মেষ পালক মুহাম্মদ (সা.)
মেষ চারণের সহিত পয়গম্বর জীবনের এক আশ্চর্য সম্পর্ক দেখতে পাওয়া যায়। প্রত্যেক নবীকে দিয়েই মহান আল্লাহ এ কাজটি করায়েছেন। এর একটি গূঢ় কার্যকরণ রহস্য আছে। উম্মুক্ত বিশাল ময়দানে এক পাল মেষের জন্য একজন মাত্র চালক। মেষদের চরিত্র হলো বক্র স্বভাবের, সহজে কমান্ড মানতে চায়না। একটি পালে নানা বয়সের মেষ থাকে। তদুপরী এরা শারিরীক গঠনেও দুর্বল, স্বজোরে আঘাত করা যায়না। এমন পরিস্থিতি সত্ত্বেও কোন মেষ যাতে বিপথগামী না হয়, হারিয়ে না যায়, অপরের ফসল নষ্ট না করে, সর্বপরী উপযুক্ত আহারের মাধ্যমে হৃষ্টপুষ্ট করে সন্ধ্যা বেলা প্রভূর ঘরে নির্বিঘ্নে ফিরে আসে, ইহাই থাকে একজন মেষ পালকের লক্ষ্য উদ্দেশ্য। নবী-রাসূলগণ ও ঠিক একটা জাতীর পরিচালক। মেষ পরিচালনার ক্ষেত্রে যে সকল পরিস্হিতির মোকাবেলা করতে হয়, নবীদের ও ঠিক তেমনিভাবে আল্লাহর বান্দাদের পিছনে থেকে তার চেয়েও বেশী সমস্যার মোকাবেলা করে সু-পথে পরিচালনা করতে হয়। তাদেরকে ইহকাল ও পরকালের খোরাক যোগায়ে পরিপুষ্ট অবস্হায় আল্লাহর ঘরে তথা জান্নাতে পৌঁছে দেয়াই তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ দায়িত্ব ও কর্তব্যকে বাস্তব রূপে উপলব্ধি করানোর জন্য নবীদের দিয়ে আল্লাহ পাক মেষ পরিচালনার কাজ করায়েছেন।
তরূণবয়সে মুহাম্মদ (সা.)
আর্তকে সেবাদান, পীড়িতকে সাহায্য, অত্যাচারীকে বাধা দেয়া, দেশের শান্তি শৃঙখলা রক্ষা করা এবং বিভিন্ন সমপ্রদায়ের মধ্যে মৈত্রী স্হাপন করা, ইহাইতো তরুণের ধর্ম। তরুণের এক হাতে থাকবে সেবা, প্রেম ও সংগঠনের উপাদান, অন্য হাতে থাকবে আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত। সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলকে সে বরণ করবে, আর সংগ্রাম করবে অসত্যের বিরুদ্ধে। তরুণকে আসতে হবে ফুলের মত সুন্দর হয়ে, ফলের অন্তহীন সম্ভাবনা নিয়ে। বাইরে সে হবে উচ্ছল লীলা চঞ্চল, কিন্তু ভিতরে সে হবে একজন সংযমী সাধক। আর এ সকল গুণের পূর্নাঙ্গ সমারোহ দেখতে পাই ১৭ বছর বয়সে তরুণ মুহাম্মদ (সঃ)-এর জীবনে।
ওকাজের মেলায় সংগঠিত তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। অন্যায়ভাবে এ যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল কোরেশদের ওপর। ইতিহাসে যা “হার্বে ফুজ্জার” তথা অন্যায় যুদ্ধ নামে খ্যাত। বাধ্য হয়েই রাসূল (সঃ) এ যুদ্ধে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। স্বক্রিয়ভাবে তিনি আক্রমন করেননী। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা এটাই তাঁর জীবনে প্রথম। সে যুগে আরবদের মধ্যে যে নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা লুকিয়ে ছিল তা তিনি স্বচক্ষে অবলোকন করেন। বিনা কারণে মানুষের প্রতি মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, এর আগে তাঁর জানা ছিলনা। তাইত তরুণ মুহাম্মদ (সঃ) কে ভাবিয়ে তুললো। যে করেই হোক এর অবসান করার একটা পথ বের করতেই হবে। যার ফলশ্রুতিতে তিনি আরবদের কতিপয় যুবকদের নিয়ে “হিল্ফুল্ ফুযূল” নামে একটি সেবা “সংঘ” গঠন করলেন। সমাজে শান্তি-শৃঙখলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে কর্মসূচী তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন সে গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল-
১. আমরা নিঃস্ব অসহায় ও দূর্গতদের সাহায্য করবো।
২. আমরা দেশ থেকে অশান্তি দূর করে দেশে শান্তি শৃঙখলা প্রতিষ্ঠিত করবো।
৩. পথিকের জান-মালের হেফাজত করবো।
৪. বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সমপ্রীতি স্থাপনের চেষ্টা করবো।
৫. কোনো জালেমকে মক্কায় আশ্রয় দেব না।
তরুণের কি সুন্দর ও শ্বাশত আদর্শই না আমরা এখানে দেখতে পাই। আজকের তরুণরা যদি এ আদর্শ নিয়ে আমাদের দেশ গড়ার জন্যে আত্মনিয়োগ করেন। তাহলেই আমাদের দেশে শান্তি-শৃঙখলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আশা করা যায়।
সাম্য-মৈত্রীর মূর্ত প্রতীক মুহাম্মদ (সা.)
