Main Menu
أكاديمية سبيلي Sabeeli Academy

দ্বীনের প্রচার ও প্রসার

Originally posted 2014-02-20 12:48:21.

imagesCAU7Z6QUদ্বীন অর্থাৎ আল্লাহর কুরআন ও রাসূল সা:-এর সুন্নাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করা। এই দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে প্রথমে ঈমানের স্বাদ পেতে হবে। হজরত আনাস রা: কর্তৃক বর্ণিত; তিনি বলেন, নবী করিম সা: বলেছেন  তিনটি বৈশিষ্ট্য যার মধ্যে আছে সেই ঈমানের স্বাদ উপভোগ করেছে। ১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই সব কিছুর চেয়ে তার কাছে অধিক প্রিয়, ২. যেকোনো ব্যক্তিকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই ভালোবাসে, ৩. আল্লাহ তাকে কুফরি থেকে মুক্তিদানের পর পুনরায় সে কুফরির দিকে ফিরে যাওয়ার চেয়ে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকেই ভালো মনে করে। (সহিহ মুসলিম শরিফ এবং মেশকাত শরিফ, প্রথম খণ্ড)। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার অর্থ হচ্ছে, এ কথার স্বীকৃতি প্রদান করে যে, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই, আর মুহাম্মদ সা: আল্লাহর রাসূল।’ দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য ঈমানের ওপর দৃঢ় থেকে মানুষকে আহ্বান জানানো এবং ক্রমান্বয়ে আগ্রহী করে তোলা।

হজরত ইবনে আব্বাস রা: কর্তৃক বর্ণিত; হজরত মুয়াজ ইবন জাবাল রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: যখন আমাকে ইয়েমেন পাঠান, তখন বলেন  তুমি এমন এক গোত্রের কাছে যাচ্ছো, যারা আহলে কিতাব। সুতরাং তাদেরকে আহ্বান জানাবে এ কথার স্বীকৃতি প্রদান করার জন্য : ‘আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই, আর আমি আল্লাহর রাসূল।’ তারা তোমার এ কথা মেনে নিলে তাদেরকে জানিয়ে দেবে, প্রত্যহ দিনে-রাতে আল্লাহ তাদের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন। তারা তোমার এ কথাও মেনে নিলে তাদেরকে জানিয়ে দেবে, আল্লাহ তাদের ওপর জাকাত ফরজ করেছেন  যা তাদের ধনীদের থেকে সংগ্রহ করা হবে এবং দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হবে। তারা এ কথাও মেনে নিলে তাদের ভালো সম্পদগুলো গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে। আর মজলুমের অভিশাপকে ভয় করবে; কেননা তার ও আল্লাহর মাঝে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। (সহিহ মুসলিম শরিফ)।

এখানে জানা গেল, রাসূলুল্লাহ সা: বিভিন্ন দেশে ও গোত্রের কাছে প্রতিনিধি পাঠিয়ে দ্বীনের প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা করেছেন এবং মানুষকে দ্বীনের পথে আহ্বান জানিয়েছেন। ইসলাম কোনো অঞ্চল বা গোষ্ঠীবিশেষের জন্য নির্ধারিত ধর্ম নয়, এটা সমগ্র বিশ্বের সর্বযুগের সব মানুষের ধর্ম। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা: পবিত্র কুরআনে পাকের নির্ধারিত পথে জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনে যুদ্ধ করেছেন আবার মানুষকে ভালোবেসেছেন। কাফেরদের জুলুম-অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে তিনি রক্তাক্ত হয়েছেন, কিন্তু বদদোয়া করেননি। দ্বীনের কাজে তায়েফের ঘটনা তার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন। তিনি ধৈর্যশীল ছিলেন এবং যথেষ্ট কষ্ট স্বীকার করে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করেছেন। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে মানুষের কাছে তাওহিদের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন আর আল্লাহর সাহায্য কামনা করেছেন।

আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে (দ্বীন) দৃঢ়ভাবে ধারণ করো। এমনিভাবে যে, তোমরা পরস্পর একতাবদ্ধ থাকো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সূরা আলে ইমরান  ১০২)।

আজ সারা বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে বিধর্মীরা বিভেদ সৃষ্টি করে রেখেছে। ফলে আমরা একতাবদ্ধ থাকার বদলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। আমাদের প্রিয় নবী সা: নেই; কিন্তু তার আদর্শ রয়ে গেছে। নবীজীর বিদায় হজের বাণীও আমরা ভুলে গেছি। তিনি বিদায় হজে উপস্থিত মুসলমানদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন, তোমরা যারা উপস্থিত আছো তারা আমার বাণী যারা উপস্থিত নেই তাদের কাছে পৌঁছে দিয়ো। আকাশের দিকে মুখ তুলে তিনি বলেন  হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাকো। সবাই স্বীকারোক্তি দিয়েছে। মূলত এই ছিল দ্বীন প্রচার ও প্রসারে হুজুর সা:-এর শেষ বক্তব্য।

বস্তুত দ্বীনের প্রচার হুজুরে পাক সা:-এর জমানা থেকে অদ্যাবধি চালু রয়েছে। এর প্রসার ও প্রচার ব্যাপক। কিন্তু আমলের অভাব বিদ্যমান। পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে এর প্রভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। যেমন  কোনো পরিবারে মাত্র একজন ব্যক্তি দ্বীনের আমল করে; কিন্তু অন্য সদস্যরা আমল তো দূরের কথা সঠিকভাবে নামাজ কায়েম করে না। সমাজের মধ্যে দেখা যায় শুধু শুক্রবারে কেউ কেউ মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করে, কিন্তু সপ্তাহের অন্যান্য দিন নামাজ আদায়ই করে না। এ ছাড়া পরিবারে শুধু বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা নামাজের পাবন্দি করেন, কিন্তু অন্যরা নামাজ বাদ দিয়ে ব্যক্তিগত কর্মে ব্যস্ত থাকে। বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে অলসতা বেশি লক্ষণীয়। তদ্রƒপ ব্যবসায়-বাণিজ্যে ব্যস্ততা, রাজনৈতিক ব্যস্ততা ইত্যাদিতে আমরা এখন বেশি বেশি লিপ্ত, অথচ নামাজ বেহেশতের চাবি। নামাজ সঠিকভাবে কায়েম না করলে মুসলমান যেই হোক, কিভাবে বেহেশত আশা করে?

আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা ইসলামে পূর্ণরূপে দাখিল হও।’ (সূরা বাকারা  ২০৮)।বর্তমানে মানবজাতির মধ্যে হিংসাবিদ্বেষ, হানাহানি, খুনোখুনি, যুদ্ধবিগ্রহ, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন, ধর্ষণ, গুম প্রচণ্ড আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মুসলিম কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পরিবর্তে বিজাতীয় বিধর্মীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতি মুসলমানদের মধ্যে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আমাদের ঈমানের দুর্বলতায় আমরা অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি না। অন্তর দিয়ে একটু ঘৃণা করি মাত্র। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে একদল এই রূপ থাকা আবশ্যক, যেন তারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করে এবং নেক কাজের আদেশ করতে ও মন্দ কাজ থেকে বারণ করতে থাকে।’ (সূরা আলে ইমরান  ১০৪)।

কিন্তু শুধু দোজখ থেকে রক্ষা এবং বেহেশত পাওয়ার আশায় দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে মানুষকে আহ্বান করে আল্লাহর রজ্জুকে আমরা দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে পারিনি। আমরা মেহনত করি, কিন্তু নবীজী সা:-এর আদর্শ নিয়ে মেহনত করি না। আমরা ফাজায়েলে আমলে বর্ণিত হাদিস পদ্ধতিগতভাবে শুধু পড়ি আর শুনি বাস্তবে যার কোনো প্রতিষ্ঠা নেই। কুরআন গবেষণা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার কাজ মুসলমানদের মধ্যে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, এটা শুভ লক্ষণ। রাসূল সা:-এর অবর্তমানে সমস্যাসঙ্কুল পৃথিবীতে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের সঠিক নেতৃত্ব খুঁজে নিতে হবে। প্রিয় নবী সা: একাধারে ছিলেন ধর্ম প্রচারক, আবার তিনি আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক, ন্যায়বিচারক ও সমাজ সংস্কারক। কিন্তু আমরা তার আদর্শ থেকে দূরে সরে গেছি। যার ফলে আমাদের কর্মজীবনে দ্বীন প্রতিষ্ঠার সফলতা নেই।

