হিজরতের পূর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াতি কার্যক্রম

হিজরতে পূর্বে আরবদেশের অবস্থা খুবই করুণ ছিলো।

হিজরতে পূর্বে আরবদেশের অবস্থা খুবই করুণ ছিলো।

প্রথম অধ্যায়:

হিজরতের পূর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াতি কার্যক্রম

প্রথম অধ্যায়কে কয়েকটি পরিচ্ছেদে ভাগ করা হয়েছে।

প্রথম পরিচ্ছেদ:

গোপনে দাওয়াত দেওয়ার সময়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দাওয়াতি কার্যক্রম:

 এ কথা অজানা নয় যে, মক্কা ছিল, আরবদের ধর্ম পালনের প্রাণ কেন্দ্র ও উপযোগী ভূমি। এখানে ছিল আল্লাহর পবিত্র ঘর কাবার অবস্থান। আরবের সমগ্র মূর্তিপূজক ও পৌত্তলিকদের আবাসভূমি ও যাবতীয় কর্মের ঘাটিও ছিল, এ মক্কা নগরী। এ কথা আমাদের সবারই মনে রাখতে হবে, পাহাড় আর মরুভূমিতে ঘেরা পবিত্র এ মক্কা নগরীতে আল্লাহর দিকে মানুষকে দাওয়াত দেয়ার মিশনটিকে তার মনজিলে মকসুদে পৌঁছানো, ততটা সহজ ছিল না। বরং বলতে গেলে এটা ছিল অনেকটাই দুর্বোধ্য ও দু:সাধ্য। একজন সাধারণ মানবের দ্বারা এ অসাধ্য কাজকে সাধ্য করা এবং সফলতায় পৌঁছানো কোন ক্রমেই সম্ভব ছিল না। যদি দাওয়াতের জন্য নির্বাচিত ভূমি মক্কা না হয়ে অন্য কোন ভূমি হত, বা তা মক্কা থেকে অনেক দূরে হত, তাহলে এতটা কষ্টকর হয়তো হত না। এ কারণেই বলা বাহুল্য, এ অনুপযোগী ও অনুর্বর ভূমিতে দাওয়াতি কাজ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন ছিল, এমন একজন মহা মানবের, যার দৃঢ়ত, আত্মপ্রত্যয় ও অবিচলতা হবে বিশ্বসেরা; যাতে কোন ধরনের বিপদ-আপদ ও মুসিবত তাকে ও তার দাওয়াতের মিশনটিকে কোন-রকম দুর্বল করতে না পারে। আরও প্রয়োজন ছিল, এমন সব হিকমত ও কৌশল অবলম্বন করা, যেসব বুদ্ধিমত্তা, হিকমত ও কৌশল দিয়ে, সে তার বিরুদ্ধে গৃহীত যাবতীয় ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে পারে এবং সব ধরনের বাধা বিঘ্ন দূর করে দাওয়াতের মিশনটিকে সফলতার ধার প্রান্তে পৌছাতে পারে। নি:সন্দেহে বলা যায়, অনুগ্রহ ও দয়া মহান আল্লাহরই যিনি হলেন, আহাকামুল হাকেমীন; তিনি যাকে চান হিকমত দান করেন, যাকে চান না তাকে হিকমত দান করেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يُؤۡتِي ٱلۡحِكۡمَةَ مَن يَشَآءُۚ وَمَن يُؤۡتَ ٱلۡحِكۡمَةَ فَقَدۡ أُوتِيَ خَيۡرٗا كَثِيرٗاۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّآ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ﴾ [البقرة: 269]

অর্থ, তিনি যাকে চান প্রজ্ঞা দান করেন। আর যাকে প্রজ্ঞা দেয়া হয়, তাকে অনেক কল্যাণ দেয়া হয়। আর বিবেক সম্পন্নগণই উপদেশ গ্রহণ করে। [1]

আল্লাহ তাআলা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রিসালাতের দায়িত্ব দেয়ার মাধ্যমে হিকমত ও জ্ঞান দান করেছেন, ভালো কাজের তাওফিক দিয়েছেন এবং আল্লাহ তাকে তার যাবতীয় কর্মে সাহায্য করেছেন।

