মুমিনদের অভিভাবক আল্লাহই

imagesCAOO8P2Uআল্লাহ তায়ালার অনেকগুলো গুণবাচক নামের মধ্যে একটি বিশেষ গুণবাচক নাম হলো  ‘আল ওয়াকিল অর্থাৎ ‘অভিভাবক’, ‘তত্ত্বাবধায়ক’, ‘ব্যবস্থাপক’, ‘মহাপ্রতিনিধি’। বিশ্বস্ততা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও ভরসার ভিত্তিস্বরূপ যার ওপর নির্ভর করা যায়। নিজের যাবতীয় বিষয় যার হাতে সোপর্দ করে দেয়া যায়। পথনির্দেশনা ও সাহায্য লাভ করার জন্য যার দিকে রুজু করা যায়। আল্লাহ বলেন, ‘আমি ইতঃপূর্বে মুসাকে কিতাব দিয়েছিলাম এবং তাকে বনি ইসরাইলের জন্য পথনির্দেশনার মাধ্যম করেছিলাম এ তাকিদ সহকারে যে, আমাকে ছাড়া আর কাউকে নিজের অভিভাবক করো না।

(সূরা বনি ইসরাইল: ২)।

 হজরত মুসা আ:-এর শিশুকাল থেকে নিয়ে তার নবুওয়াতি জিন্দেগি ও পারিবারিক জিন্দেগির পুরোটাই ছিল আল্লাহ তায়ালার বিশেষ গুণ মহা তত্ত্বাবধায়ক ও মহা অভিভাবকের উজ্জ্বল প্রতিফলন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা তাদের আওলাদ যাদেরকে আমি নুহের সাথে নৌকায় উঠিয়েছিলাম এবং নুহ একজন কৃতজ্ঞ বান্দা ছিল।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৩)। অর্থাৎ নুহ ও তার সাথীদের বংশধর হওয়ার কারণে একমাত্র আল্লাহকেই অভিভাবক করা তোমাদের জন্য শোভা পায়। কারণ তোমরা যার বংশধর তিনি আল্লাহকে নিজের অভিভাবক করার বদৌলতেই মহাপ্লাবনের মহাধ্বংসের হাত থেকে রা পেয়েছিলেন। মুহাম্মদ সা:-এর ৬৩ বছরের পুরো জিন্দেগি ছিল মহা অভিভাবকের উজ্জ্বল নিদর্শন।আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘আর যাদেরকে লোকেরা বলল তোমাদের বিরুদ্ধে বিরাট সেনাসমাবেশ ঘটেছে। তাদেরকে ভয় করো। তা শুনে তাদের ঈমান আরো বেড়ে গেছে এবং তারা জবাবে বলেছে আমাদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট এবং তিনি সবচেয়ে ভালো তত্ত্বাবধায়ক।’ সূরা আলে ইমরান : ১৭৩।

এই তো আল্লাহ তোমাদের রব! তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। সব কিছুর তিনিই স্রষ্টা। কাজেই তাঁর বন্দিগি করো। তিনি সব কিছুর তত্ত্বাবধায়ক।’ সূরা আনয়াম : ১০২। ওহুদ থেকে ফেরার পথে আবু সুফিয়ান মুসলমানদের চ্যালেঞ্জ দিয়ে গিয়েছিল, আগামী বছর বদর প্রান্তরে আমাদের সাথে তোমাদের আবার মোকাবেলা হবে। কিন্তু নির্ধারিত সময় এগিয়ে এলে আর তার সাহসে কুলালো না। তাই সে মান বাঁচানোর জন্য একটি কৌশল অবলম্বন করল। গোপনে এক ব্যক্তিকে মদিনায় পাঠিয়ে দিলো। সে মদিনায় পৌঁছে মুসলমানদের মধ্যে এ খবর ছড়াতে লাগল যে, এ বছর কুরাইশরা বিরাট প্রস্তুতি নিয়েছে। তারা এত বড় সেনাবাহিনী তৈরি করছে, যার মোকাবেলা করার সাধ্য আরবের কারো নেই। এ ঘোষণার পর রাসূল সা:-এর দৃঢ়তায় মুসলমানদের ঈমান আরো বেড়ে গেল। পনেরো শ’ প্রাণ উৎসর্গকারী মুজাহিদ বদরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। তারা বলে উঠলেন আমাদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট এবং তিনি সবচেয়ে ভালো তত্ত্বাবধায়ক। ঠিকই নবী আকরাম সা: তাদের নিয়ে বদরে হাজির হলেন। ওদিকে আবু সুফিয়ান দুই হাজার সৈন্য নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকল। কিন্তু দুই দিন পথচলার পর সে সাথীদের বলল, ‘এ বছর যুদ্ধ করা সঙ্গত হবে না। আগামী বছর আমরা আসব।’ কাজেই নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে সে ফিরে গেল। নবী সা: আট দিন বদর প্রান্তরে অপো করলেন। কাফিররা ফিরে গেছে এ খবর পাওয়ার পর তিনি সাথীদের নিয়ে মদিনায় ফিরে আসেন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কাজেই হে নবী এমন যেন না হয়, তোমার প্রতি যে জিনিসের ওহি করা হচ্ছে তুমি তার মধ্য থেকে কোন জিনিস বাদ দেবে এবং এ কথায় তোমার মন সঙ্কুচিত হবে এ জন্য যে, তারা বলবে এ ব্যক্তির ওপর কোনো ধনভাণ্ডার অবতীর্ণ হয়নি কেন অথবা এর সাথে কোনো ফেরেশতা আসেনি কেন? তুমি নিছক সতর্ককারী। এরপর আল্লাহই সব কাজের ব্যবস্থাপক।’ সূরা হুদ : ১২।

