ইসলামে নিষ্ঠা বা ইখলাসের গুরুত্ব

ইসলামে নিষ্ঠা বা ইখলাসের গুরুত্ব

ইসলামে নিষ্ঠা বা ইখলাসের গুরুত্ব

প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব রকমের কথা ও কাজে ইখলাস তথা নিষ্ঠা প্রসঙ্গে
পবিত্র কুরআনের বাণী ঃ
মহান আল্লাহ বলছেন ঃ “তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধ চিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে, এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন (ধর্ম)।” [সূরা আল- বাইয়্যিনাহ :৫]

পবিত্র হাদীসের বাণী ঃ
“আমীরুল মু’মিনীন আবু হাফ্স উমার বিন খাত্তাব রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে, সকল কাজের পরিণাম তার নিয়ত অনুযায়ী হবে। প্রত্যেক ব্যক্তি যে নিয়ত নিয়ে কাজ করবে, সে তাই পাবে। সুতরাং যার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র (সন্তুষ্টির) উদ্দেশ্যে হয়েছে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র (সন্তুষ্টির) জন্যে হয়েছে বলেই পরিগণিত হবে। পক্ষান্তরে যার হিজরত দুনিয়া লাভের কারণে বা কোন মেয়েকে বিবাহ করার নিয়তে হয়েছে, তার হিজরত উক্ত উদ্দেশ্যে হয়েছে বলেই পরিগণিত হবে।” [বুখারী-৬৬৮৯ ও মুসলিম-১৯০৭]

আরো একটি হাদীসের বর্ণনা ঃ “ আবূ হুরায়রা আব্দুর রহমান বিন সাখ্র রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্র্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মহান আল্লাহ তোমাদের শরীর বা আকৃতির দিকে দেখেন না, বরং তোমাদের অন্তঃকরণ ও কর্মকান্ডের দিকে দেখেন।” [মুসলিম – ২৫৬৪]

অন্য একটি হাদীসের বর্ণনা ঃ “আবূ বাকরাহ নুফাই’ বিন হারিস আস-সাকাফী রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ঃ দু’জন মুসলমান (উলঙ্গ) তলোয়ার নিয়ে (একে অপরকে খুন করার উদ্দেশ্যে) মুখোমুখি হলে খুনি এবং নিহত ব্যক্তি উভয়ই জাহান্নামী। আমি বললাম ঃ হে আল্লাহর রাসূল! এতো খুনির কথা, কিন্তু নিহত ব্যক্তির ব্যাপারটা কেমন হল যে, সেও জাহান্নামী? তিনি বললেন ঃ সেও তার প্রতিপক্ষকে খুন করার আকাঙ্খী ছিল (এই কারণে সেও জাহান্নামী)।” [বুখারী – ৩১ ও মুসলিম – ২৮৮৮]

অন্য আরো একটি হাদীসের বর্ণনা ঃ “আবুল আব্বাস আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রব থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন ঃ আল্লাহ ভাল এবং মন্দ লিখে দিয়েছেন, তারপর তা (নাবী রাসূলগণের কাছে নাযিলকৃত কিতাবের মাধ্যমে) সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। অতএব যে ব্যক্তি কোন সৎ কাজের ইচ্ছা করে তা না করলেও আল্লাহ তাকে পূর্ণ কাজের সওয়াব দিবেন। আর যদি সে সৎ কাজের ইচ্ছা করে এবং তা বাস্তবায়নও করে ফেলে, আল্লাহ তার জন্যে দশ থেকে সাতাশ গুণ পর্যন্ত, এমনকি এর চেয়েও অধিক সওয়াব লিখে দেন। আর যে ব্যক্তি কোন মন্দ কাজের ইচ্ছা করে তা না করলে, আল্লাহ তার বিনিময়ে তাকে পূর্ণ কাজের সওয়াব দেন। পক্ষান্তরে সে যদি মন্দ কাজের ইচ্ছা করে এবং (তদানুযায়ী) কাজটা বাস্তবায়ন করে ফেলে, তাহলে আল্লাহ তার জন্যে একটিই মাত্র গুনাহ লিখেন।” [বুখারী-৬৪৯১ ও মুসলিম- ১৩১]

