মহানবী (সা:) ছিলেন ক্ষমার অতুলনীয় আদর্শ

  madinaতিনি মহানবী সা: সবার সেরা নবী। সব যুগের সেরা মানুষ। সর্বশেষ নবী তিনি।  সেই নবীর উম্মত আমরা। শ্রেষ্ঠ নবীর শ্রেষ্ঠ উম্মত। মহানবীর আদর্শও তেমনি শ্রেষ্ঠ। তাঁর জীবনও ছিল উত্তম আদর্শের নমুনা। ব্যক্তিগত, সমাজ, রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন মহত্তম আদর্শের মডেল। তাঁর জীবনাচরণ ছিল সুষমা আর সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। দয়ামায়া, ভ্রাতৃত্ব-ভালোবাসা, ক্ষমা-করুণা, ধৈর্য-সাহস, সততা, ন্যায়নিষ্ঠা সব ক্ষেত্রেই তিনি মহান আল্লাহর নিয়ামতে পূর্ণ এক মহামানব। তাই তো তখনকার দিনে তাঁর শত্রুরাও ছিল তাঁর অনুরক্ত, ভক্ত। তারাই তাঁকে ডাকত ‘আল আমিন’ বা বিশ্বাসী বলে। আজকের যুগে বিধর্মী কাফের গবেষক চিন্তাবিদরাও তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বলে বিবেচনা করেন, মান্য করেন। মহানবী সা:-এর জীবনের কয়েকটি অপূর্ব ঘটনার উল্লেখ করছি এই প্রবন্ধে।

এক. সুমামা নামে ইয়ামামার এক সরদার মুসলমান হলেন। এতে মক্কার কুরাইশরা ভীষণ ক্ষুব্ধ  হলো। তারা সুমামাকে মক্কায় খুব অপদস্থ করল, মারধর করল। সুমামা কুরাইশদের আচরণে খুবই ব্যথিত হলেন। সুমামা তার দেশে ফিরে গেলেন। গোত্রের সবাইকে তার অপমানের কথা জানালেন। খাদ্যশস্যের ভাণ্ডার ইয়ামামা। মক্কার লোকেরা এখানকার শস্যের ওপর নির্ভরশীল। তাই ইয়ামামার লোকেরা ঠিক করল তারা মক্কায় কোনো খাদ্যশস্য পাঠাবে না। তাই করা হলো। এতে মক্কায় খাদ্যের অভাব পড়ে গেল। ফলে মক্কাবাসীরা বিচলিত হয়ে পড়ল। তাই সবাই সুমামার কাছে মাফ চাইতে ছুটে গেল ইয়ামামায়। সুমামার কাছে তারা ক্ষমা চাইল এবং খাদ্য সরবরাহের অনুরোধ জানাল। সুমামা বিনয়ের সাথে বললেন, বিষয়টি নবীজীর কাছে গিয়ে সুরাহা করতে হবে। তিনি অনুমতি দিলেই কেবল মক্কায় খাদ্য সরবরাহ করা হবে। কুরাইশদের মাথায় এবার বাজ পড়ল। তাদের প্রধান শত্রু  উজ্জার দুশমন, বাবা হোবলের দুশমন মুহাম্মদের কাছে যেতে হবে! কিন্তু কিছুই করার ছিল না তাদের। তারা যে নিরুপায়। খাদ্যশস্যের বিষয়ে একটা সুরাহা না হলে না খেয়ে মারা যাবে তারা। অগত্যা তারা মদীনায় ছুটল। তাদের মনে ভয় মুহাম্মদ যে কঠোর, নির্মম এক মানুষ সে কি রাজি হবে। এ রকম ভাবতে ভাবতে তারা হাজির হলো মদীনায়। সব কিছু তারা মহানবী সা:-কে খুলে বলল। কুরাইশদের দুঃখের কথা শুনে নবীজীর মন বিগলিত হলো। তখনই তিনি সুমামাকে খবর পাঠালেন অবরোধ তুলে নিতে। তিনি বললেন, “একজন মুসলমান  ক্ষুধাতুরের খাবার কেড়ে নেয় না,ক্ষুধার্তকে খাওয়ায়।” মহানবীর আদর্শ দেখে কুরাইশরা অবাক হলো। বিস্মিত হলো হৃদয়বান মুহাম্মদের মহত্ত্ব দেখে।