তখন কা’বা ঘরটি নানা কারণে দিন দিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলো। তাই ঘরটি সংস্কারের জন্য আরবরা সম্মিলিত ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করে। কেউ যাতে বঞ্চিত না হয়, সেজন্যে আরবদের বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা কা’বা -ঘরের বিভিন্ন অংশ ভাগ করে নিলো। কিন্তু কা’বা ঘরের দেয়ালে যখন ‘হাজরে আসওয়াদ’ (পবিত্র কালো পাথর) বসানোর সময় এলো, তখন বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে তুমুল ঝগড়া বেঁধে গেলো। অবস্হা এতদূর পর্যন্ত গড়ালো যে, অনেকের তলোয়ার পর্যন্ত কোষমুক্ত হলো। চারদিন পর্যন্ত এ ঝগড়া চলতে থাকলো। পঞ্চম দিনে আবু উমাইয়া বিন মুগীরা প্রস্তাব করেন যে, আগামীকাল সকালে যে ব্যক্তি কা’বা – ঘরে সবার আগে হাজির হবে, এর মীমাংসার দায়িত্ব তাকেই দেয়া হবে। সে যা সিদ্ধান্ত দিবে, তা-ই পালন করা হবে। সবাই এ প্রস্তাব মেনে নিলো। পরদিন সকালে যার আগমন ঘটলো তিনি ছিলেন মুহাম্মদ (সঃ)। ফয়সালা অনুযায়ী তিনি ‘হাজরে আসওয়াদ’ স্হাপন করতে ইচ্ছুক প্রতিটি গোত্রের একজন করে প্রতিনিধি নিয়োগ করতে বললেন। অতঃপর একটি চাদর বিছিয়ে তিনি নিজ হাতে পাথরটিকে তার ওপর রাখলেন এবং বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধিগণকে চাদরের প্রান্ত ধরে পাথরটিকে ওপরে তুলতে বললেন। চাদরটি তার নির্দিষ্ট স্থান বরাবর পৌঁছলে তিনি পাথরটিকে যথা স্হানে নিজ হাতে স্থাপন করলেন। এতে সবাই খুশী হলেন এবং আসন্ন যুদ্ধের মহা বিপর্যয় থেকে জাতীকে রক্ষা করলেন। এখানে সাম্য-মৈত্রীর যে দৃষ্টান্ত তিনি স্হাপন করলেন, কিয়ামতের আগ পর্যন্ত তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমাদের সমাজপতিদের এখান থেকে শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু রয়েছে, যদি আমরা সত্যিকারে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাই, গড়তে চাই একটি আদর্শ সমাজ, যে সমাজে থাকবেনা জুলুম-নির্যাতন, বন্ধ হবে পরস্পর হিংসা বিদ্বেষ, মারামরি-হানাহানি, দূর হবে বর্ণ বৈষম্য। মনের ভিতর থাকবেনা কোন ভয়-ভীতি, আতঙ্ক, মানুষ হবে মানুষের জন্য। তাহলে কেবল রাসূল (সঃ)-এর আদর্শ পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সম্ভব।
উন্নত সংস্কৃতির ধারক মুহাম্মদ (সা.)