আমরা কী উপর্যূক্ত আয়াতসমুহকে পুরোপুরীভাবে মেনে দুনিয়াতে জীবন-যাপন করতে পারছি? আশা করি উত্তরে না’র সংখ্যাই বেশী হবে। কারণ আমাদের ভিতরে নিয়তে একনিষ্ঠার চেয়ে মুনাফিকীর খাসলতই বেশী দেখা যায়।

অতএব, হে আল্লাহর প্রিয় বান্দা-বান্দিগণ! আসুন আমরা সকলেই পবিত্র আল-কুরআন ও হাদীস থেকে উপস্থাপিত উপর্যুক্ত আয়াতসমূহের মহান বিধান মোতাবিক নিষ্ঠাবান মুসলমান হয়ে দুনিয়া ও আখেরাতে মহাকল্যাণ উপভোগ করার প্রাণপন চেষ্টা করি।

দয়াময় পরম দয়ালু সুমহান আল্লাহ আমাদের সমস্ত মানবজাতিকে মুনাফিকী আচরণ পরিহার করে, তাঁর প্রিয় রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শের একনিষ্ঠবান মুসলমান (উম্মত) হিসেবে কবুল করে সকলকেই দুনিয়া ও আখেরাতে মহাকল্যাণ উপভোগ করার তাওফীক দান করুন। আমিন।

মুসলমানদের মান সম্মানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং তাদের আচরণ প্রসঙ্গে

পবিত্র কুরআনের বাণী ঃ
মহান আল্লাহ বলেন ঃ “যে ব্যক্তি অন্য প্রাণের বিনিময় ব্যতীত, কিংবা কারো দ্বারা ভূ-পৃষ্ঠে কোন ফাসাদ বিস্তার ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে হত্যা করলো, তবে সে যেন সমস্ত মানব জাতিকে হত্যা করে ফেললো; আর যে ব্যক্তি কোন ব্যক্তিকে রক্ষা করলো, তবে সে যেন সমস্ত মানুষকে রক্ষা করলো।” [সূরা আল-মায়িদাঃ ৩২]

মহান আল্লাহ আরো বলেন ঃ “মু’মিনরা পরস্পর ভাই ভাই, সুতরাং তোমরা দুই ভাই এর মধ্যে (কখনও কোন বিষয়ে মতবিরোধ বা মতানৈক্য দেখলে সেটাকে বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে আগুনে ঘি না ঢেলে আপোসে) মিমাংসা করে দাও এবং (এ ব্যপারে) আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও।” [সূরা আল-হুজুরাত ঃ ১০]

মহান আল্লাহ আরো বলছেন ঃ “ হে মু’মিনগণ! কোন (মু’মিন) পুরুষ যেন অপর কোন (মু’মিন) পুরুষকে উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে; এবং কোন (মুমিনা) নারী যেন অপর কোন (মুমিনা) নারীকে উপহাস না করে; কেননা যাকে উহাস করা হয়, সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ কর না, এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না; ঈমানের পরে (কাউকে) মন্দ নামে ডাকা গর্হিত কাজ। যারা এ ধরনের আচরণ হতে নিবৃত্ত না হয় তারাই যালিম।” [সূরা আল-হুজুরাত ঃ ১১]