দুই. এক যুদ্ধে জয় লাভ করে সসৈন্যে মদীনায় পা রাখলেন নবী মুহাম্মদ সা:। সারা মদীনা তখন আনন্দে উতরোল। মুসলমানদের চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। কিন্তু নবীজীর মুখে হাসি নেই, মনে তেমন উত্তাপ ও উচ্ছ্বাস নেই। মদীনায় এসেই তিনি প্রথমে গেলেন মসজিদে নববীতে। কৃতজ্ঞতায় সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন সেখানে। আল্লাহকে যুদ্ধ জয়ের জন্য ধন্যবাদ জানালেন। তারপর নামাজ শেষে সাহাবাদের সাথে জরুরি বিষয় নিয়ে আলোচনায় মগ্ন হলেন। খুশির কোনো আমেজই ছিল না তাতে। এ দিকে নবীর স্ত্রী আয়েশা রা:-এর মনজুড়ে উল্লাস। তার স্বামী বিজয়ের বেশে ফিরছেন। তিনি উল্লসিত, উচ্চকিত। স্বামীকে অভিনন্দন জানাতে তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। তার পর্ণকুটিরে আজ আনন্দের ধারা যেন বইছে। খেজুরপাতার ছাউনি দিয়ে বানানো ঘর, যার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের আলো দেখা যায়। বৃষ্টি হলে পানি পড়ে, সেই কুটিরকে আয়েশা রা: আজ সাজালেন সুন্দর করে। ঘরের ছাদে সুন্দর একটি সামিয়ানা টানিয়ে দিলেন। ঘরের দেয়ালগুলো রঙিন কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন। এতে ঘরটা ঝকঝক করছে। ভাবলেন, রাসূল সা: এগুলো দেখে আনন্দিত হবেন। তার মনে খেলে যায় আনন্দের ঢেউ। একসময় নবীজী এসে ঘরে ঢুকেলন। আয়েশা রা: রাসূলের মুখের দিকে তাকালেন। কিন্তু এ কি! ভীষণ গম্ভীর তাঁর মুখাবয়ব। আয়েশা রা: বুঝতে পারলেন, নবীজী খুশি হননি। এবার আয়েশার দিকে তাকিয়ে রাসূল সা: বললেন, “দেখো আয়েশা! ইট-পাথরকে পোশাক পরানোর জন্য আল্লাহ আমাদেরকে দৌলত দেননি।” আত্মসংযমের কী মহৎ নমুনা ছিল নবীজীর জীবনে।

তিন. মক্কায় কাবাঘর মেরামতের কাজ চলছিল। সবাই কাজ করছে। কেউ পাথর আনছে, কেউ পানি তুলছে। কেউ বা কাঠ চেরাই করছে। বালক মুহাম্মদের মনও তা থেকে দূরে থাকতে চাইল না। তিনিও পাথর টেনে আনছিলেন। বড় পাথর। বইতে পারছিলেন না। কাঁধে পাথর বসে যাওয়ার উপক্রম হলো। অসম্ভব ভারে পাথরটা এক সময় মাটিতে পড়ে গেল। তিনি ঘর্মাক্ত ও রক্তাক্ত হয়ে গেলেন। সবাই ছোট বালকের প্রতি সমবেদনা দেখাল। তারা তাকে পাথর টানতে নিষেধ করল। তিনি শুনলেন না কিছুই। তার পরনে কাপড়, সারা গা  খালি। কেউ কেউ বলল, পরনের কাপড়টা খুলে কাঁধে ভাঁজ করে দিয়ে প্রয়োজনে পাথর টানতে। তখন বালক-বালিকা, পুরুষ-মহিলাদের উলঙ্গ হওয়া কোনো ব্যাপারই ছিল না। তরুণ-তরুণীরা উলঙ্গ হয়ে কাবাগৃহ তাওয়াফ করত। মুহাম্মদ সা: কাপড় খুলতে মোটেও রাজি হলেন না। একজন এসে মুহাম্মদের পরনের কাপড়টা টান মেরে খুলে ফেলল। বালক মুহাম্মদ বিস্মিত হলেন। মুহূর্তেই তিনি জ্ঞান হারালেন। তিনি লুটিয়ে পড়লেন বালুর ওপর। তাঁর এ অবস্থা দেখে সবাই ব্যাকুল হয়ে পড়ল। তারা ঘাবড়ে গেল। এমন সময়ে একজন এসে কাপড়টা বালক মুহাম্মদের উলঙ্গ দেহের ওপর ছুড়ে মারল। আর অমনি মুহাম্মদ সা: জ্ঞান ফিরে পেলেন। তাঁর চোখের পাতা নড়ে উঠল। তিনি সম্বিৎ ফিরে পেলেন। কী অপূর্ব লজ্জাবোধ ছিল এই মহামানবটির! শিশু বয়সেও তাঁর লজ্জাজ্ঞান ছিল কতই না গভীর!