এ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহই সব কাজের ব্যবস্থাপক।’ আল্লাহর এ গুণবাচক নামটির মতা ও মহানত্ব অনুধাবন করার জন্য পুরো আয়াতটির বক্তব্য বুঝতে হবে। মক্কা এমন একটি গোত্রের কেন্দ্রভূমি যার ধর্মীয় কর্তৃত্ব এবং আর্থিক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক মতার দাপট সমগ্র আরবের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ গোত্রটি যখন অগ্রগতির সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছে, ঠিক তখনই সেই জনপদের এক ব্যক্তি উঠে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, তোমরা যে ধর্মের পৌরহিত্য করছো তা পরিপূর্ণ গোমরাহি ছাড়া আর কিছু নয়। এহেন অবস্থায় এ কথা বলার ফলে জনপদের কিছু অত্যন্ত সুস্থ বুদ্ধি-বিবেকসম্পন্ন এবং সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি ছাড়া বাদবাকি সব লোকই যে তার বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটাই স্বাভাবিক, এর পরিণতি এ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।

কেউ জুলুম-নির্যাতনের সাহায্যে তাকে দাবিয়ে দিতে চায়। কেউ মিথ্যা দোষারোপ এবং আজেবাজে প্রশ্ন-আপত্তি ইত্যাদি উত্থাপন করে তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। কেউ বিদ্বেষমূলক বিরূপ আচরণের মাধ্যমে তার সাহস ও হিম্মত গুড়িয়ে দিতে চায়। আবার কেউ ঠাট্রা-তামাশা, পরিহাস, ব্যঙ্গ-বিদ্রপ ও অশ্লীল-কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে তার কথাকে গুরুত্বহীন করে দিতে চায়। এভাবে কয়েক বছর ধরে এ ব্যক্তির দাওয়াতকে মোকাবেলা করা হতে থাকে। এ মোকাবেলা যে কত হৃদয়বিদারক ও হতাশাব্যঞ্জক হতে পারে তা সুস্পষ্ট করে বলার প্রয়োজন নেই। এরূপ পরিস্থিতিতে আল্লাহ তার নবীর হিম্মত অটুট রাখার জন্য তাকে উপদেশ দিয়ে বলেছেন, ভালো ও অনুকূল অবস্থায় আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠা এবং খারাপ ও প্রতিকূল অবস্থায় হতাশ হয়ে পড়া মূলত নীচ ও হীনম্মন্য লোকদের কাজ। আল্লাহর দৃষ্টিতে যে ব্যক্তি নিজে সৎ হয় এবং সততার পথে ধৈর্য, দৃঢ়তা ও অবিচলতার সাথে অগ্রসর হয় সে-ই আসলে মর্যাদার অধিকারী। কাজেই যে ধরনের বিদ্বেষ, বিরূপ ব্যবহার, ব্যঙ্গ-বিদ্রপ ও মূর্খজনোচিত আচরণ দ্বারা যে মোকাবেলা করা হয়, তার ফলে যেন রাসূলের দৃঢ়তা ও অবিচলতায় ফাটল না ধরে এবং ওহির মাধ্যমে তার সামনে যে মহাসত্যের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়েছে তার প্রকাশ ও ঘোষণায় যেন তিনি একটু কুণ্ঠিত ও ভীত না হন। যারা আল্লাহ তায়ালাকে একমাত্র উকিল হিসেবে তাঁর ওপর নির্ভরশীল হয়, কেউ মানুক বা না মানুক যা সত্য মনে করবে নির্দ্বিধায় ও নির্ভয়ে এবং কোনো প্রকার কম-বেশি না করে তা বলে যেতে থাকবে, পরিণাম আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দেবে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর প্রতি নির্ভর করো। কর্মসম্পাদনের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সূরা আহজাব : ৩)। এ বাক্যে নবী সা:-কে সম্বোধন করা হয়েছে। তাঁকে এই মর্মে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, তোমার ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে; আল্লাহর প্রতি পূর্ণ নির্ভর করে তা সম্পন্ন করো এবং সারা দুনিয়ার মানুষ যদি বিরোধিতায় এগিয়ে আসে তাহলেও তার পরোয়া করো না। মানুষ যখন নিশ্চিতভাবে জানবে অমুক হুকুমটি আল্লাহ দিয়েছেন তখন সেটি পালন করার মধ্যেই কল্যাণ নিহিত রয়েছে বলে তার পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়া উচিত। এরপর তার মধ্যে কল্যাণ, সুবিধা ও প্রজ্ঞা খুঁজে বেড়ানো সেই ব্যক্তির নিজের কাজ নয়, বরং কাজ হওয়া উচিত শুধু আল্লাহর প্রতি নির্ভর করে তাঁর হুকুম পালন করা। বান্দা তার যাবতীয় বিষয় আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দেবে, তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি পথ দেখানোর জন্যও যথেষ্ট এবং সাহায্য করার জন্যও। আর তিনিই এ বিষয়ের নিশ্চয়তাও দেন যে, তাঁর পথনির্দেশের আলোকে কার্য সম্পাদনকারী ব্যক্তি কখনো অশুভ ফলাফলের সম্মুখীন হবে না।

আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা ঈমানেরই অংশ। যারা পূর্ণ ঈমানদার তারা আল্লাহর ওপরই ভরসা করেন। হজরত ইয়াকুব আ: সন্তান ইউসুফ আ:-কে হারিয়ে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় ছিলেন। এমন সময় তার আরেক প্রিয় সন্তান বিন ইয়ামিনকে মিসরে বাদশাহর দরবারে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার সন্তানেরা চাপ দিলে তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলেন এবং তাদেরকে কিছু পরামর্শ দিলেন এবং বললেন, যা আল কুরআনে তার বক্তব্যকে আল্লাহ হুবহু উল্লেখ করেছেন ‘তারপর সে (ইয়াকুব আ:) বলল হে আমার সন্তানেরা! মিসরের রাজধানীতে এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করো না বরং বিভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করো। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা থেকে আমি তোমাদের বাঁচাতে পারি না। তাঁর ছাড়া আর কারো হুকুম চলে না, তাঁর ওপরই আমি ভরসা করি এবং যার ভরসা করতে হয় তাঁর ওপরই করতে হবে।’ সূরা ইউসুফ : ৬৭। ইউসুফের পর তার ভাইকে পাঠানোর সময় ইয়াকুব আ:-এর মন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তবুও আল্লাহর প্রতি আস্থা এবং সবর ও আত্মসমর্পণের দিক দিয়েও তার স্থান অনেক উঁচুতে থাকায় তিনি এই সন্তানটিকেও তাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন।

আল্লাহর দ্বীনের কাজ করতে উদ্যত কোনো ব্যক্তির হিম্মত বৃদ্ধি ও সাহস জোগানোর জন্য এর চেয়ে বড় পন্থা বা উপায় আর কী হতে পারে। আল্লাহর প্রতি ভরসা, তাঁর অভিভাবকত্ব, তাঁর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের নকশা যে ব্যক্তির হৃদয়-মনে খোদিত সে আল্লাহর জন্য একাই গোটা দুনিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সামান্যতম দ্বিধাদ্বন্দ্বও অনুভব করবে না।

Related Post