প্রতিবেশীর অধিকার

11111111111111111111111111111111111111111111প্রতিবেশী মূলত বাড়ির আশে পাশে বসবাসকারীকে বলা হয়। কখনও কখনও সফর অথবা কাজের সঙ্গীকে ও প্রতিবেশী বলা হয়। প্রতিবেশীই হচ্ছে মানুষের সবচে নিকট জন , যিনি তার খবরা-খবর সম্পর্কে অন্যদের তুলনায় বেশি জানেন। ইসলামী শরীয়তে প্রতিবেশীর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে এবং তার অধিকারকে খুব বড় করে দেখেছে। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন― উপাসনা কর আল্লাহর, শরীক করো না তাঁর সাথে অপর কাউকে। পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং সদয় ব্যবহার কর নিকটাত্মীয়, এতীম- মিসকীন, এবং আত্মীয়-সম্পর্কীয় প্রতিবেশী, আত্মীয়তা বিহীন প্রতিবেশী ও পার্শ্ববর্তী সহচরদের সাথে, এবং অসহায় মুসাফিরের সাথে । (নিসা: ৩৬)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :―

জিবরাঈল আলাইহিস সালাম আমাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে অনবরত অসীয়ত করছিলেন,যে এক পর্যায়ে আমার ধারণা হয়েছিল যে, আল্লাহ তাআলা প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকারী করে দেবেন। ( বোখারি : ৫৫৫৫)

শরীয়ত প্রতিবেশীকে এত অধিক গুরুত্ব দেওয়ার কারণ সম্ভবত এই হতে পারে

 (১) যাতে করে মুসলমানদের মাঝে ভালোবাসা এবং মমত্ববোধের প্রসার ঘটে, এর জন্য সর্বোত্তম মানুষ হল  প্রতিবেশী।  

(২)  প্রতিবেশী সকলের চেয়ে অধিক সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার দাবী রাখে, কারণ প্রতিবেশীই তার অতি নিকটে বসবাস করে এবং সে তার যাবতীয় সমস্যা ও সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে অন্যদের চেয়ে বেশি জানে। 

(৩)  যাতে মুসলমানের নিজ জীবন, সন্তান,পরিবার এবং সম্পদের নিরাপত্তা লাভ হয় ।

প্রতিবেশী কারা ?

যাদের সম্পর্কে কুরআন হাদিসে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে, সেটি নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে উলামাদের বিভিন্ন মতামত রয়েছে। কেউ বলেছেন: প্রতিবেশীর সীমানা হল, চতুর দিক দিয়ে চল্লিশ ঘর, কেউ বলেন: যে তোমার সাথে ফজর পড়ল সেই তোমার প্রতিবেশী, ইত্যাদি। আর এই সমস্ত কথার মনে হয় কোন গ্রহণযোগ্য প্রমাণ নেই । সর্বোত্তম এবং সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মতামত হচ্ছে ―প্রতিবেশী সে-ই, তার বাড়ির কাছাকাছি যার বাড়ি। এবং যার বাড়ির সাথে তার বাড়ি মেলানো। সীমানা নির্ধারিত হবে প্রচলিত ধারা অনুযায়ী, যে ব্যক্তি মানুষের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী প্রতিবেশী, সেই প্রতিবেশী। আর এটা এই জন্য যে, শরীয়ত যে সমস্ত নামের উল্লেখ করেছে এবং তার অর্থ নির্ধারণ করে দেয়নি, তার অর্থ জানার জন্য সঠিক প্রচলিত রীতির দিকেই প্রত্যাবর্তন করতে হয়।

প্রতিবেশীর গুরুত্বের ভিন্নতা আসবে নিকটবর্তী এবং দূরবতী প্রতিবেশী হওয়ার দিক বিবেচনায়। নিকটবর্তী প্রতিবেশী কল্যাণ এবং সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে দূরবর্তী প্রতিবেশীর চেয়ে অধিক গুরুত্ব পাবে, এর প্রমাণ হল: আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা প্রশ্ন করেছিলেন― তিনি বলেন : আমার দুইজন প্রতিবেশী আছে। তাদের মধ্য থেকে কাকে আমি উপঢৌকন দেব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: তোমার দরজার অধিক নিকটবর্তী জনকে।  (বুখারী : ২০৯৯)

তাদের শ্রেণী ও মর্যাদার বিভিন্নতার কারণেও গুরুত্বে ভিন্নতা আসবে:

(১) এক ধরনের প্রতিবেশী আছে যার অধিকার হচ্ছে তিনটি, তিনি হলেন নিকটাত্মীয়-মুসলমান প্রতিবেশী। তার অধিকার তিনটি হচ্ছে: আত্মীয়তা, ইসলাম এবং প্রতিবেশিত্ব।