চার. মক্কা বিজয়ের পরের ঘটনা। মাখদুম গোত্রের এক মহিলার ঘটনা। কুরাইশদের একটি শাখা মাখদুম গোত্র। বড় সম্মানিত গোত্র এটি। অন্য গোত্রের বিচার-সালিশ করে এই গোত্র। কিন্তু এখন চুরির ঘটনায় মহিলার হাত কাটার ব্যবস্থা। ইসলামী আইনে এর কোনো ব্যতিক্রম নেই। এত বড় একটা মানি গোত্র। সম্ভ্রান্ত ঘর। আর এই গোত্রের মহিলার হাত কাটা গেলে কী যে লজ্জায় পড়তে হবে, তা ভেবে সবাই পেরেশান হলো। তাই তারা নবীজীকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে ক্ষমা পাওয়ার একটা পথ বের করতে চেষ্টা চালাল। তাই তারা বেছে নিলো উসামাকে। রাসূল সা:-এর পালিত পুত্র মুক্ত ক্রীতদাস জায়েদের পুত্র উসামা। নবীজীর কাছে বড় আদরের পাত্র তিনি। এই উসামাকেই আপন উটের ওপর বসিয়ে মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী সা: মক্কা শহরে প্রবেশ করেছিলেন। উসামাকে গভীরভাবে ভালোবাসেন নবী মুহাম্মদ সা:। সেই উসামা মহিলাকে নিয়ে হাজির হলেন রাসূল সা:-এর কাছে। মাখদুমের লোকেরাও রয়েছে তার সাথে। নবীজী উসামাকে তার কথা শোনাতে বললেন। উসামা বিনীতভাবে নবীজীকে বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! মাখদুম গোত্রের কথা বিবেচনা করে তাকে ক্ষমা করা যায় কি না” নবীজী উসামার কথা শুনে বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ নীরব থেকে তারপর উসামাকে বললেন, “উসামা! আল্লাহ যে শাস্তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তুমি কি আমাকে তার ব্যতিক্রম করতে বলছো”  উসামা কথা শুনে লজ্জা-শরমে লাল হয়ে গেলেন। তিনি বিনীতভাবে ক্ষমা চাইলেন নবীজীর কাছে। নবীজী তারপর বললেন, “তোমরা নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো বিচারে নিরপেক্ষতার অভাবে অতীতে বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। বড়লোকেরা অন্যায় করলে নামমাত্র বিচারে তারা ছাড়া পেয়ে যেত, আর একই অপরাধে গরিবের ওপর নেমে আসত কঠোর ও নির্মম সাজা। কেবল এই কারণে বনি ইসরাইল জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।” নবীজীর কথা  শুনে সাহাবারা সবাই নীরব হয়ে গেলেন। মাখদুম গোত্রের লোকেরাও নীরব। সবার নীরবতা ভেঙে নবীজী বললেন, “তোমরা জেনে রাখো, যার হাতে আমার জীবন সেই আল্লাহর কসম! আজ যদি আমার কন্যা ফাতেমাও এ অপরাধে লিপ্ত হতো সেও আল্লাহর নির্ধারিত সাজা থেকে রেহাই পেত না। আমি তখনই তার হাত কাটতাম।” ন্যায়বিচারের কী পরাকাষ্ঠাই না ছিল নবী মুহাম্মদ সা:-এর মধ্যে।

