শাসক চাই আবু বকরের মত – ১

মুসলমান শাসক

মুসলমান শাসক

১.  পরকালের ভয় যার অন্তরে

হযরত আববু বকর (রা:) এর এক গোলাম ছিল। সে প্রতি দিন কিছু উপার্জন করতো। আর সেই অর্থ প্রদান করতো আবু বকরকে। গোমটির মুক্ত হওয়ার জন্য এটি একটি শর্ত ছিল।প্রতি দিনের মতো গোলামটি আজও কাজে বেরিয়েছে। আজ আর কোন কাজ পায়না সে। ঘুরতে ঘুরতে সে এক গোত্রের কাছে এসে পৌঁছলো এবং জানতে পারলো সেই গোত্রে আজ বিয়ের অনুষ্ঠান। বিশাল আয়োজন। মেহমানদের জন্যে প্রচুর খাবার রান্না করা হয়েছে। এ যেন এক এলাহী কাণ্ড। গোলামের মনটা খারাপই হয়ে গেল। নাহ্। আজ আর কোন কাজ পাওয়া যাবেনা। এই ভেবে সে মালিকের কাছে ফিরে যেতে শুরু করেছে। এমন সময় তার এক পরিচিত লোকের সাথে দেখা। শুধু পরিচিতই নয়। জাহেলীযুগে সে একটি উপকারর করেছিল তাকে। এই লোকটি তখন অসুস্থ্য ছিল। ওই গোলাম তাকে সে দিন মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিয়ে সারিয়ে তুলেছিল। সেই তখনই এই লোকটির পক্ষ থেকে গোলামকে কিছু পারিশ্রমিক দেয়ার কথা ছিল। যখন ঐ লোকটির সাথে গোলামের দেখা হলো, তখন তো আর তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়া যায়না। লোকটি বলল-
তোমার তো আমার আমার কাছে কিছু পাওনা আছে। আজ যখন এসেছ তখন কিছু খাবার নিয়ে যাও। গোলামটি না করলো না, বরং খুশী হলো। বেশ কিছু খাবার নিয়ে গোলাম আবু বকরের বাড়ি ফিরল। এসে ঐ খাবার গুলো রাখল আবু বকরের সামনে। হযরত আবু বকর ক্ষুধার্ত ছিলেন। খাবারগুলো পেয়েই তিনি খাওয়া শুরু করলেন।
গোলাম কিছুটা অবাক হলো ব্যাপার কি? প্রতি দিন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমি কি ভাবে অর্থ উপার্জন করেছি। অথচ আজ যে খাবার নিয়ে আসলাম তাতো জিজ্ঞাস করলেন না। কোত্থেকে খাবার আনলাম। আর কে-ই বা দিয়েছে। কেন বা দিয়েছে? আবু বকর খাবারের লোকমা মুখে ভরে দিয়েছে। এমন সময় গোলাম তার জেগে উঠা প্রশ্নটি করে বসলো। আবু বকর বললেন-
খুব ক্ষিধে পেয়েছিল। তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করার কথা মনেই ছিলনা। এবার বলো কিভাবে এ খাবার পেয়েছ। গোলাম তার মন্ত্র পড়ে ফুঁক দেবার কাহিনী বললো। আর মন্ত্র পড়ে ফুঁক দেবার কারণেই যে এ খাবার পেয়েছে, তাও জানালো। তা জেনে আবু বকরের চোখ লাল হয়ে উঠলো।
কি? মন্ত্র পড়ে উপার্জন করা খাবার এনেছ? তুমি দেখি আমাকে ধ্বংস করার যোগাড় করেছ। এ বথা বলেই গলায় হাত ঢুকিয়ে দিলেন। উদ্দেশ্য বমি করা। কিন্তু গিলে ফেলা খাবার কিছুতেই বের করা সম্ভব হলো না। তিনি বার বার বমি করার চেষ্টা করতে থাকলেন। পাশেই লোকজন ছিল। আবু বকরের অবস্থা দেখে একজন এগিয়ে এলা। বলল পানির মাধ্যমে বমি হতে পারে। আবু বকর (রা:) পানির পাত্র চেয়ে নিলেন এবং তা থেকে পান করলেন। তার পর  আবারও বমির চেষ্টা করেন। এক সময় বমি করে ফেলেন। অবশেষে গিলে ফেলা খাবারগুলোও বেরিয়ে আসে বমির সাথে। একজন লোক তখন বললেন-
আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন। আপনি এক লোকমা খাদ্য বের করার জন্যে কত কষ্ট করলেন।  আবু বকর উত্তরে বললেন-
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাই হি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছিÑ “হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত দেহের অংশ জাহান্নামের আগুনে জালানো হবে”  আমার ভয় হয় এই খাবার দ্বারা আমার শরীরের কোন অংশ তৈরী হয়ে না যায়। এই ছিল একজন আল্লাহভীরু শাসকের পরকালের ভয়। প্রকৃত পক্ষে মুত্তাকী ছিলেন তারাই।

