মুসলিম স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হবে

 মুসলিম স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হবে

মুসলিম স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হবে

মুসলিম স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হবে

৫ম পর্ব

সোনালী নীড়ের গত পর্বে আমরা পুত্রবধূর ওপর ছেলের বাবা-মায়ের অসন্তোষজনিত জটিলতার ক্ষেত্রে স্বামীর কর্তব্য নিয়ে বথা বলেছি। এবারের পর্বে আমরা মেয়ের সংসারে ছেলের শ্বাশুড়ীর নাক গলানো সংক্রান্ত জটিলতায় স্বামীর করণীয় সম্পর্কে কথা বলার চেষ্টা করবো।
ইংরেজীতে একটি প্রবাদ আছে To Err Is Human অর্থাৎ মানুষ মাত্রই ভুল আছে। সত্যিই তাই, আল্লাহ নিজেই যাদেরকে পাপ থেকে মুক্ত রাখবার ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁরা ব্যতীত অন্য কেউই ভুলের উর্ধ্বে নয়। ফলে বাপের বাড়ীতে স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠা যে মেয়েটি হঠৎ বধূ হয়ে অচেনা একটা পরিবেশে এলো, সে যে ছোট-খাটো ভুল-ত্রুটি করে বসতেই পারে, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। নববধূটি সাধারণত: যে ভুলগুলো করে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-(১) স্বামীর সাথে রূঢ় আচরণ করা। (২) স্বামীর ইচ্ছার বিরূদ্ধে কিছু করে বসা এবং (৩) বেখেয়ালীপনাবশত স্বামীর আর্থিক ক্ষতি ঘটাবার মতো কোন আচরণ করা ইত্যাদি।
কোন স্ত্রীই সাধারণত প্রথম প্রথম স্বামীর সাথে রূঢ় আচরণ করে না। অবশ্য দু একটি ঘটনা ব্যতিক্রম থাকতেই পারে। ধীরে ধীরে স্ত্রীদের অনেকেই রূঢ় আচরণ করতে প্রলুদ্ধ হয়। এর কারণ অনেক সময় স্ত্রীদের মা অর্থাৎ ছেলের শ্বাশুড়ী। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা না করলে ভুল বোঝাবুঝির কারণ হতে পারে। আমরা বলছি না যে, ছেলেদের শ্বাশুড়ীরা সবাই একইরকম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তবে মেয়ের বিয়ে দেবার পরপর মেয়ের মা স্বাভাবিকভাবেই কামনা করে যে, তার জামাই হবে তারই মন মতো একটা আদর্শ ছেলে। কিন্তু সমস্যা হলো প্রতিটি মানুষই মূলত স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। ফলে আপন-আপন স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেই শ্রদ্ধা-সম্মানের ভিত্তিতে জামাই-শ্বাশুড়ী সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। কিন্তু শ্বাশুড়ী যখন দেখে যে জামাইর চালচলন একটু অন্য রকম, তখন শ্বাশুড়ী জামাইকে নিজের আদর্শে গড়ে তোলার চেষ্টা চালায়। এ ধরণের চেষ্টা প্রথম দিকে মেয়ের কল্যাণেই মূলত হয়ে থাকে। কিন্তু পরক্ষণে জামাই যখন তার ব্যক্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্যে অটল থাকে, তখন শ্বাশুড়ী মেয়েকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে জামাই সংশোধন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। এভাবে ছেলের শ্বাশুড়ী, মেয়ের সংসারে এবং জীবনে আস্তে আস্তে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। শ্বাশুড়ীর পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে জামাতার ওপর মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। আর এই ক্ষিপ্ততার প্রয়োগ ঘটানো হয় মেয়েকে দিয়ে। মেয়ে তাই ধীরে ধীরে তার স্বামীর সাথে একটু অন্যরকম আচরণ শুরু করে দেয়। স্বামী যে ধরনের আচরণ তার স্ত্রীর কাছ থেকে প্রত্যাশা করে, স্ত্রী সেরকম আচরণ না করে কেমন যেন বিগড়ে যেতে থাকে। এমনকি স্বামীর কোন কোন কর্মকান্ডের সমালোচনায় মুখরও হয়ে ওঠে। মেয়েকে রীতিমতো শ্বাশুড়ী বিভিন্ন রকম নির্দেশ দিতে শুরু করে, আর মেয়েও আগ-পর চিন্তা না করে মায়ের আদেশ-নির্দেশকে অনুসরণ করতে শুরু করে। এমনকি স্বামীকে তার আচার-আচরণ পরিবর্তন করার জন্য বলতে শুরু করে। মা-মেয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত দৃঢ়। এই সম্পর্ক স্বভাবগত, প্রকৃতিগত । বছরের পর বছর ধরে যে মেয়ে তার মায়ের একান্ত আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বড়ো হয়েছে, স্বামীর তুলনায় মা-ই মেয়ের কাছে বেশী আপন বলে মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। সেজন্যে মায়ের আদেশ শিরোধার্য করে মেয়ে তার স্বামীর সাথে দুর্ব্যবহার করতেও দ্বিধা করে না। অন্যদিকে