মহান আল্লাহ আরো বলছেন ঃ “হে মু’মিনগণ! তোমরা বহুবিদ অনুমান হতে দূরে থাকো; কারণ কোন কোন অনুমান পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করোনা। তোমাদের মধ্যে কী কেউ তার মৃত ভাই এর গোশত খেতে পছন্দ করবে? বস্তুতঃ তোমরা এটাকে ঘৃণাই মনে কর। তোমরা (এই সকল বিষয়ে) আল্লাহকে ভয় কর। (তোমাদের মধ্যে কেউ যদি এ ধরনের আচরণ করে থাকো তাহলে সে জন্যে এখনি তাওবা কর, কারণ) আল্লাহ তাওবা গ্রহণকারী পরম দয়ালু।” [সূরা আল-হুজুরাত ঃ ১২]
পবিত্র হাদীসের বাণী ঃ
আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ঃ “এক মু’মিন অপর মু’মিনের জন্যে ভবন বা প্রাসাদ স্বরূপ, যার এক অংশ অন্য অংশকে দৃঢ় করে (বা শক্তি যোগায়)। (এ কথা বলার সময় তিনি কথাটিকে অধিক বোধগোম্য করে বুঝানোর জন্যে তাঁর) এক হাতের আঙ্গুলগুলো দ্বিতীয় হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে বিজড়িত করে দেখালেন।” [হযরত আবূ মূসা (রাঃ)-এর মাধ্যমে বুখারীতে বর্ণিত হাদীস নং -৪৮০]

আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন ঃ “পারস্পারিক ভালবাসা, করুণা-অনুগ্রহ ও সহানুভূতির ক্ষেত্রে মু’মিনগণ একটি দেহের ন্যায়; যার একটি অঙ্গ পীড়িত হলে তার জন্যে সমস্ত শরীর অনিদ্রা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।” [হযরত নুমান বিন বাশীর (রাঃ)-এর মাধ্যমে বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত। হাদীস নং -বুখারী ঃ ৬০১১ ও মুসলিম ঃ ২৫৮৬]

আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন ঃ “মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার উপর যুলুম করবে না এবং তাকে দুশমনের হাতে তুলে দিবে না। যে ব্যক্তি তার (মুসলমান) ভাই এর প্রয়োজন পূরণ করবে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পুরণ করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের কষ্ট-বিপদ লাঘব করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার কষ্ট-বিপদ লাঘব করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ-ক্রটি গোপন রাখবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন।” [হযরত ইবনে উমার (রাঃ)-এর মাধ্যমে বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত। হাদীস নং ঃ বুখারী ঃ ২৪৪২ ও মুসলিম ঃ ২৫৮০]
আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন ঃ “ তোমরা একে অপরের বিরূদ্ধে হিংসা-ঈর্ষা করো না, দালালী করো না, ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করো না, পরস্পর মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না এবং তোমাদের কেউ অন্য কারো কেনাবেচার উপর (ইচ্ছাকৃত ভাবে দাম বাড়িয়ে দিয়ে) কেনাবেচা করবে না। আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা ভাই ভাই হয়ে যাও। মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার প্রতি অত্যাচার করবে না, তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে না এবং তাকে ব্যর্থ করবে না। তাকওয়া-পরহেযগারী এখানে রয়েছে। নিজের বক্ষের দিকে ইঙ্গিত করে এ কথাটি তিনি তিনবার বললেন। একটি মানুষকে মন্দ-খারাপ হওয়ার জন্যে যথেষ্ট যে, সে তার মুসলমান ভাইকে তুচ্ছজ্ঞান করা। এক মুসলমানের রক্ত, মাল-সম্পদ ও মান-মর্যাদা অপর মুসলমানের জন্যে হারাম।” [হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ)-এর মাধ্যমে বুখারীতে বর্ণিত। হাদীস নং -২৫৬৪]

আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন ঃ “তোমার ভাই এর সাহায্য কর, সে অত্যাচারী হোক অথবা অত্যাচারীত। এক ব্যক্তি বলে উঠলেন ঃ হে আল্লাহর রাসূল! অত্যাচারিত ব্যক্তিকে সাহায্য করার ব্যপারটা তো ঠিক আছে, কিন্তু অত্যাচারীকে কিভাবে সাহায্য করবো? (আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ) তুমি তাকে যুলুম-অন্যায় থেকে বিরত রাখবে-এটাই তাকে সাহায্য করা।” [হযরত আনাস (রাঃ)-এর মাধ্যমে বুখারীতে বর্ণিত। হাদীস নং -২৪৪৪]