২. গোপনের কাজ করেন- আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ যার একমাত্র উদ্দেশ্য

হযরত আবু বকরের খেলাফত কাল। মদীনায় বসবাস করতো এক অন্ধ মহিলা। মহিলার ত্রিকুলে কেউ নাই। তার উপর সে বৃদ্ধা। তাই তার চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়ায় খুব কষ্ট হতো। ইসলামী শাসনে এ রকম একজন মহিলা মানবেতর জীবন-যাপন করবে, তা হয়না। তাই হযরত ওমর এই মহিলার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নিলেন।
হযরত ওমর প্রতিদিন যথা সময়ে মহিলাকে খাবার পৌঁছানোসহ যাবতীয় কাজ করতেন। এভাবে কিছু দিন গেল। একদিন হযরত ওমর খাবার নিয়ে এলেন। এসেই বললেন-
বুড়ি মা! আপনার জন্যে খাবার নিয়ে এসেছি।
কে! কে আবার খাবার নিয়ে এসেছো? আমি তো একটু আগেই খাবার খেলাম।
 হযরত ওমর ভাবনাই পড়লেন। ব্যাপার কি? আমিইতো প্রতি দিন তাকে খাবার দিই। এখন শুনছি অন্য কেউ খাবার খাইয়ে গেছে। হযরত ওমর কিছুই বুঝতে পারলেন না। শুধু এ টুকুই বুঝলেন যে, অন্য কেউ এসে এই মহিলাকে খাবার খাইয়ে যায়।
 হযরত ওমর কিছু না বলে চলে গলেন। পরদিন ওমর যথা সময়ে এলেন। সে দিনও কে যেন বুড়িয়ে খাইয়ে গেল। সেদিনও ওমর চলে গেলেন। এর পরদিন হযরত ওমর আবারও বুড়ির কাজ করতে এলেন। বুড়িকে বললেন-
আমি কাজ করতে এসেছি।
বুড়ি বলল-
আমার কাজ তো কে যেন একটু আগেই করে দিয়ে গেল। এবার হযরত ওমর ঠিক করলেন। কে এই লোক। যে প্রতিদিন আমার আগে এসে কাজ করে দিয়ে যায়। তাকে আমার বের করতেই হবে। যেই ভাবা, সেই কাজ।
হযরত ওমর একতদিন গোপনে লুকিয়ে থাকলেন। দেখলেন ইসলামী প্রজাতন্তের মহান শাসক আবু বকর (রা:) এসে আজ বুড়ির কাজ করে দিয়ে যাচ্ছে। খেলাফতের কঠিন দায়িত্বও তাকে এই বুড়ির কাজ করা থেকে ফেরাতে পারে নি। হযরত ওমর ফারুক (রা:) তাঁকে দেখা মাত্রই চিৎকার করে উঠলেন-
নিশ্চয় আপনি। আল্লাহর শপথ। আপনি ছাড়া এই কাজ কেউ করতে পারে না। প্রতিদিন আপনি আমাকে এই সাওয়াবের কাজে হারিয়ে দেন।