এ কারণে, আল্লাহর পক্ষ হতে যখন তার স্বজাতিদের ইসলামের দাওয়াত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়, তখন তিনি তাদের দাওয়াত দেয়ার জন্য বিভিন্ন কৌশল ও হিকমত অবলম্বন করেন। তিন প্রথমেই সবাইকে ডেকে একত্র করে ইসলামের দাওয়াত দেয়া শুরু করেননি। প্রথমে দু একজনকে গোপনে গোপনে ইসলামের দাওয়াত দিতে আরম্ভ করেন; তারা যে সব শিরক, কুফর ও ফিতনা-ফ্যাসাদে নিমগ্ন, তার পরিণতি সম্পর্কে তাদের সতর্ক ও ভয় পদর্শন করেন। শুরুতেই তাদের যাবতীয় অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা আরম্ভ করেননি বরং প্রথমে তিনি তাদের তাওহীদের দাওয়াত দেয়া আরম্ভ করেন। তাওহীদের দিকে দাওয়াত দেয়ার মাধ্যমেই তিনি তার মিশনটি আরম্ভ করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلۡمُدَّثِّرُ ١ قُمۡ فَأَنذِرۡ ٢ وَرَبَّكَ فَكَبِّرۡ ٣ وَثِيَابَكَ فَطَهِّرۡ ٤ وَٱلرُّجۡزَ فَٱهۡجُرۡ ٥ وَلَا تَمۡنُن تَسۡتَكۡثِرُ ٦ وَلِرَبِّكَ فَٱصۡبِرۡ ٧﴾ [المدثر: 1-7]

হে বস্ত্রাবৃত! উঠ অত:পর সতর্ক কর। আর তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। আর তোমার পোশাক-পরিচ্ছদ পবিত্র কর। আর অপবিত্রতা বর্জন কর। আর অধিক পাওয়ার আশায় দান করো না। আর তোমার রবের জন্যই ধৈর্যধারণ কর।[2]