কিন্তু বর্তমানে মুসলমানদের পরস্পপরের প্রতি আমাদের আচরণটা কী সে পর্যায়ে আছে? চলুন একটি বাস্তব চিত্রের সাথে পরিচিত হয়ে দেখি ঃ-

(অনেক ভাই হয়তো এ দৃশ্যকে রাজনীতির মাঠে নিয়ে তার উপর বিভিন্ন রং চরিয়ে এ আচরণকে ন্যয় সংগত মনে করার চেষ্টা করতে পারেন। রাজনীতিতো মানুষের মহাকল্যাণ সাধনের জন্যে। কিন্তু যে রাজনীতিতে মানবতা বিলুপ্ত সে রাজনীতি কী কল্যাণকর ? যারা এ রকম রাজনীতি করছেন, তাদের কাছে মানবতা কতখানি সংরক্ষিত হবে, যা আশা করা যায়?)

অতএব হে আল্লাহর প্রিয় বান্দা-বান্দিগণ! আর কোন হিংসা নয়, কোন দ্বন্দ নয় এবং নয় কোন সঙ্ঘাত। আসুন আমরা সকলেই পবিত্র আল-কুরআন ও হাদীস থেকে উপস্থাপিত উপর্যুক্ত আয়াতসমূহের মহান আদর্শে আদর্শবান মুসলমান হয়ে পরস্পর একে অপরের মহাশত্রু না হয়ে কল্যাণকামী ভাই হিসেবে আত্মপ্রকাশ করি এবং তার প্রতিদানে সকলে মিলে এ দুনিয়া ও আখেরাতে মহাকল্যাণ উপভোগ করার প্রাণপন চেষ্টা করি।

দয়াময় পরম দয়ালু সুমহান আল্লাহ আমাদের সমস্ত মানবজাতিকে তাঁর প্রিয় রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শের আদর্শবান মুসলমান (উম্মত) হিসেবে কবুল করে সকলকেই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করে এ দুনিয়া ও আখেরাতে মহাকল্যাণ উপভোগ করার তাওফীক দান করুন। আমিন।

জনগনের প্রতি শাসকদের এবং অধীনস্থদের প্রতি দায়িত্বশীলগণের আচরণ বিধি প্রসঙ্গে

পবিত্র কুরআনের বাণী ঃ
মহান আল্লাহ বলেন ঃ “মু’মিনদের মধ্য থেকে যারা তোমার অনুসরণ করে (হে মু’মিন শাসকগণ!) তাদের প্রতি তুমি বিনয়ের হাত বাড়িয়ে দাও।” [সূরা শু’আরা ঃ ২১৫]

মহান আল্লাহ আরো বলছেন ঃ “প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন ন্যয়বিচার ও সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় করতে। আর তিনি নিষেধ করেছেন অন্যায়, অশ্লীলতা এবং যুলুম ও সীমালঙ্ঘন থেকে। আল্লাহ তোমাদের নসীহত করছেন, যাতে তোমরা নসীহত গ্রহণ করে ধন্য হতে পারো।” [সূরা নাহল ঃ ৯০]

মহান আল্লাহ আরো বলছেন ঃ “ তোমরা (সর্বক্ষেত্রে) ইনসাফ (ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা) করো; নিঃসন্দেহে আল্লাহ ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারীদের ভালোবাসেন।” [সূরা হুজুরাত ঃ ৯]

পবিত্র হাদীসের বাণী ঃ
“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি ঃ তোমাদের প্রত্যেকেই সংরক্ষক (বা দায়িত্বশীল)। তোমাদের প্রত্যেককেই তার অধীনস্থদের রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পুরুষ তার পরিবারের জন্যে সংরক্ষক বা দায়িত্বশীল। তাকে তার পরিবারের সংরক্ষণ ও দায়িত্ব পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। স্ত্রীলোক তার স্বামীগৃহের সংরক্ষক বা দায়িত্বশীল, এবং তাকে সে সম্পর্কে জবাবদিহী করতে হবে। খাদেম বা চাকর তার মনিবের ধন-সম্পদের সংরক্ষক, তাকে তার সেই দায়িত্ব পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। এক কথায়, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল আর প্রত্যেককেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন সম্পর্কে জবাবদিহী করতে হবে।” [বুখারী ও মুসলিম]

