আমার জীবনে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন

কুরআনুল কারীম

কুরআনুল কারীম

সার্জেন্ট (অব.) মুহাম্মাদ শফিকুল ইসলাম (ই.এম.ই)

ভূমিকাঃ

সমস্ত প্রশংসা সেই সুমহান সৃষ্টিকর্তা ও পরম প্রতিপালকের। যিনি এই আসমান জমিন তথা এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুরই সৃষ্টিকর্তা ও পরম প্রতিপালক, এবং যিনি তার স্ব-ইচ্ছাতেই মানবজাতিকে সৃষ্টি করে কল্যাণময় জ্ঞানদান করেছেন এবং তাদেরকে এই জমিনে তাঁরই খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছেন।

অসংখ্য দরুদ ও সালাম পেশ করছি মানবতার মুক্তির দিশারী, সর্বযুগ ও সর্বকালের জন্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ মহা পথপ্রদর্শক হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবা কেরাম (রাঃ) এবং কিয়ামত পর্যন্ত যেসকল মুমিন নর-নারী তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে উত্তমরূপে জীবন পরিচালনা করবেন তাঁদের পবিত্র রূহ মোবারকের উপর।

দুনিয়ার জমিনে মানুষের জীবন নৌকার চলমান গতি-প্রকৃতি বহু বৈচিত্রময়। কখন কিভাবে যে তার গতি-প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটে বা বদলে যায়, তা এক সেকেন্ড পূর্বেও কোন ব্যক্তি ধারণাও করতে পারেন না। তার কারণ মানুষের মহান পরিচালক হচ্ছেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা। সেই মহান পরিচালক তাঁর বান্দা-বান্দীর জীবন নৌকার গতি-প্রকৃতি কখন কিভাবে পরিবর্তন করে পরিচালনা করবেন সে জ্ঞান মানুষের ধারণারও বাহিরে। আর এ ব্যাপারেই আমাদের পরম প্রতিপালক বলছেনঃ “অদৃশ্যের চাবিকাঠি তাঁরই নিকট রয়েছে; তিনি ছাড়া আর কেউই তা জ্ঞাত নয়, স্থল ও জলভাগের সব কিছুই তিনি অবগত রয়েছেন, তাঁর অবগতি ব্যতীত বৃক্ষ হতে একটি পাতাও ঝরে না এবং ভূ-পৃষ্ঠের অন্ধকারের মধ্যে একটি দানাও পড়ে না, এমনিভাবে কোন সরস ও নিরস বস্তুও পতিত হয় না। সমস্ত বস্তুই সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে।” (সূরা:আন’আম: ৫৯)।

অর্থাৎ মানুষের জীবন নৌকার গতি-প্রকৃতি সেই মহান প্রতিপালকের ইচ্ছারই প্রতিফলন। মানুষের জীবনের গতি-প্রকৃতির যে কোন পরিবর্তন পরিবর্ধন সংযোজন বিয়োজন সব কিছুই নিয়ন্ত্রন করেন সেই মহান প্রতিপালকই। আমার জীবনেও তেমনি একটি নিদর্শণমূলক ঘটনা আজ এ প্রবন্ধে উপস্থাপনের জন্যে চেষ্টা করছি। তবে এটা কোন নিজের বাহাদুরী বা গর্ব, অহংকার জাহির করা নয়। আমি প্রথমেই সে কথা উল্লেখ করছি যে, মানুষের জীবনে কল্যাণজনক যা কিছুই ঘটুক, তার জন্যে  কোন মানুষের কৃতিত্ব নেই। সমস্ত কৃতিত্বই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালার। যিনি কাজ ও কাজী দু’টির’ই সৃষ্টিকর্তা। যেমন এ ব্যাপারে সুমহান প্রতিপালক বলছেনঃ “তোমরা (নিজের ইচ্ছায়) কিছুই চাইবে না, যদি জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ তা না চান।” (সূরা:তাকভীর: ২৯)। অন্য আরো একটি আয়াতে সুমহান আল্লাহ বলছেনঃ “তোমরা (কোন সৎ কাজের) ইচ্ছা করবে না যদি না আল্লাহ ইচ্ছা করেন। নিশ্চই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। তিনি যাকে ইচ্ছা তাঁর অনুগ্রহের অন্তর্ভূক্ত করেন; কিন্তু যালিমরা, তাদের জন্যে তো তিনি প্রস্তুত করে রেখেছেন যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি।” (সূরা: দাহর: ৩০-৩১)।