এখান থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদের পক্ষ থেকে যে নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হন, তার সমাধানের লক্ষে হিকমত ও কৌশলের পথ চলা আরম্ভ করেন। তিনি এমন এক বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানের পরিচয় দেন, যা এ যাবত-কাল পর্যন্ত দুনিয়াতে যত বড় বড় জ্ঞানীদের আবির্ভাব হয়েছে, তাদের সকলের জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তাকে হার মানিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, বরং সমগ্র মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি এ যায়গায় এসে অক্ষম হয়ে যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে তার সবচেয়ে কাছের লোক ও আত্মীয় স্বজনদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। পরিবার- পরিজন, বন্ধু-বান্ধব এবং যাদের তিনি ভালো বলে জানতেন এবং তারাও তাকে ভালো জানত, তাদের দিয়েই তিনি তার দাওয়াতের কাজ শুরু করেন। এছাড়াও যাদের মধ্যে সততা, ন্যায়-পরায়ণতা, কল্যাণ ও সংশোধন হওয়ার মত যোগ্যতা ও গুণাগুণ লক্ষ্য করতেন, তাদের তিনি তার দাওয়াতের আওতায় নিয়ে আসতেন এবং তাদের ইসলামের দাওয়াত দিতেন। এভাবে অত্যন্ত সংগোপনে ও অত্যধিক বুদ্ধিমত্তা ও সাবধানতার সাথে তিনি দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। তার প্রাণপণ চেষ্টার ফসল হিসেবে দেখা গেল, অতি অল্প সময়ে তাদের মধ্য হতে একটি ক্ষুদ্র জামাত ইসলামের ডাকে সাড়া দিল এবং তারা ইসলাম গ্রহণ করল। ইসলামের ইতিহাসে এদের সাবেকীনে আওয়ালীন বলা হয়ে থাকে। নারীদের মধ্যে সর্ব প্রথম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্ত্রী খাদিজা বিনতে খুয়াইলদ রা. ইসলাম গ্রহণ করেন। আর পুরুষদের মধ্যে আলী ইবনে আবু তালিব রা. তারপর তার গোলাম যায়েদ ইবনে হারেসা রা. তারপর আবু বকর সিদ্দিক রা. প্রমুখ ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হন। আবু বকর সিদ্দিক রা. নিজে ইসলাম গ্রহণ করার পর, নিজ উদ্যোগে আরও কতককে ইসলামের দাওয়াত দেন, তার দাওয়াতের ফলে এমন কিছু লোক ইসলাম গ্রহণ করে, যাদের অবদান ও ভূমিকা ইসলামের ইতিহাসে কিয়ামত অবধি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে এবং তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আর এসব মহা মনীষীরা হল, ওসমান ইবনে আফ্ফান রা. যুবাইর ইবনুল আওয়াম রা. আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রা. সায়াদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. ও তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ। এরা সবাই আবু বকর সিদ্দিক রা. এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করে। আলী রা., যায়েদ ইবনে হারেসা ও আবু বকর রা. সহ মোট আটজন ছাহাবী, যারা হলেন ইসলামের অগ্রপথিক ও প্রথম অতন্দ্র প্রহরী। এরা তারাই যারা সমস্ত মানুষের পূর্বে ইসলামের সুশীতল পতাকা তলে সমবেত হয়। সারা দুনিয়ার সমগ্র মানুষের বিরোধিতা স্বত্বেও তার কোন প্রকার পরোয়া না করে আল্লাহর নবীর আনিত দ্বীনের দাওয়াতে সাড়া দেন। তাদের ইসলাম গ্রহণের পর আরব জাহানে ঈমানের আলোড়ন সৃষ্টি হয়, এক এক করে মানুষ ইসলামে প্রবেশ করতে আরম্ভ করে এবং ঈমানের পতাকা তলে তারা সমবেত হতে থাকে। রাসূল ও তার সঙ্গীদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও বিরামহীন দাওয়াতের ফলে ধীরে ধীরে মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল এবং মক্কায় ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ল। সমগ্র মক্কায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইসলামের দিকে দাওয়াত দেয়া ও আল্লাহর তাওহীদের বিষয়টি তাদের আলোচনার প্রথম শিরোনামে পরিণত হল। একমাত্র দাওয়াতের আলোচনা ছাড়া আর কোন আলোচনা তাদের মধ্যে স্থান পেল না। এভাবেই দাওয়াতের প্রসার ঘটে এবং মুসলিমদের সংখ্যা দিন দিন আরও বাড়তে থাকে। যারা ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের নিয়ে গোপনে বৈঠক করতেন, গোপনে তাদের তালীম- তরবিয়ত ও গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা দিতেন; যাতে তারা আল্লাহর দ্বীনের মহান গুরু দায়িত্ব পালনে সক্ষম একটি জামাতে পরিণত হয় এবং কোন প্রকার জুলুম নির্যাতন তাদের মনোবলকে দুর্বল করতে না পারে।

মোট কথা, দাওয়াতের কাজটি ছিল তখনো ব্যক্তি পর্যায়ে ও গোপনে; প্রকাশ্যে দাওয়াত দেয়ার পরিবেশ তখনো তৈরি হয়নি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদের মাঝে এখনো প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে আরম্ভ করেননি। তিনি তার দাওয়াতের কাজটি গোপনে চালিয়ে যেতেন এবং যারা ইসলাম গ্রহণ করে তারা তাদের ইবাদত বন্দেগী ও ইসলামের বিধানাবলী গোপনে পালন করত। ইসলামের প্রথম যুগে কুরাইশদের ভয়ে মুসলিমরা ইসলামকে প্রকাশ করা ও প্রকাশ্যে ইবাদত বন্দেগী করার সাহস পেত না; ফলে তারা গোপনে ইবাদত বন্দেগী করত।[3]

