আল্লাহ মুমিনদের রক্ষাকর্তা

ujala mosque-koran[1]বর্তমান বিশ্বে মুসলমানেরা খুবই নাজুক সময় পার করছি। সমগ্র বিশ্বে আজ ভয়ানক এক সঙ্কটের জালে জড়িয়ে পড়ছি। কোথাও তাদের আশ্রয় নেয়ার জায়গা নেই। সব ক’টি মুসলিম রাষ্ট্রের ওপর একের পর এক বিপদের ঘনঘটা বিস্তার লাভ করছে। সমগ্র বিশ্বে মুসলমানেরাই সবচেয়ে বেশি অপদস্থ ও অসহায়ত্বের শিকার। অপর দিকে কাফের মুশরিক ও নাস্তিকেরা সারা বিশ্বে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মুসলমানদের ওপর তারা বিভিন্নভাবে ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। অথচ কুরআনুল কারিমের একাধিক জায়গায় মুমিনদের সাহায্য, সহযোগিতা ও বিজয়ের স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে। যেমন সূরা রুমের ৪৭ নম্বর আয়াতে আছে, ‘মুমিনদের সাহায্য করা আমার দায়িত্ব ’। সূরা হজের ৩৮ নম্বর আয়াতে আছে, ‘আল্লাহ মুমিনদের রক্ষা করেন’। সূরা আনফালের ১৯ নম্বর আয়াতে আছে, ‘আল্লাহ মুমিনদের সাথে আছেন’। সূরা নিসার ১৪১ নম্বর আয়াতে আছে, ‘আল্লাহ কখনোই মুমিনদের বিরুদ্ধে কাফেরদের জন্য কোনো পথ রাখবেন না’। সূরা মুনাফিকুনের ৮ নম্বর আয়াতে আছে, ‘শক্তি তো আল্লাহর আর তাঁর রাসূল ও মুমিনদের’। এসব আয়াত দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের গায়েবিভাবে সাহায্য করবেন।।

অথচ আমরা দেখি বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে মুসলমানেরাই সবচেয়ে বেশি অপদস্ত ও লাঞ্ছনার শিকার। মুসলমানদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে কাফের, মুশরিক ও নাস্তিকরা একে একে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো দখল করছে। তাদের নগ্ন আগ্রাসনের শিকার হয়ে আফগানিস্তান হারিয়েছে আপন স্বকীয়তা, আর ইরাক হারিয়েছে তেল সম্পদের মূল্যবান ভাণ্ডার। এসব দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি জিম্মি হয়ে আছে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের হাতে। ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ইসলাম বিদ্বেষ এতটাই চরমে পৌঁছেছে যে, তারা মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করে, চলচ্চিত্র নির্মাণ করে রাসূল সা:-এর পবিত্র চরিত্রে কালিমা লিপ্ত করার মতো ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। প্রতিনিয়ত মুসলিম জনপদ কোনো-না-কোনো মজলুম মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। এই তো কিছু দিন আগে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে মজলুম রোহিঙ্গা মুসলমানের কান্নায় পৃথিবীর আকাশ-বাতাশ ভারী হয়ে উঠেছে। বৌদ্ধদের নির্মম নির্যাতনের শিকার এসব অসহায় মুসলিম প্রতিবেশী দেশেও আশ্রয় পায়নি। সে ভয়াবহ দাঙ্গায় বৌদ্ধদের পৈশাচিক নির্যাতনে সন্তানহারা হয়েছে অসংখ্য মা, স্বামী হারা হয়েছে অসংখ্য স্ত্রী, ভাই হারা হয়েছে অসংখ্য বোন। হত্যা করা হয়েছে কত নিষ্পাপ শিশুকে। আর ধর্ষণ করা হয়েছে অসংখ্য মা-বোনকে। মোট কথা দেশটির মুসলমানদের ওপর কিয়ামতের বিভীষিকা আপতিত হয়েছে। কিন্তু মজলুম মুসলমানের আহাজারি শোনার মতো কোনো মানবাধিকার সংস্থাকে তাদের পাশে পাওয়া যায়নি। রোহিঙ্গাদের দোষ বলতে একটাই ছিল, তারা মুসলমান। শুধু মুসলমান হওয়ার অপরাধেই এই নিরপরাধ নিরস্ত্র মুসলমানেরা নির্মম নির্যাতন-নিপীড়ন ও গণহত্যার শিকার হয়েছে। প্রশাসনিকভাবে তাদের ওপর পরিচালনা করা হয়েছে মর্মান্তিক নির্মূল অভিযান।