৩. দুধ দোহাবেন খলীফা

মদীনার একটি এলাকার নাম ‘সাখ’। এখানেই বাস করেন হযরত আবু বকর (রা:)। এই সাখ পল্লীর মানুষদেরকে তিনি বিভিন্নভাবে উপকার করতেন। তাদের বিভিন্ন কাজ করে দিতেন। যেমন, টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করা। কাপড়-চোপড় দেয়া। ঘর দোর বানিয়ে দেয়া। এমনকি বকরীর দুধ দোহন করে পর্যন্ত দিতেন তিনি। এই সাখ পল্লীর একটি ছোট্ট মেয়ে। তার কেউ নেই। তার অনেকগুলো বকরী। সে এগুলোকে মাঠে নিয়ে ঘাস খাওয়ায়। লালন-পালন করে। কিন্তু এত টুকুন ছোট্ট মেয়ে। সে তো আর এতগুলো বকরীর দুধ দোহন করতে পারে না। সেই পল্লীর সবার প্রিয় মানুষ আবু বকর। তিনিই এই ছোট্ট মেয়েটির বকরীর দুধ দোহন করে দেন। মাখন তৈরী করে দেন। একদিন আবু বকর খলীফা হলেন। হলেন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম শাসক। সাখ পল্লীল লোকেরা যেদিন জানলো আবু বকর ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন কর্তা হয়েছেন। সে দিন তারা খুব খুশী হয়েছিল। আনন্দ-ফুর্তি করেছিল। শুধু ঐ ছোট্ট মেয়েটি খুশী হতে পারেনি। সে লোকদের সাথে আনন্দেও শামিল হয়নি। সে দরজা বন্ধ করে ঘরে বসেছিল। অভিমানে কারো সাথে কথাও বলেনি। তবে খুব কেঁদেছিল।
লোকদের আনন্দের সময় আবু বকরের মেয়েটির কথা মনে হলো। তিনি ছুটে গেলেন মেয়েটির বাড়ি। বাড়িতে গিয়েই আবু বকর অবাক হলেন। মেয়েটি কাঁদছে। কিন্তু কেন কাঁদছে? তিনি মেয়েটিকে আদর করে জিজ্ঞেস করলেন-
কাঁদছো কেন মা?
মেয়েটি অভিমানে কথা বলে না। আবু বকর আবার জিজ্ঞেস করেন-
কি হয়েছে মা। বলনা শুনি। এবার মেয়েটি কথা বললো অভিমানের সুরে।
আপনাকে খলীফা হতে কে বলেছে?
কি করব বলো। লোকেরা আমাকে জোর করে খলীফা বানিয়ে দিয়েছে।
বলুন  তো এখন আমার বকরীর দুধ দোহন করে দেবে কে? মাখন বানিয়ে দেবে কে? আপনি তো এখন খলীফা। খলীফা কি আমার বকরীর দুধ দোহন করবে? মাখন বানিয়ে দেবে?
এবার আবু বকর হেসে ফেললেন। বললেন-
এই জন্যেই তুমি এত রাগ করে আছো? ভেবো না। আগে যেমন তোমার বকরীর দুধ দোহন করে দিতাম। মাখন বানিয়ে দিতাম। এখনো তাই দেব। খলীফ হয়েছি তো কি হয়েছে। খলীফা তো মানুষই। আমি আগে যা দিলাম এখনও তাই আছি। এবার বকরীগুলো নিয়ে মাঠে যাও।
মেয়েটি আবু বকরের কথা মন দিয়ে শুনছিল। এতক্ষণে মেয়েটির মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বকরীগুলো নিয়ে মেয়েটি মাঠে চলে গেল।