এ ভাবে দাওয়াতের কাজ চলতে থাকলে ধীরে ধীরে মুসলিমদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেতে লাগল এবং ক্রমপর্যায়ে মুসলিমদের সংখ্যা চল্লিশে উন্নীত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদের মাঝে প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে আরম্ভ করেননি। তিনি গোপনেই তাদের দাওয়াত দিতে থাকেন। কারণ, বিজ্ঞ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা ভালো ভাবেই জানতেন, মুসলিমদের এ ক্ষুদ্র জামাত কুরাইশদের তুলনায় এখনো নগণ্য। এ ক্ষুদ্র জামাতকে কুরাইশদের পক্ষ থেকে যে সব বাধা-বিপত্তি, জুলম নির্যাতন ও প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হবে, তা প্রতিহত করা সম্ভব হবে না।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দাওয়াতে সাড়া দেয়া মুসলিমদের নিয়ে তাদের দিক নির্দেশনা ও তালীম দেয়ার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেন। এ জন্য তিনি তাদের নিয়ে একত্রে এক জায়গায় বসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন; যাতে তাওহীদের ডাকে সাড়া দানকারী ঈমানদারদের মধ্যে পারস্পরিক সু-সম্পর্ক তৈরি হয় এবং তাদের মাধ্যমে আরও যারা তাওহীদের বাহিরে আছে, তাদের নিকট তাওহীদের দাওয়াত পৌঁছে যায়। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি নিরাপদ স্থান খুঁজতে থাকেন। সর্বশেষ তিনি এর জন্য সৌভাগ্যবান সাহাবী আবী আরকাম আল মাখযুমীর ঘরকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে মুসলিমদের একই পরিবারের সদস্যদের মত করে একত্র করেন এবং এ ঘরের মধ্যে বসেই তিনি তাদের দ্বীন শেখান, তালীম-তরবিয়ত দেন এবং জীবন যাপনের যাবতীয় দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। আপাতত এ ঘরকেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের প্রধান কার্যালয় হিসেবে নির্ধারণ করেন। তবে এর পাশাপাশি আরও কিছু শাখা কার্যালয় ছিল, যে গুলোতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাঝে মাঝে গিয়ে সমবেত লোকদের তালীম দিতেন অথবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যার ঘরকে পছন্দ করতেন, সেখানে গিয়ে লোকজনদের একত্র করে তাদের তালীম দিতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও যাদের ঘরকে পছন্দ করেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হল, সাঈদ ইবনে যায়েদ রা.। তবে দাওয়াতের শুরু লগ্নে যখন মুসলিমরা দুর্বল ও সংখ্যালঘু ছিল; তারা তাদের ঈমান প্রকাশ করার কোন ক্ষমতা রাখত না এবং গোপনে গোপনে তারা ইবাদত বন্দেগী করত এবং মানুষদের ইসলামের দিকে আহ্বান করতেন; তখন দারে আরকামই ছিল ইসলাম ও মুসলিমদের প্রথম প্রাণ কেন্দ্র ও সুদৃঢ় দুর্গ। এখান থেকে ইসলামের দাওয়াত পরিচালিত হত। একটি কথা মনে রাখতে হবে, তখন ইসলামের দাওয়াত ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছিল।[4]

 এভাবে তিন বছর পর্যন্ত ইসলামের দাওয়াত অত্যন্ত সংগোপন ও ব্যক্তি পর্যায়ে একেবারেই সীমিত আকারে চলছিল। ইসলামের দাওয়াতকে প্রকাশ করার কোন সুযোগ মুসলিমদের ছিল না। লোক চক্ষুর অন্তরালে ও অতি সংগোপনে পরিচালিত দাওয়াতের কাজ ধীরে ধীরে গতি-লাভ করে এবং মুসলিমরা একটা জামাতে পরিণত হয়। ইসলামের মত নেয়ামতের ফলে মুসলিমরা পরস্পর ভাই ভাই পরিণত হয়, তারা একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে এবং তারা একে অপরকে ইসলামের সুশীতল ছায়া তলে সমবেত হওয়ার দাওয়াত দেয়।

তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চাচা হামযা ইবনে আব্দুল মুত্তালিবা রা. ও আরও কতক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ যেমন, ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. ইসলাম গ্রহণ করে। তাদের ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলিম জামাত অনেকটা শক্তিশালী হয় এবং তাদের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হয়। তারপর আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন,

﴿فَٱصۡدَعۡ بِمَا تُؤۡمَرُ وَأَعۡرِضۡ عَنِ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ٩٤ إِنَّا كَفَيۡنَٰكَ ٱلۡمُسۡتَهۡزِءِينَ ٩٥ ٱلَّذِينَ يَجۡعَلُونَ مَعَ ٱللَّهِ إِلَٰهًا ءَاخَرَۚ فَسَوۡفَ يَعۡلَمُونَ ٩٦﴾ [الحجر: 94- 96]

