নয়-আপনার নিজরও ক্ষতি সাধন করবেন। এ একটি মাত্র উদাহরণ সামনে রেখে দৃষ্টি প্রসারিত করলে পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যাবে যে, নিস্বার্থভাবে যে ব্যক্তি সামাজিক বৃহত্তর কল্যাণের জন্য অর্থ খরচ করে, বাহ্য দৃষ্টিতে তা তার নিজ পকেট থেকে নির্গত হয় বটে; কিন্তু বাইরে এসে তাই বৃদ্ধি পেয় স্ফীত হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তাই অসংখ্য রূপ উপকার ও স্বার্থকতা নিয়ে আবার তার পকেটেই ফিরে যায়। আর যে ব্যক্তি দৃষ্টিতে তার অর্থ তার নিজের বাক্সে থেকে যায় বা সুদ খেয়ে তাকে আরও স্ফীত করে তোলে; কিন্তু প্রকতপক্ষে নিজের নির্বুদ্ধিতার দারুনই নিজের সম্পদ নষ্ট করে-নিজেরই ধ্বংসের ব্যবস্থা করে।আল্লাহ তাআলা এ তত্ত্ব কথাই বলেছেন নিন্মলিখিত আয়াতে:আল্লাহ সুদ নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং দানকে ক্রমবৃদ্ধি প্রাপ্ত করেন।মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি করবে বলে তোমরা যে সুদ দাও, মূলত আল্লাহর কাছে তাতে সম্পদ মোটই বৃদ্ধি পায় না কিন্তু তোমরা য যাকাত আদায় কর-একমাত্র আল্লাহর সন্তোষ লাভ করার উদ্দেশ্য তা অবশ্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। সূরা আর রূম : ৩৯
কিন্তু এ গভীর তত্ত্ব কথা বুঝতে এবং তদানুযায়ী কাজ করতে মানুষের দৃষ্টি সংকীর্ণতা এবং চরম মূর্খতা বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ইন্দ্রিয়ের দাস। যে টাকা তাদের পকেটে আছে তা দিয়ে তারা অনুভব করতে পারে এবং বুঝতে পারে যে, তা নিশ্চয়ই আছে। তাদের হিসেবের খাতায় যে পরিমাণ টাকা বেড়ে চলেছে তার ক্রম বৃদ্ধি সম্পর্কেও তারা নিসন্দেহ; কিন্তু যে টাকা তাদের কাছ থেকে চলে যায়; তা যে বাড়ছে এবং তাদের হাতে যে ফিরে আসতে পারে; সে কথা মোটেই বুঝতে ও দেখতে পায় না। তারা শুধু বুঝে এত টাকা আমার হাত থেকে চলে গিয়েছে এবং তা চিরকালের জন্যই গেছে।
মূর্খতার এ বন্ধনকে মানুষ নিজের বুদ্ধি বা চেষ্টার দ্বারা অদ্যাবধি খুলতে পারেনি। সারা দুনিয়ার অবস্থাই এরূপ। একদিকে পুজিঁবাদীদের দুনিয়া-সকল কাজই সেখানে সুদ প্রথার ওপর চলছে এবং ধন-সম্পদের প্রাচুর্য সত্ত্বেও সেই দেশে দু:খ দারিদ্র আর অভাব অনটন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে এদের বিরোধী আর একটি দল ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠেছে। তাদের মনে হিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। এর পুঁজিবাদীদের ধন-ভান্ডার লুটে তো নেবেই সেই সাথে মানুষের তাহযীব-দমুদ্দনের গোটা ইমারতকেও ধূলিসাৎ করে দিতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেছে।
মানুষ এ সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। এর সুষ্ঠ সমাধান করেছে মানুষের স্রষ্টা-মহীয়ান গরীয়ান আল্লাহ তাআলা। তিনি এসব মানুষের অন্যান্য যাবতীয় সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানসহ যে কিতাব নাযিল করেছেন, তার নাম কুরআন মজীদ। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে মানুষকে আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি ঈমান আনতে হবে। মানুষ যদি আল্লাহর এবং পরকালের প্রতি ঈমান আনতে হবে। মানুষ যদি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে এবং সন্দেহাতীতরূপে জেনে নেয় যে, আকাশ ও পৃথিবীর সমগ্র ধন-ভান্ডারের প্রকৃত মালিক হচ্ছেন আল্লাহ তাআলা : আর মানুষের সকল কাজের ব্যবস্থাপনা একান্তভাবে আল্লাহর ওপর নির্ভর করে, তার কাছে প্রত্যেকটি অণু-পরমাণুর হিসেব বর্তমান আছে; মানুষের ভালো বা মন্দ কাজের পুরুস্কার বা শাস্তি আখেরাতে ঠিক তদনুযায়ী হবে। তাহলে নিজের স্থুলদৃষ্টির ওপর নির্ভর না করে আল্লাহর ওপর ভরসা করে নিজের ধন-সম্পদ আল্লাহর বিধান অনুসারে ব্যয়-ব্যবহার করা এবং লাভ-ক্ষতি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেয়া মানুষের পক্ষে খুবই সহজ হয়ে পড়ে। এরূপ ঈমান নিয়ে সে যা কিচু খরচ করবে তা একান্তভাবে আল্লাহর জন্যই খরচ করা হবে। তার হিসেবেও আল্লাহর দফতরে যথাযথভাবে লিখিত হবে। তার এ খরচের খবর দুনিয়ার কোনো মানুষ জানতে না পারলেও আল্লাহ তাআলা সেই সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবহিত থাকেন। আর দুনিয়ার মানুষ তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করলেও আল্লাহ নিজেই যখন তার প্রতিদান দেয়ার ওয়াদা করেছেন তখন পরকালেই হোক কিংবা ইহকাল ও পরকাল উভয় স্থানেই হোক-সেই ওয়াদা যে পূর্ণ হবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।- সমাপ্ত