আরো একটি হাদীসের বর্ণনা ঃ
“হযরত আবু ইয়া’লা মা’কাল ইবনে ইয়াসার রাযিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি ঃ আল্লাহ তার কোন বান্দাকে জনসাধারণের তত্ত্বাবধায়ক বানাবার পর যদি সে তাদের সাথে খেয়ানত করে, তবে সে যখনই মৃত্যবরণ করুন, আল্লাহ তার জন্যে জান্নাত হারাম করে দেবেন। [বুখারী ও মুসলিম]
অন্য এক রেওয়ায়েতে আছে ঃ সেই ব্যক্তি যদি তার প্রজাদের কল্যাণ সাধনে আত্মনিয়োগ না করে, তাহলে সে জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না।
মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় আছে ঃ যে শাসক মুসলমানদের যাবতীয় বিষয়ের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হওয়ার পর তাদের উপকারের কোনরূপ চেষ্টা-যত্ন করে না এবং তাদের কল্যাণ সাধনে কোন উদ্যোগ নেয় না, সে মুসলমানদের সাথে কিছুতেই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।

অন্য আরো একটি হাদীসের নর্ণনা ঃ
“উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়েশা রাযিআল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমার ঘরে বলতে শুনেছি ঃ হে আল্লাহ ! যাকে আমার উম্মতের কোন কাজের দায়িত্বশীল নিয়োগ করা হয়, সে যদি তাদের প্রতি কঠোর নীতি প্রয়োগ করে, তবে তুমিও তার প্রতি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করো। পক্ষান্তরে কাউকে আমার উম্মতের কোন কাজের দায়িত্বশীল বানানোর পর সে যািদ তাদের প্রতি কোমল ও নরম ব্যবহার করে, তাহলে তুমিও তার প্রতি কোমল ব্যবহার করো।” [মুসলিম]

অন্য একটি হাদীসের বর্ণনা ঃ
“হযরত আবু হুরায়রা রাযিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ঃ বানী ইসরাইলের রাজনৈতিক কর্মধারা চালু রাখতেন তাদের নবীরা। এক নবীর মৃত্যুর পর পরবর্তী নবী তাঁর শূন্য স্থান পূরণ করতেন। কিন্তু আমার পর আর কোন নবী নেই। তবে অচিরেই আমার পরে বেশ কিছু সংখ্যক লোক (আমার প্রতিনিধি বা ) খলিফা হবেন। সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন ঃ তখনকার জন্যে আমাদের প্রতি আপনার নির্দেশ কি ? তিনি বললেন ঃ তোমরা পালাক্রমে একজনের পর আরেকজনের বাইয়াত পূর্ণ করবে। তাদের প্রাপ্য হক আদায় করবে। আল্লাহর নিকট সেই জিনিস প্রার্থনা করবে, যা তোমাদের জন্যে নির্ধারিত রয়েছে। কারণ আল্লাহ তাদের ওপর জনগণের দেখাশুনার যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, সে সম্পর্কে তিনি নিজেই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।” [বুখারী ও মুসলিম]

অন্য আরো একটি হাদীসের বর্ণনা ঃ
“হযরত আয়েয ইবনে আমর বর্ণনা করেন, একদা তিনি উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের নিকট গিয়ে বললেন ঃ বৎস ! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি ঃ নিকৃষ্টতম শাসক হলো সেই ব্যক্তি, যে তার প্রজাদের ওপর কঠোর ও যুলুমমূলক নীতি প্রয়োগ করে। কাজেই তুমি সতর্ক থেকো, যেন তাদের মধ্যে শামিল না হয়ে পড়ো।” [বুখারী ও মুসলিম]