অর্থ, যে আদেশ দেয়া হয়েছে, তা ব্যাপকভাবে প্রচার কর এবং মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও। নিশ্চয় আমি তোমার জন্য উপহাসকারীদেরে বিপক্ষে যথেষ্ট। যারা আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহ নির্ধারণ করে। অতএব তারা অচিরেই জানতে পারবে।[5]

এতে এ কথা স্পষ্ট হয়, আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে প্রজ্ঞা ও হিকমতে পরিপূর্ণতা দান করেই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াতের ক্ষেত্রে যে উন্নত পদ্ধতি, হিকমত ও অভিজ্ঞতার সাক্ষর রাখেন, আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী একজন দা‘ঈর জন্য তা কিয়ামত পর্যন্ত অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে। আর যে আহ্বানকারী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দাওয়াতের পদ্ধতি ও হিকমত অবলম্বন করবে প্রকৃত পক্ষে সেই আল্লাহর রাসূলের অনুসৃত পথের অনুকরণকারী বলে গণ্য হবে। বিশেষ করে পৌত্তলিক কাফেরদের দাওয়াতের ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শের বাইরে যাওয়ার কোন অবকাশ নাই। কারণ, এ ক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উন্নত আদর্শ ও হিকমতের অনুকরণ করতে হবে। তবে বর্তমানে কোন মুসলিম দেশে ইসলামের দাওয়াতকে গোপনে দেয়ার কোন অবকাশ নাই। কারণ, এখন ইসলামের দাওয়াত সারা দুনিয়ার আনাচে কানাচে পৌঁছে গেছে; ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেনি এমন দুর্গম এলাকা বর্তমান দুনিয়াতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রথম যুগে গোপনে দাওয়াত দেন; কারণ, তখন ইসলামের দাওয়াত ছিল অংকুর সমতুল্য। যারা ইসলাম গ্রহণ করে তারা তাদের ইসলাম প্রকাশ করার মত কোন পরিবেশ ছিল না। অবস্থা এমন ছিল যে, ইসলামের প্রথম যুগে রাসূল ও তার সাথী-সঙ্গীরা প্রকাশ্যে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই) কথাটি বলতে পারত না, প্রকাশ্যে আযান দিতে ও সালাত আদায় করতে পারত না। তারপর যখন মুসলিমদের শক্তি, সামর্থ্য ও সাহস বৃদ্ধি পেল, আল্লাহ তা‘আলা তার রাসূলকে প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার আদেশ দেন। চেল্লাহর আদেশ পেয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে আরম্ভ করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে মুসলিমদের সংখ্যা আরও বাড়তে থাকে। কিন্তু মুসলিমদের বৃদ্ধি পাওয়া কাফেরদের ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়াল। কাফেররা মুসলিমদের কোনক্রমেই সহ্য করতে পারল না। তাই কাফেরদের পক্ষ হতে মুসলিমদের এমন নির্মম ও অমানবিক অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হল, যার ইতিহাস আমাদের কারো অজানা নয়।[6]

চলবে…


[1] সূরা বাকারা আয়াত: ২৬৯

[2] সূরা মুদ্দাচ্ছের আয়াত: ১-৭

 

[3] সীরাতে ইবনে হিশাম: ২৬৪/১, ইমাম শামছুদ্দিন আয-যাহবী রহ. এর তারিখুল ইসলাম সীরাত অধ্যায়: পৃ: ১২৭, বিদায়া নিহায়া: ২৪-৩৭, যাদুল মাআদ: ১৯/৩, মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব রহ. এর মুখতাছার সীরাত: পৃষ্ঠা ৫৯, মাহমুদ শাকের রহ. এর তারিখে ইসলামী: ৫৭/২, এবং হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব: পৃ:৯১

 

[4] আল- বিদায়া ওয়ান-নিহায়া: ৩১/৩, মাহমুদ শাকের রহ. এর তারিখে ইসলামী ৬২/২, এবং হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব: পৃ: ৯৭।

 

[5] সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৯৪-৯৬।

[6] রাহীকুল মাখতুম: পৃ: ৭৫, মাহমুদ শাকের রহ. এর তারিখে ইসলামী: ৬২/২ এবং হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব: পৃ: ৯৯।

Related Post