পবিত্র আল-কুরআনের সাথে পরিচয়ঃ

যদিও আমি মুসলমান পিতা-মাতার ঘরে জন্ম নিয়েছিলাম। কুরআন কী? ইসলাম কী? এবং মুসলমান কী? ইতিপূর্বে সে সম্পর্কে আমার তেমন কোন বেশী জ্ঞান ছিলো না। ঈসায়ী ২০০১ সালের জানুয়ারী মাসে কুয়েতে এসে সে বছরই অর্থাৎ নভেম্বর ২০০১ মোতাবেক পবিত্র রমযান মাসে ওমরাহ পালনের জন্যে বাইতুল্লায় যাই। সারাদিন ওমরাহ এবং তাওয়াফ করেই কাটিয়ে দিলাম। রাতে এ’শার পর তারাবীহ পড়ার জন্যে  মাসজিদুল হারামে দাড়িয়েছি। সেদিন তারাবীহ’র জামায়াতের প্রথম পর্বের ইমামতি করছিলেন বাইতুল্লাহর প্রখ্যাত খতিব ও ইমাম হাফেজ ডক্টর আব্দুর রহমান আস-সুদাইস। নিয়ম মোতাবেক সম্মানিত ইমাম সাহেব তারাবীহ’র নামাজের তাকবিরে তাহরিমা বাঁধার পর সূরা ফাতিহা পড়লেন, অতঃপর পবিত্র কুরআন থেকে অন্য একটি সূরা তেলাওয়াত করছিলেন। পবিত্র সেই তেলাওয়াতের শব্দ শুনে আমার সমস্ত শরীর নিথর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আমার মনে হচ্ছিলো যেন, কুরআন’র শব্দগুলো আল্লাহ’র আরশে আযিম থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে আমার সমস্ত শরীরের লোমকুপ দিয়ে অন্তঃকরণে প্রক্ষিপ্ত হচ্ছে। আর তাতেই আমার দেহ মন এক রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে ভরে উঠেছে। কী যে সেই তেলাওয়াতের স্বাধ, আর পরিতৃপ্তি, সে কথা আমি আমার এই মূর্খ ভাষা-জ্ঞানে বর্ণনা করে বোঝাতে পারছিনা। আয়াতের অর্থগুলো সম্পর্কে পূর্বের কোন ধারণাই ছিলো না, তথাপিও মনে হচ্ছিলো যেন আয়াতের অনেক অর্থই বুঝতে পারছি। তখন মনে হলো আমি জমিনে নাই, আকাশের কোন এক উঁচূ স্থানে অবস্থান করছি। আমি কুরআন পড়তে জানতাম না, কিন্তু কুরআনের   যে এত স্বাধ সে কথা আমি আগে কোন দিনও বুঝতে পারিনি । অন্তঃকরণে কুরআন জানার প্রতি প্রচন্ড ইচ্ছা জাগ্রত হলো। অতঃপর ঐ নামাজরত অবস্থায় সুমহান আল্লাহর কাছে অশ্রুশিক্ত নয়নে অনেক কাকুতি মিনতি করে প্রার্থনা জানালামঃ

“হে আমার প্রতিপালক! আমি কুরআন পড়তে জানিনা, কিন্তু আজ আমাকে আপনার পবিত্র ঘরে উপস্থিত করে আপনার পবিত্র কুরআনের   তেলাওয়াত শুনিয়ে আমার অন্তঃকরণ বিগলিত ও বিমোহিত করেছেন। কি আছে আপনার ঐ পবিত্র কিতাবে, যার এত তৃপ্তিপূর্ণ স্বাধ? সেই কথাগুলি বুঝতে না দিয়ে, আমার মৃত্যু ঘটাবেন না। আমি আরবী ভাষা জানিনা, তাই কুরআন পড়তেও পারিনা। আমাকে আপনার পবিত্র কুরআনের   কথাগুলো আমার মাতৃভাষায় বুঝার তাওফীক দিন।”

এভাবে কথাগুলো বলার সাথে সাথে মনে হলো আমার অন্তঃকরণ আর সপ্ত আকাশ ভেদ করে আল্লাহর আরশে আযিম পর্যন্ত একটি প্রশস্ত আলোকিত পথের সৃষ্টি হলো। মনে হচ্ছিলো যে কথাগুলো আল্লাহর কাছে নিবেদন করছি, সব কথাই কবুল হচ্ছে। সাথে সাথে আমার সমস্ত শরীর রোমাঞ্চিত, আর অন্তঃকরণ এক পরিতৃপ্তিময় প্রশান্তিতে ভরে গেল । পবিত্র ওমরাহ শেষ করে কুয়েতে ফিরে এসে কুরআন শিখতে ইচ্ছে করলাম। কিন্তু কুরআন পড়তে জানি না, কারো কাছে যে শিখতে যাবো তাও লজ্জার কারণে যেতে পারছি না। লজ্জার কারণটা হলো, যার কাছে এই বয়সে কুরআন শিখতে যাবো, তিনি যদি মনে মনে ভাবেন যে, কেমন মুসলমান ঘরের সন্তান হয়ে এত বছর বয়সেও কুরআন পড়তে জানে না? আর তার বাবা-মায়েই বা কেমন যে, তার ছেলেকে কুরআন পড়তে শিখায় নাই? এই সমস্ত বিভিন্ন কথা চিন্তা করে অন্য কারো কাছে কুরআন শিখতে গেলাম না। কিন্তু অন্তঃকরণে কুরআন শিখার প্রতি প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হলো। তাই একা একা আমাদের ব্যারাকের মসজিদে বসে বাংলা উচ্চারণসহ একটা কুরআনের কপি নিয়ে ছোট কালে পড়া কায়দার পরিচিত আরবী হরফ গুলোর সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে বানান করে ভেঙ্গে ভেঙ্গে কুরআন পড়া শুরু করলাম। আর আমার প্রতিপালকের নিকট কান্নাকাটি করে প্রার্থনা করলামঃ