আরো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাদীসের বর্ণনা ঃ
“হযরত আবু হুরাইরা রাযিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ঃ সাত শ্রেণীর লোককে আল্লাহ (কিয়ামতের) সেই কঠিন দিনে তাঁর রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় দান করবেন, যেদিন তাঁর (আরশের) ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়াই থাকবেনা। আর তারা হচ্ছেন ঃ (১) ন্যায়পরায়ণ শাসক, (২) সেই যুবক যে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে তার যৌবনকাল অতিক্রান্ত করেছে, (৩) সেই ব্যক্তি, যার হৃদয় সর্বদাই মসজিদের সঙ্গে লেগে থাকতো, (৪) এমন দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর (সন্তুষ্টির) জন্যেই পরস্পরকে ভালোবেসে একত্র হয়, এবং আল্লাহর (সন্তুষ্টির) জন্যেই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, (৫) এমন ব্যক্তি যাকে অভিজাত বংশের কোন সুুুন্দরী রমণী (অবৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্যে) আহ্বান জানায় এবং তার জবাবে সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি (এই কথা বলে তার কুপ্রস্তাব প্রত্যাখান করে।) (৬) এমন ব্যক্তি যে এমন গোপনভাবে (মানুষকে) দান করে, যে তার ডান হাত কি দান করেছে, তার বাম হাত সে কথা জানে না এবং (৭) এমন ব্যক্তি যে একাকী নিভৃতে আল্লাহকে স্মরণ করে তার অতীত ভুলত্রুটি ক্ষমার জন্যে দু’চোখের অশ্রু ঝরাতে থাকে।” [বুখারী ও মুসলিম]

কিন্তু বর্তমানে যারা আমাদের মুসলমানদের শাসক বা নেতা ও বিভিন্ন দায়িত্বশীল নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের কাছে কী আমরা অধীনস্থরা উপর্যুক্ত আয়াতসমূহের আলোকে বর্ণিত আচরণগুলো পাচ্ছি ? হয়তো অধিকাংশ ব্যক্তির জবাবই হবে না সূচক।

অতএব হে আল্লাহর প্রিয় বান্দা-বান্দিগণ! আর কোন হিংসা নয়, কোন দ্বন্দ নয় এবং নয় কোন সঙ্ঘাত। আসুন আমরা সকলেই পবিত্র আল-কুরআন ও হাদীস থেকে উপস্থাপিত উপর্যুক্ত আয়াতসমূহের আলোকে পরস্পরের দায়িত্ব সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করে সেই সাথে মহান আদর্শে আদর্শবান মুসলমান হয়ে নিজ নিজ দায়িত্বের প্রতি সচেতন থেকেই নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার প্রাণপণ চেষ্টা করি। আর এ পবিত্র উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে আমরা কোন মুনাফিক মুরতাদ বা কোন মুশরিকের কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে আমাদের শাসন কার্য পরিচালনার জন্যে প্রকৃত ঈমানদার ও আল্লাহ ভীরু মুসলমান নেতা নির্বাচন করে রাজকার্র্য পরিচারনার দায়িত্ব অর্পন করে সকলে মিলে এ দুনিয়া ও আখেরাতে মহাকল্যাণ উপভোগ করার প্রাণপন চেষ্টা করি।

দয়াময় পরম দয়ালু সুমহান আল্লাহ আমাদের সমস্ত মানবজাতিকে তাঁর পবিত্র আল-কুরআনের আলোকে এবং তাঁর প্রিয় রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রকৃত আদর্শের আদর্শবান মুসলমান হিসেবে কবুল করে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সক্ষম করুন এবং তার বিনিময়ে আমাদের সকলকেই এ দুনিয়া ও আখেরাতে মহাকল্যাণ উপভোগ করার তাওফীক দান করুন। আমিন।