 আর বর্তমানে চলছে মিসরে মুসলিম গণহত্যা। মিসরে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ প্রমাণ করল তথাকথিত গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা ইসলাম ও মুসলমানের প্রশ্নে ‘আল কুফরু মিল্লাতুন ওয়াহিদা’-এর অবস্থান থেকে চুল পরিমাণও সরতে পারেনি। নিরস্ত্র ও নিরাশ্রয় মুসলমানদের ওপর পশ্চিমাদের মদদপুষ্ট তথাকথিত সেনাবাহিনী যেভাবে নারকীয় উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং রক্তের হলিখেলায় মেতে উঠল তাতে গণতন্ত্র যে শুধু মুখের বুলি তা আরো একবার প্রমাণিত হলো। মিসরের বাতাসে এখন শুধু লাশের গন্ধ। লাশ আর লাশ। সব কিছু হয়েছে গণতন্ত্রের দাবিদারদের চোখের সামনে তাদেরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে। একান্ত মানবিক কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানালেও সত্যিকার প্রতিকার চায়নি তারা। সে কারণেই অন্যান্য স্থানের মতো মিসরের গণহত্যার ক্ষেত্রে বিশ্বসম্প্রদায়ও এমনকি সন্ত্রাসবাদ দমনের অঘোষিত মোড়ল আমেরিকাও গভীর উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েই দায়িত্ব শেষ করে দিয়েছে। সুতরাং এ প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে, কেন মুসলমানেরা মজলুম হচ্ছে? কেন তারা লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার শিকার? তাহলে কি তারা মুমিন নয়? তারা কি পাক কুরআনের কৃত ওয়াদার আওতাভুক্ত নয়? আমরা যদি কুরআনকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করি তাহলে এ প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাই। আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালা প্রকৃত মুমিনদের বেশ কিছু গুণ ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। যেমন সূরা আনফালের ২ নম্বর আয়াতে আছে, ‘মুমিন তো তারাই যাদের অন্তর কম্পিত হয় যখন আল্লাহর নাম নেয়া হয়, আর যখন তাদের সামনে তার আয়াত পাঠ করা হয় তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা স্বীয় প্রতিপালকের ওপরই ভরসা করে। যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদেরকে যা দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে, তারাই হলো প্রকৃত ঈমানদার।’

 সূরা মুমিনুনের ১ নম্বর আয়াতে আছে, ‘মুমিনগণ কামিয়াব হয়ে গেছে, যারা নিজেদের নামাজে বিনম্র।’ সূরা তাওবার ৭১ নম্বর আয়াতে আছে, ‘ঈমানদার নর-নারী একে অপরের বন্ধু তারা সৎ কাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখে, নামাজ কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, তাদের ওপর আল্লাহ কৃপা করবেন।’ সূরা হুজুরাতের ১০ নম্বর আয়াতে আছে, ‘মুমিনগণ তো পর¯পর ভাই ভাই, অতএব তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মাঝে মীমাংসা করে দাও।’ সূরা হুজুরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে আছে, ‘তারাই ঈমানদার যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং তাদের জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে তারাই সত্যনিষ্ঠ।’ সূরা নূরের ৫১ নম্বর আয়াতে আছে, ‘ঈমানদারের উক্তি তো এই যে, যখন তাদের মাঝে ফয়সালা করে দেয়ার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে আহ্বান করা হয়, তখন তারা বলে আমরা শুনেছি এবং আদেশ মেনে নিয়েছি, আর তারাই সফলকাম।’

 এই আয়াতগুলোকে সামনে রেখে আমরা যদি চিন্তা করি এবং সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখতে পাই, প্রকৃত মুমিনের যেসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, তার কিঞ্চিত পরিমাণও আমাদের মাঝে নেই। আমরা নামাজ পড়ি অথচ নামাজে আমাদের মনোযোগ নেই। অন্তরে আল্লাহর জিকির নেই। আমাদের সমাজে প্রকাশ্যে অন্যায় অসৎ কাজ হচ্ছে, আমরা তার প্রতিবাদ করছি না। সৎ কাজে আদেশ অসৎ কাজে নিষেধ একদম ছেড়ে দিয়েছি। সুতরাং আমরা কুরআনের পরিভাষায় মুমিন কি না সেটাই বড় প্রশ্ন। ঈমান অর্থ যদি হয় কলেমা পাঠ করা এবং ইসলামের অল্প কিছু বিধান মেনে চলা হয়, তাহলে তো আমরা সবাই মুমিন। কিন্তু মুমিন অর্থ যদি হয় কুরআনে বর্ণিত বিশেষ গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন করা তাহলে সে অর্থে আমরা কতটুকু ঈমানদার হতে পেরেছি সেটাই এখন চিন্তার বিষয়। তবে এখানে এই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে, মুসলমানদের যত দোষই থাকুক তারা তো মুসলমান, ইহুদি-খ্রিষ্টানদের চেয়ে তো ভালো। তার পরও তারা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের হাতে নির্যাতিত হচ্ছে কেন?