পাঁচ. বনু হানিফা গোত্র। দুর্ধর্ষ এক কুচক্রী গোত্র এটি। বহু অপরাধের ধারক-বাহক এই গোত্রের লোকেরা। মুসাইলামার মতো মিথ্যুক নবীর জন্ম এই গোত্রে। এই গোত্রেরই প্রচণ্ড বিদ্বেষী ও খুনি সরদার সুমামা ইবনুল আদাল। বহু খুনে তার হাত রঞ্জিত হয়েছে। অসংখ্য মুসলমানের সর্বনাশ হয়েছে তার হাতে। এবার সে বন্দী। সবাই তার কতলের জন্য দাবি তুলল। ইসলামের এই বড় দুশমনের একমাত্র শাস্তি হলো কতল। বন্দীকে হাজির করা হলো নবীজীর কাছে। তিনি বন্দীর দিকে তাকালেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কি কিছু হয়েছে”  বন্দী বলল, “হে মুহাম্মদ! আপনি যদি আমাকে হত্যা করেন তাহলে একজন বড় দুশমন, অপরাধী ও হত্যাকারীকেই হত্যা করবেন। আর যদি দয়া করেন তাহলে একজন সত্যিকার অকৃতজ্ঞ ব্যক্তির প্রতি অনুগ্রহ করবেন। আর তা না করে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দিলে বলুন তাহলে কত মুক্তিপণ দিতে হবে?” সুমামার কথা শুনে রাসূল সা: চুপ থাকলেন এবং কিছু না বলে উঠে চলে গেলেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনও একই প্রশ্ন করল সুমামা, এ দিনেও নবীজী আর কোনো কথাই বললেন না। সুমামা জানত মৃত্যুই তার শাস্তি। এ জন্য সে প্রস্তুতও ছিল। একদিন অকস্মাৎ নবী সা: সুমামাকে মুক্ত করে দিতে এক সাহাবিকে নির্দেশ দিলেন। সাহাবি তাই করল। নবীজীর কাণ্ড দেখে বিস্মিত হলো সুমামা। এটা যে কল্পনাও করা যায় না। মুক্ত হয়ে সে চলে গেল নীরবে। সাহাবিরা ভাবলেন সুমামা আবার গোত্রের লোকদের নিয়ে আক্রমণের প্রস্তুতি নেবে। কিন্তু না, একটু পরেই সে ফিরে এলো নবীজীর নিকট। মদীনার উপকণ্ঠে একটা কূপ থেকে গোসল সেরে এসেছে সুমামা। এসেই নবীজীকে মিনতির সুরে বলল, ‘আমাকে সত্য ধর্মের দীক্ষা দিন।’ নবীজী তাকে ভাবতে বললেন। সুমামা বলল  ‘না, এখনই আমি সত্য ধর্মে ফিরে আসতে চাই।’ সে আবেগভরা কণ্ঠে জানাল, ‘এ শহর ছিল আমার কাছে সবচেয়ে ঘৃণ্য আর আজ তা হলো সবচেয়ে প্রিয়। একটু আগেও এই ধর্ম ছিল আমার কাছে সবচেয়ে জঘন্য, আর এখন সবচেয়ে উত্তম। আর আপনার চেয়ে অধিক প্রিয় মানুষ আমার আর কেউ নেই।’ আল্লাহু আকবার

এ কথা বলেই সুমামা ইবনুল আদাল নবী সা:-এর পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ক্ষমার মহিমায় রাসূলুল্লাহ সা: মানুষকে এভাবেই আপন করে নিলেন, দীক্ষিত করলেন আল্লাহর দ্বীন ইসলামে।

মহানবী সা:-এর জীবনের প্রতিটি ঘটনায় তিনি যে উত্তম আচরণ, আদর্শ পেশ করেছেন তারই কারণে ইসলাম হয়েছিল বিজয়ী। দুনিয়াজুড়ে ইসলাম মানুষের মুক্তির দিশা হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছিল। আজো এই মহান আদর্শ ফুরিয়ে যায়নি। আমরা মুসলমানেরা সেই উত্তম আদর্শ থেকে বিচ্যুত বলেই আমাদের আজকের এই দুর্দশা। আমরা যেন মহানবী সা:-এর আদর্শে উদ্ভাসিত হতে পারি, আল্লাহ আমাদের সেই তাওফিক দান করুন।

 ইনটারনেট সুত্র – ইকবাল কবীর মোহন – নয়াদিগন্ত

Related Post