শপথ বা অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি রক্ষা প্রসঙ্গে

মহান আল্লাহর বাণী :
“তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করো না; আল্লাহর কাছে যা আছে শুধু তাই তোমাদের জন্যে উত্তম, যদি তোমরা জানতে। তোমাদের কাছে যা আছে, তা নিঃশেষ হবে এবং আল্লাহর কাছে যা আছে তা স্থায়ী; যারা (তাদের প্রয়োজন পুরণের জন্য আল্লাহর উপর ভরসা করে) ধৈর্যধারণ করে, আমি নিশ্চয়ই তাদেরকে তারা যা করে তা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার দান করব।” (সূরা আন্নাহল: ৯৫-৯৬)
মহান আল্লাহ আরো বলছেন:
“পরস্পরকে প্রবঞ্চনা করবার জন্যে তোমরা তোমাদের শপথকে ব্যবহার কর না; করলে (আেমাদের) পা স্থির হওয়ার পর পিছলিয়ে যাবে এবং আল্লাহর পথে বাঁধা দেয়ার কারণে তোমরা (দুনিয়া ও আখিরাতে) শাস্তির আস্বাধ গ্রহণ করবে; তোমাদের জন্যে রয়েছে মহাশাস্তি।” (সূরা:আন-নামল:৯৪)।
মহান আল্লাহ আরো বলছেন:
“আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের শপথগুলোর মধ্যে অর্থহীন শপথের জন্যে পাকড়াও করবেন না, কিন্তু তিনি তোমাদেরকে ঐ শপথসমূহের জন্যে পাকড়াও করবেন, যেগুলোকে তোমরা (ভবিষ্যত বিষয়ের প্রতি) দৃঢ় কর,……. (সূরা: আল-মায়িদা:৮৯)।

পবিত্র হাদীসের বাণী :
আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা:) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যার মধ্যে চারটি অভ্যাস বিদ্যমান সে খাঁটি মুনাফিক। আর যার মধ্যে এগুলোর (যে কোন) একটি অভ্যাস থাকে, তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকীর একটি স্বভাব থাকে। (আর সে বদ অভ্যাসগুলো হচ্ছে:)
১. তার কাছে (যে কোন জিনিস) আমানত রাখা হলে, সে তার খিয়ানত করে।
২. সে কথা বললে মিথ্যা বলে।
৩. কোন বিষয়ে অঙ্গীকার করলে বা প্রতিশ্রুতি দিলে তা (যে কোন অযুহাতে) ভঙ্গ করে। এবং
৪. ঝগড়া করলে প্রতিপক্ষকে অশ্লীল ভাষায় গালাগালী করে। (বুখারী ও মুসলিম)

কিন্তু এদুনিয়াতে আমারা যারা মুসলমানদের শাসক বা নেতা এবং বিভিন্ন দায়িত্বশীল নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালনের পূর্বে আল্লাহর নামে জনগণের কাছে যে অঙ্গীকারগুলো করে থাকি, উপর্যুক্ত আয়াতসমূহের আলোকে বর্ণিত আচরণগুলো কী আমরা রক্ষা করতে পারছি? হয়তো অধিকাংশ ব্যক্তির জবাবই হবে, না।
অতএব, আমরা যে কোন ব্যক্তি যে কারো সামনে যে কোন অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদা করি না কেন আসুন আমাদের নিজেদের কল্যাণেই সেই ওয়াদাগুলো পালন করে সকলে মিলে দুনিয়া ও আখেরাতে মহাকল্যাণ লাভের প্রচেষ্টা করি।

দয়াময় পরম দয়ালু সুমহান আল্লাহ আমাদের সমস্ত মানবজাতিকে তাঁর পবিত্র আল-কুরআন ও হাদীসের আলোকে প্রকৃত আদর্শবান মুসলমান হিসেবে কবুল করে নিজ নিজ প্রতিশ্রুতি পালনে সক্ষম করুন এবং তার বিনিময়ে আমাদের সকলকেই এ দুনিয়া ও আখেরাতে মহাকল্যাণ উপভোগ করার তাওফীক দান করুন। আমিন।

Related Post