সংস্কার শব্দ থেকে সংস্কৃতির আবির্ভাব। মার্জিত পরিশীলিত মানসিকতাই সংস্কৃতি। শিক্ষা যেমন জাতীর মেরুদন্ড, তেমনি জাতীর উন্নত সংস্কৃতি তার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। যে জাতীর সংস্কৃতি যত উন্নত সে জাতির মর্যাদা ততো বেশী। একটি জাতীকে ধ্বংস করতে হলে যেমন তার শিক্ষা ব্যবস্থায় আঘাত হানতে হয়, ঠিক তেমনিভাবে কোন জাতীর কৃষ্টি কালচার ধ্বংস করতে পারলে, সে জাতীকে দুর্বল করা সহজ হয়। আজ আমরা বিদেশী অপসংস্কৃতি আমদানী করে, আমাদের জাতীকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছি।
অথচ মুহাম্মদ (সঃ) যে যুগে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, সে যুগে মূর্তি পূজার সবচেয়ে বড় কেন্দ্রস্হল পরিণত হয়েছিল মক্কায়। খোদ কা’বা ঘরের ভিতর এবং তার চার পাশেই ছিল ৩৬০টি মূর্তি। আর রাসূল (সঃ)-এর বংশের লোকেরাই ছিলো এর রক্ষক। তা সত্ত্বেও তিনি কোন দিন মূর্তির সামনে মাথা নত করেননি, অংশ গ্রহণ ও করেননী কোন মুশরিকী অনুষ্ঠানে। এছাড়া তাঁর বংশে যে সব খারাপ রুসুম রেওয়াজে অভ্যস্থ ছিল তাতে কোন দিন সাহায্য সহযোগিতাও করেননি। অত্যন্ত প্রত্যয়ের সাথে বলতে চাই যে, ওহীর জ্ঞান যে জাতীর নিকট সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত অবস্হায় সংরক্ষিত, একমাত্র তারাই সংস্কারের নির্ভেজাল উপাদানে সংস্কৃতির ভিত্তি রচনা করে জাতীর সম্মান বয়ে আনতে পারেন। আর যাদের কাছে সে জ্ঞান নেই তারাই চতুর্দিকে হাত বাড়ায় এবং জাতীকে টেনে নিয়ে যায় অন্ধকারের অতল গহ্বরে।
আল্-আমীন উপাধি
মুহাম্মদ (সঃ) পরিচালিত সেবা সংঘ (হিল্ফুল্ ফুযুল) বেশ ভালভাবেই চলতে লাগলো। তিনি প্রাণ পণে চেষ্টা করতে লাগলেন, কোথায় কোন অনাথ বালক ক্ষুধার জ্বালায় ক্রন্দন করছে, কোথায় কোন দুস্হ পীড়িত রুগ্ন ব্যক্তি আর্তনাদ করছে, কোথায় কোন বিধবা নারী নিরাশ্রয় হয়েছে, তিনি তা সন্ধান করতেন। এতিম শিশুকে তিনি কোলে নিয়ে আদর করতেন। কোথাও বা রোগীর পাসে বসে তার পরিচর্যা করতেন। প্রতিবেশীকে সাহায্য করার জন্য তিনি সদা প্রস্তুত থাকতেন। এমনি ভাবে তিনি মানব সেবায় ব্যস্ত থাকতেন। এই সেবা, ত্যাগ, ও মানব প্রীতি কি কখনও বৃথা যেতে পারে? সত্যিকার চেষ্টা ও নিঃস্বার্থ সেবা মানুষ কত দিন অস্বীকার করে চলবে? তাইতো আরবগণ দিন দিন মুহাম্মদ (সঃ)-এর প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলেন। মুহাম্মদ (সঃ) যে ভন্ড নন, এ বিশ্বাস সকলের মনে বদ্ধমূল হয়ে গেল। অবশেষে আরবগণ এক বাক্যে তাঁকে “ আল্-আমীন” উপাধি দান করলেন। নীতি ধর্ম বিবর্জিত, ঈর্ষা-বিদ্বেষ কলুষিত, পরশ্রী কাতর দুর্ধর্ষ আরবদের নিকট এতখানি সম্মান পাওয়া তখনকার দিনে সহজ সাধ্য ছিলনা। অনুপম চরিত্র আর মাধুর্য, সততা আন্তরিকতা, আমানত দারী, কথায় কাজে অপূর্ব সমন্বয় ও অকৃত্রিম মানব প্রেম ছিলো বলেই তাঁর পক্ষে এমনটা সম্ভব হয়েছিল। এখান থেকে আমরা এ সত্যই উপলব্ধি করলাম যে, ভবিষ্যৎ জীবনের সার্থকতা নির্ভর করে, বাল্য জীবনের চরিত্র ও মাধুর্যের উপর। আমাদের সম্মানিত অভিভাবকদের এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার অনেক কিছু রয়েছে। (চলবে…..)