(২) আরেক প্রকার প্রতিবেশী যার অধিকার দুইটি: তিনি হলেন অনাত্মীয় মুসলিম প্রতিবেশী, তার অধিকার দু’টি হচ্ছে: প্রতিবেশিত্ব ও ইসলাম ।

(৩) আর এক ধরনের প্রতিবেশী, যার অধিকার মাত্র একটি, তিনি হলেন অমুসলিম প্রতিবেশী, তার অধিকার শুধু প্রতিবেশিত্বের।

 

প্রতিবেশী নির্বাচনের গুরুত্ব :

মুসলমানের কর্তব্য হল সব সময় সৎ প্রতিবেশী বেছে নেয়ার দিকে দৃষ্টি দেবে, যে তার অধিকারগুলো আদায় করবে, এবং তাকে কষ্ট দেবে না, তার হেফাজত করবে এবং তাকে সব কাজে সাহায্য করবে, মানুষ বলে;  বাড়ি বানানোর পূর্বে প্রতিবেশী নির্বাচন করা, প্রকৃত পক্ষে এটাই সঠিক জিনিস। এর সপক্ষে পবিত্র কুরআন শরিফের ঐ আয়াত পেশ করা যেতে পারে। যেখানে আল্লাহ তা’আলা ফেরআউনের স্ত্রী সম্পর্কে বলেছেন :―  

হে আমার পালনকর্তা, আপনার সন্নিকটে জান্নাতে আমার জন্য একটি গৃহ নির্মাণ করুন। (তাহরিম: ১১) সঠিক প্রতিবেশী নির্বাচন করার গুরুত্ব একথা জানা থাকার মাধ্যমেও স্পষ্ট হয় যে, প্রতিবেশী তার প্রতিবেশী এবং সন্তানদের মাঝে প্রভাব বিস্তার করে, পরস্পর মেলা-মেশার কারণে, সে যদি সৎ হয়, তা হলে প্রতিবেশী তার ঘর এবং পরিবারের ব্যাপারে নিরাপদ হয়ে যায়। আর যদি অসৎ হয়, তাহলে সে নিরাপদ হতে পারে না। ভাল প্রতিবেশী তার প্রতিবেশীর গোপন বিষয় অবহিত হলে গোপন রাখে। অসৎ প্রতিবেশী বরং সেটিকে প্রকাশ এবং প্রচার করে বেড়ায়। ভাল প্রতিবেশী ভাল কাজে সাহায্য করে, তাকে সৎ উপদেশ দেয়। অসৎ প্রতিবেশী ধোঁকা দিয়ে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে।

প্রতিবেশীর অধিকারসমূহ:  প্রতিবেশীর অনেক অধিকার রয়েছে তার মধ্য থেকে নিম্নে কিছু উল্লেখ করা হল।

 (১) তাকে কষ্ট না দেওয়া:  হোক সে কষ্ট কথার মাধ্যমে, যেমন অভিশাপ দেওয়া, গালী দেওয়া, তার গীবত করা, এমন কিছু তার সম্পর্কে বলা যার দ্বারা সে কষ্ট পায়, ইত্যাদি।

অথবা কাজের মাধ্যমে: যেমন তার বাড়ির সামনে আবর্জনা ফেলা, তাকে বিরক্ত করা, ছেলে মেয়েদেরকে তার ঘরের জিনিস নষ্ট করতে উদ্বুদ্ধ করা বা বাঁধা না দেওয়া।

 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: আল্লাহর কসম সে মুমিন নয়, আল্লাহর কসম সে মুমিন নয়, আল্লাহর কসম সে মুমিন নয়, বলা হল কে সে হে আল্লাহর রাসূল ? তিনি বললেন :ঐ ব্যক্তি যার কষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়। (বুখারী: ৫৫৫৭) 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন: অর্থাৎ : সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না যার প্রতিবেশী তার কষ্ট থেকে মুক্ত নয়। (আহমাদ: ৫৮০০)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যত্র বলছেন : যে আল্লাহ্‌র প্রতি এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়।(বুখারী: ৫৫৫৯)

প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়ার সবচেয়ে কঠিন প্রকার হল: তার সম্মান-সম্ভ্রম এ আঘাত আসে এমন বিষয়ে কষ্ট দেওয়া, যেমন প্রতিবেশীর স্ত্রী বা পর্দা করার মত কারও খিয়ানত করা, দৃষ্টি দেয়ার মাধ্যমে হোক বা সরাসরি কথা বলার মাধ্যমে অথবা অসৎ উদ্দেশ্যে ফোনে কথা বলার মাধ্যমে, অথবা যে কোন অশ্লীল কাজের মাধ্যমে ।

আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন : আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট জানতে চেয়েছি: আল্লাহ তা’আলার নিকট সব চেয়ে বড় গুনাহ কোনটি? তিনি বললেন― কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধরণ করা অথচ তিনিই তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, আমি বললাম তার পরে কি? বললেন: তুমি তোমার সন্তানকে হত্যা করা তোমার সাথে খাওয়ার ভয়ে। আমি বললাম এর পর কি? তিনি বললেন, তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে সম্মতির ভিত্তিতে ব্যভিচার করা। অর্থাৎ তার প্রতিবেশীর স্ত্রীকে ফুসলিয়ে তাকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে তার সাথে ব্যভিচার করা। কারো অসম্মতিতে জোর পূর্বক তার সাথে ব্যভিচার করা থেকে এটা আরো বেশি অপরাধ। (বুখারী: ৫৫৪৩) মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করে বলেন: কোন ব্যক্তি তার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করা দশ জন মহিলার সাথে ব্যভিচার করা থেকেও কঠিন পাপ। (আহমাদ: ২২৭৩৪)

প্রতিবেশীর এ বিষয়টি বড় করে দেখার কারণ:

(ক) এক প্রতিবেশী অপর প্রতিবেশীর নিকট আমানত স্বরূপ, এর সাথে ব্যভিচার করা উক্ত আমানতের খিয়ানত। 

(খ) প্রতিবেশী অপর প্রতিবেশীর যাবতীয় অবস্থা এবং তার উপস্থিতি- অনুপস্থিতির সময় সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞাত, কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা।

(গ) সে যেহেতু তার নিকটেই থাকে এবং তার সাথে উঠা-বসা করে তাই তার কষ্ট প্রতিবেশীর নিকট খুব দ্রুত এবং সহজেই পৌঁছে ।

(ঘ) আরেকটি কারণ হচ্ছে কেউ তাকে সন্দেহ করবে না।

প্রতিবেশীর প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করা : নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:― যে আল্লাহর প্রতি এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে সম্মান করে।

আর এটি ব্যাপক ভিত্তিক অধিকার,এর সাথে অনেকগুলো অধিকার এবং বিষয় জড়িত

(ক) তার প্রয়োজনে সাহায্য করা, ব্যবহারের জিনিস চাইলে দেয়া। কেননা প্রতিবেশী কখনও প্রতিবেশীর কাছে মুখাপেক্ষী নয় এমন হতে পারে না। আল্লাহ্‌ তাআলা ঐ সমস্ত লোকদের নিন্দা করেছেন যারা নিত্য ব্যবহার্য জিনিস চাইলে বিমুখ করে। তাদের নিন্দা করে আল্লাহ বলেন : তারা নিত্য ব্যবহার্য জিনিস অন্যকে দেয় না। (আল-মাউন: ৭)

(খ)  প্রতিবেশীকে হাদিয়া দেওয়া।তার বাড়িতে খাবার ইত্যাদি প্রেরণ করা। আবু যব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে অসীয়ত করেছেন :  অর্থাৎ. যখন তুমি তরকারী রান্না করবে তাতে বেশি করে পানি দেবে অতঃপর তোমার প্রতিবেশীর খবর নিয়ে তার থেকে তাদেরকে কিছু দেবে। (মুসলিম: ৪৭৫৯)

(গ) প্রতিবেশী ঋণ চাইলে তাকে ঋণ দেয়া, তার প্রয়োজনে তাকে সাহায্য সহযোগিতা করে তার রক্ষনাবেক্ষণ করা।  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:― সে মুমিন নয় যে পেট ভরে খায় অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে।  

(ঘ) প্রতিবেশীর ভাল কোন সংবাদ পেলে তাকে মোবারকবাদ জানানো, এবং খুশি প্রকাশ করা, বিবাহ করলে অথবা সন্তান জন্ম নিলে, অথবা তার সন্তান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে এবং এ জাতীয় উপলক্ষে তাকে মোবারকবাদ জানানো এবং বরকতের দোয়া করা।  মুসলমানদের মাঝে পরস্পরে যে অধিকারগুলো আছে সেগুলো প্রতিবেশীর ব্যাপারে আদায় করবে। কেননা সে-ই এর অধিকার বেশি রাখে, যেমন তাকে সালাম দেওয়া, সালামের উত্তর দেয়া, অসুস্থ হলে তার সেবা করা, তার দাওয়াত গ্রহণ করা। তার সাথে সাক্ষাৎ হলে আল্লাহর প্রদত্ত ফরযগুলি সংক্ষেপে স্মরণ করিয়ে দেয়া―ইত্যাদি।

 

Related Post