৪. চিনি ফিরিয়ে দিলেন তিনি

হযরত আবু বকর এর বাড়িতে খুব করাকড়ি। সবকিছু ঠিকঠাক মত হওয়া চাই। কোনকিছুতে বারাবাড়ি চলবে না। তার পরিবারের জন্য যা বরাদ্ধ তা দিয়েই সংসার চালাতে হবে। ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকরের এই নির্দেশ। প্রতি মাসে বায়তুল মাল থেকে আসে আটা, ময়দা, খেজুর, মধু, চিনি। আরো আসে কাপড়-চোপড়। শুধুমাত্র যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই পান তিনি। এই দিয়েই সংসার চালান হযরত আবু বকরের স্ত্রী হাবীবা। মাপা মাপা জিনিস দিয়ে কি আর ইচ্ছে মতো খাওয়া-দাওয়া করা যায়? সংসারে ছেলে-মেয়েরা আছে। তাদের কত কি খেতে মন চাই। কিন্তু রাষ্ট্র প্রধানের স্ত্রী হয়েও হাবীবা তাদের তা দিতে পারেন না।
একবার ছেলে-মেয়েরা মিষ্টি খেতে চাইল। তাদের জোর আবদার হালুয়া খাওয়াতে হবে। হালুয়া তাদের চাই-ই। কিন্তু আবু বকরের স্ত্রী তাদের হালুয়া দিবেন কোত্থেকে? হালুয়া বানাতে ময়দা লাগে, চিনি লাগে, ঘি লাগে। এসব তিনি পাবেন কোথায়? একবার ছেলে-মেয়েদের আবদারের কথা খলীফা আবু বকরের নিকট বললেন হাবীবা। খলীফা বললেন-
চিনি পাবো কোথায়?
কেন? কিনে আনবেন। স্ত্রী হাবীবা বললেন-
স্ত্রীর কথা শুনে চিন্তিতভাবে বললেন আবু বকর-
চিনি কিনতে টাকা লাগবে না?
বায়তুল মাল থেকে টাকা চেয়ে নিন।
না না। বায়তুল মাল থেকে টাকা চাইতে পারবো না।
তাহলে আপনি বলে দিন কিছু চিনি দিয়ে যাক। বেশি লাগবে না। আপনি বললেই ওরা দিয়ে যাবে।
না, আমার জন্য যা বরাদ্ধ আছে তার বাইরে আমি চিনি আনতে পারবোনা।
খলীফা আবু বকরের দৃঢ়তা দেখে স্ত্রী হাবীবা এ নিয়ে আর কথা বললেন না। কিন্তু তিনি তো মা। ছেলে-মেয়েদের মুখের দিকে চেয়ে তিনি বসে থাকতে পারলেন না। বরাদ্ধকৃত চিনি থেকে তিনি প্রতিদিন অল্প অল্প করে চিনি বাঁচাতে লাগলেন। একদিন দেখা গেল তার কাছে হালুয়া বানাবার মতো চিনি জমা হয়েছে। তিনি খলীফাকে বললেন-
এবার কিছু ময়দা এনে দিন।
ময়দা দিয়ে কি হবে?
হালুয়া তৈরী করবো।
হালুয়া তৈরী করবে? চিনি পেলে কোথায়?
আমাদের প্রতি দিনের খরচ থেকে অল্প অল্প করে বাঁচিয়ে জমিয়েছি।
দেখি কি পরিমাণ জমিয়েছ?
হাবীবা হযরত আবু বকরকে তা দেখালেন। খলীফা তা দেখে ভাবনাই পড়ে গেলেন। খরচ না করে যে চিনি জমানো হয়েছে, তা না হলেও তো আমাদের সংসার চলে যায়। কোন অসবিধা হয়না। এত দিন হাবীবা যা জমিয়েছে তা আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত।
ভাবনা শেষ করে হযরত আবু বকর বায়তুল মালের লোকদের খবর দিলেন। বায়তুল মালের লোক তার কাছে এলে হযরত আবু বকর জমানো সব চিনি তুলে দিলেন। আর বলে দিলেন যে পরিমাণ চিনি তুমি ফেরত নিয়ে যাচ্ছো, এই পরিমাণ চিনি যেন আমার বরাদ্ধ থেকে কমিয়ে দেয়া হয়। এই পরিমাণ চিনি না হলেও আমার সংসার চলে। এটা অন্যদের  জন্যে বরাদ্ধ করে দাও।

Related Post