উল্লেখ করা যায়, দ্বীনের প্রচার ভারতীয় উপমহাদেশে অতি প্রাচীনকাল থেকে প্রসার লাভ করে। তৎকালীন আরবের বাদশাহ হাজ্জাজ বিন ইউসুফের জামাতা মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুর রাজা দাহিরকে পরাজিত করে দেবল বন্দর দখল করেন এবং ইসলামের প্রচার শুরু করেন। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি কর্তৃক রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে ইসলামের প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি করেন। এ ছাড়া সুলতান ইলতুৎমিসের সেনাপতি মুহাম্মদ ঘোরী কর্তৃক রাজা পৃথ্বিরাজকে পরাজিত করে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের জয়যাত্রার সূত্রপাত ঘটান। ইসলামে আরো যারা সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে দ্বীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখে গেছেন তাদের মধ্যে হজরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতি রহ:, হজরত নিজামউদ্দিন আওলিয়া রহ:, হজরত শাহ জালাল রহ:, হজরত শাহ মখদুম রহ:, হজরত বায়েজিদ বোস্তামি রহ:, হজরত খানজাহান আলী রহ: প্রমুখ। তাদের মেহনত ও অকান্ত প্রচেষ্টায় বিধর্মীরা দলে দলে ইসলামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। সুতরাং ভারত বিভক্তির আগ থেকে এ উপমহাদেশে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য দাওয়াতি কাজ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে কর্মজীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা পায়নি। তার একমাত্র কারণ, আমরা আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে পারিনি। ঈমানের দুর্বলতা আমাদের পেয়ে বসেছে। ফলে আমরা গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করি। বাংলাদেশে প্রতি বছর তুরাগ নদীর তীরে ঢাকার অদূরে টঙ্গীতে তাবলিগ জমায়াতের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের লাখ লাখ মুসলমান এই জমায়েতে অংশ গ্রহণ করেন। তিন দিনব্যাপী ইজতেমায় ওলামায়ে কেরামদের (নির্ধারিত) বয়ান হয়। আখেরি মুনাজাতে আরো বেশি মুসলমানের সমাগম হয়। দ্বীন প্রচার হয় বটে, কিন্তু দ্বীন প্রতিষ্ঠার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। এই জমায়েতে অংশগ্রহণকারী মুসল্লিরা দলে দলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন।

কিন্তু আল্লাহর আইন বাস্তবায়নে এসব মুসল্লির কোনো অবদান লক্ষ করা যায় না। যেমনটা নবী করিম সা:-এর সাহাবাগণ খোলাফায়ে রাশেদিন, তাবেইন, তাবে তাবেইন, আম্বিয়ায়ে কেরাম, আলেম-ওলামাগণ করে গেছেন। যার ফলে দ্বীনের প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও শুধু রাষ্ট্রনায়কদের চিন্তা-চেতনায় ইসলামের আদর্শ না থাকায় দ্বীন প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না। শুধু দুনিয়াবি কাজকর্মের লভ্যাংশ নিয়ে তারা ব্যস্ত। কিন্তু আখেরাতের শস্যক্ষেত্র দুনিয়া। এখানে যেমন ফসল উৎপন্ন করা হবে, আখেরাতে তার ফল পাওয়া যাবে। অতএব আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, একজন মুসলমানকে সেভাবে প্রচেষ্টা চালানো উচিত। নতুবা মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের ক্ষমা করবেন না।

Related Post