জামাই যখন শ্বাশুড়ীর মনোপুত: হয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়, তখন শ্বাশুড়ী মেয়ের জামাতার ব্যাপারে কঠোর মনোভাব পোষণ করতে শুরু করে। ফলে দাম্পত্য জীবনে নেমে আসে মহা-অসন্তোষ, দ্বন্দ্ব-কলহ। যার পরিণতি হয় বিবাহ বিচ্ছেদ, অথবা চির অশান্তি। স্বামীর সাথে এভাবেই স্ত্রী রূঢ় আচরণ করতে শুরু করে। এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তাহলো, শ্বাশুড়ীর সাথে জামাতার সম্পর্ক মানেই যে বৈরী সম্পর্ক এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। বরং সম্পর্কটা সাধারণত এর বিপরীত অর্থাৎ শ্বাশুড়ীর সাথে জামাইর সম্পর্ক খুবই আন্তরিক ও শ্রদ্ধা-স্নেহের। মেয়ের মঙ্গল কামনা থেকেই মূলত: শ্বাশুড়ীরা মেয়ের সংসারে প্রভাব বা হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে। কিন্তু অজ্ঞতাবশত: অনেক সময় হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্যে শ্বাশুড়ীদের ব্যাপারে পুরুষদের অতিরিক্ত সমালোচনার মনোভাব পরিহার করে চলাই শ্রেয়। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে শ্বাশুড়ীরা খুবই ভালো প্রকৃতিরও হয়ে থাকেন। এক ভদ্রলোক বলেছেন, তাঁর ভাষায় “আমার শ্বাশুড়ী যেন সাক্ষাৎ দেবী। তিনি যেমন দয়াবতী, তেমনি সবকিছু ভালোমত বুঝতেও পারেন। তাই আমি তাকে মায়ের মতোই ভালোবাসি। আমাদের সমস্যায় তিনি সবসময় আমাদের পাশে থাকেন। তার অস্তিত্ব যেন আমার পরিবারের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য এক নিশ্চয়তা স্বরূপ।”
তাই বলা যায়, শ্বাশুড়ী মাত্রই খারাপ নয় এবং শ্বাশুড়ীই মেয়ের সংসারে জটিলতা সৃষ্টির একমাত্র কারণ নয়। আরো অনেক কারণেও সংসারে সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেজন্যে শ্বাশুড়ীর সাথে বা শ্বশুর বাড়ীর সাথে সমস্যা এড়িয়ে চলার জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হলো শ্বশুর পক্ষীয় আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা। আসলে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই পরস্পরের বাবা-মা, ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা। এতে উভয়েরই কল্যাণ নিহিত রয়েছে। শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর সামনে কখনোই তাদের মেয়ের সমালোচনা করা উচিত নয়। বরং তাদের কন্যার প্রতি জামাতার ভীষণ ভালোবাসার দিকটিই ফুটিয়ে তোলা উচিত। মেয়ের বাবা-মাও কিন্তু অভিভাবক। ফলে নিজের বাবা-মায়ের মতো স্ত্রীর বাবা-মায়ের কাছেও অভিভাবকসুলভ পরামর্শ গ্রহণ করে সংসার জীবনে তা কাজে লাগানো যেতে পারে। স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েরই উচিত আপন-আপন শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর সাথেই কেবল নয় বরং শ্বশুর বাড়ীর সবার সাথেই সহৃদয় আচরণ করা। এর ফলে দাম্পত্য জীবনে সুখ-শান্তি ও সাফল্য নেমে আসবে। নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, “সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্যসমূহ যা আমার উম্মতকে বেহেশতে প্রবেশ করাবে তা হচ্ছে আল্লাহর ভয় ও উত্তম আচরণ।” ইমাম আলী (আঃ) বলেছেন, সদাচরণ প্রচুর পরিমাণে জীবনোপকরণ দান করে এবং বন্ধুত্বের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাকে বাড়িয়ে দেয়। তিনি আরো বলেছেন, বন্ধুত্ব গড়ে তোলা হলো জ্ঞানীর মতো কাজ। ফলে প্রতিটি মানুষের উচিত সর্বাবস্থায় উত্তম আচরণ করা।

সুখ-শান্তির মূল ভিত্তি হলো উত্তম আচরণ। তাই সদাচরণের অভ্যাস গড়ে তোলা শান্তিকামী প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সদাচরণের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে রাসূল (সাঃ)কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আপনি যদি কঠোর ও নির্মম হতেন তাহলে তারা নিশ্চিতরূপে আপনার চারপাশ থেকে সরে যেত। অন্যত্র বলেছেন, রাসূল (সাঃ)এর মধ্যেই রয়েছে, সর্বোত্তম চরিত্রের আদর্শ। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের উচিত হবে রাসূলের আদর্শকে অনুসরণ করা । পারিবারিক সুখ-শান্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও তার অনুসরণের কোন বিকল্প নেই।

প্রথম পর্ব এখানে  দ্বিতীয় পর্ব এখানে তৃতীয় পর্ব এখানে চতুর্থ পর্ব এখানে

Related Post