 ইহুদি-খ্রিষ্টানেরা বিজয়ী, আর মুসলমানেরা পরাজিত কেন? এ প্রশ্নের উত্তর আরো সহজ। ইহুদি-খ্রিষ্টানেরা সৃষ্টির বিষয়ে আল্লাহ তায়ালার অনুসৃত রীতিনীতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করছে এবং সে অনুযায়ী কাজ করছে। অপর দিকে মুসলমানেরা তা সম্পূর্ণ ভুলে গেছে। ইহুদি-খ্রিষ্টানদের পুরো জাতি বিজয়ের জন্য ঘাম ঝরাচ্ছে আর মুসলমানেরা অলস ঘুমে বিভোর। ইহুদি-খ্রিষ্টানেরা শিক্ষা-দীক্ষায় নিয়োজিত আর মুসলমানেরা মূর্খতার গ্লানি বহন করে বেড়াচ্ছে। ইহুদি-খ্রিষ্টানেরা যেখানে আগামীকালের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছে সেখানে মুসলমানেরা আজকের করণীয় সম্পর্কে উদাসীন। জয়-পরাজয় ও উন্নতি-অধোগতির ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান কারো প্রতি অবিচার করে না। কোনো জাতির পক্ষপাতিত্বও করে না। এটা ইসলামেরই শিক্ষা। কিন্তু মুসলমানেরা কেন জানি এই শিক্ষা গ্রহণ করতে বা বুঝতে নারাজ। উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের একটি ভুল চিন্তার খেসারত দিতে হয়েছে ৭০ জন বীর মুজাহিদের জীবন দানের মাধ্যমে। তাদের মধ্যে ছিলেন রাসূল সা:-এর পিতৃব্য হজরত হামজা রা:, হজরত আনাস বিন নজর রা:, হজরত মুসআব বিন উমায়ের রা:, সা’দ ইবনুর রবি রা:-এর মতো শীর্ষস্থানীয় মুজাহিদ। তারা স্বয়ং রাসূল সা:-এর নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু এই সৌভাগ্যের কারণে তাদের বিজয় আসেনি বা এই অজুহাতেও বিপর্যয় বন্ধ থাকেনি, তাদের প্রতিপক্ষ ছিল কাফের ও মুশরিক। বোঝা গেল পরাজয়ের পথ অবলম্বন করলে মুসলমান হলেও পরাজিত হবেই। আর বিজয়ের পথে হাঁটলে ইহুদি-খ্রিষ্টান হয়েও বিজয়ী হতে পারে। ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটুকু মুসলমানেরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবে ততই তাদের জন্য কল্যাণ হবে। উহুদ যুদ্ধে মুসলমানেরা পরাজয়ের পথ অবলম্বন করার কারণেই পরাজিত হয়েছে।

আল কুরআন বলছে, ‘এটা তাদের হাতের কামাই’। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কী ব্যাপার! যখন তোমাদের ওপর একটি বিপদ এলো তখন তোমরা বললে এটা কোথা থেকে এলো? অথচ তোমরা তো দ্বিগুণ বিপদে পড়ছিলে। অতএব বলে দাও এ বিপদ তোমাদের ওপর এসেছে তোমাদেরই পক্ষ থেকে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান’ (সূরা আলে ইমরান, ১৬৫)। মুসলমানদের সরলতাকে পুঁজি করে ইহুদি-খ্রিষ্টান চক্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে সর্বগ্রাসী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সুতরাং সরলতা নয়, পূর্ণ সতর্ক থাকতে হবে। আল কুরআন মুসলমানদের সরলতার পরিচয় দেয়ার পাশাপাশি সতর্ক থাকতে, অশ্রুবিসর্জন দেয়ার সাথে সাথে শত্রু মোকাবেলায় শক্তি সঞ্চয় ও প্রস্তুতি গ্রহণ করার কথাও বলেছে। ‘হে মুমিনগণ সতর্কতা অবলম্বন কর, এরপর পৃথক পৃথক সৈন্যদলে কিংবা সমবেতভাবে বেরিয়ে পড়ো’ (সূরা নিসা-৭১)। কুরআনে আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘কাফেররা চায় যে, তোমরা অস্ত্রশস্ত্র আসবাবপত্র সম্বন্ধে অসতর্ক হও, তাহলে তারা তোমাদের ওপর একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।’ অন্য আয়াতে আছে, ‘তোমরা তাদের প্রতিরোধের জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী তৈরি রাখবে, এর দ্বারা সন্ত্রস্ত্র করবে আল্লাহর শত্রুকে এবং তোমাদের শত্রুকে’ (সূরা আনফাল-৬০)= সমাপ্ত=

Related Post