“হে আল্লাহ ! আপনার এই পবিত্র কুরআন আমাকে আমার মাতৃভাষায় বুঝতে না দিয়ে আমাকে কবরে নিবেন না। কুরআন পড়তে এবং কুরআনের   কথাগুলো আমার মাতৃভাষায় বুঝতে আমাকে সাহায্য করুন।”

এভাবে ক’একদিন চেষ্টা করার পর দেখলাম যে, আগের চেয়ে কিছুটা ভালভাবে কুরআন পড়তে পারছি। এর কিছুদিন পরেই ঐভাবে কুরআন পড়তে দেখে আমার সাথের এক ভাই আমাকে পরামর্শ দিলেন যে, শুধু বাংলা উচ্চারণে কুরআন পড়লে শব্দের উচ্চারণ সঠিক হয় না, আর উচ্চারণ সঠিক না হলে অর্থ বিকৃত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। আর শব্দের অর্থ বিকৃত হলে তাতে ছওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ হওয়ার সমূহ সম্ভবনা রয়েছে। কাজেই আপনি শুধুমাত্র আরবী উচ্চারণে কুরআন পড়ার চেষ্টা করুন। সেই ভাইয়ের কথামত তখন আমি সৌদি ছাপা একটি কুরআনের কপি নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। আমার জিহ্বার জড়তা রয়েছে, তাই অনেক শব্দ উচ্চারণে কষ্ট হতো। তখন মনে হতো কঠিন শব্দগুলো উচ্চারণ করতে মূখের ভিতরে আমার জিহ্বার জড়তা ভেঙ্গে দিয়ে কেউ একজন আমাকে কুরআন পড়তে সাহায্য করছেন। আমি স্পষ্টই আমার অন্তঃকরণ তথা সমস্ত সত্তা দিয়ে অনুভব করতে পারতাম, আমার আল্লাহই কঠিন শব্দগুলো উচ্চারণ সহজ করে আমাকে কুরআন পড়তে সাহায্য করছেন। তখন আমার সমস্ত দেহ মন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠতো এবং কুরআনের   প্রতি আলাদা এক মমত্ববোধ এবং আত্মতৃপ্তি অনুভবের সৃষ্টি হতো। এভাবে কিছুদিন কুরআন পড়ার পর অন্তঃকরণে অনুভব হলো, আমি কী পড়ছি? সে কথাতো বুঝতে পারছি না। আর সেগুলি না বুঝলে কুরআন পড়ে কী লাভ? তাই সৌদি ছাপা কুরআনের সাথে বাংলা অর্থসহ ছাপা আমাদের দেশের নুরানী কুরআন শরীফের একটি কপি সাথে নিলাম। সৌদি ছাপা কপিটা থেকে আরবী ভাষায় ভেঙ্গে ভেঙ্গে কুরআন পড়ছি, আর নুরানী কুরআন শরীফ থেকে তার বাংলা অর্থগুলো দেখে নিচ্ছি। এভাবে যখন কুরআন পড়া শুরু করলাম এবার কুরআনের আলাদা এক স্বাধ আর পরিতৃপ্তি অন্তঃকরণে অনুভব হতে লাগলো। নুরানী ছাপা কুরআন শরীফটার বাংলা অর্থের বাক্য বিন্যাস যেভাবে করা হয়েছে, তাতে আমার মনে হলো এর চেয়েও অন্যগুলোতে হয়তো আরো সহজভাবে বাক্যগুলো সাজানো থাকতে পারে, তাই তখন বিভিন্ন প্রকাশনীর ছাপা আরো দুই তিনটা কপি সাথে নিয়ে দেখলাম কোনটার মধ্যে কী অর্থ ও কিভাবে বাক্য বিন্যাস করা হয়েছে? সবগুলো কপি দেখে মনে মনে ভাবলাম যে, আরো সহজ করে সূন্দরভাবে বাক্য বিন্যাসের মাধ্যমে যদি একটা কপি পাওয়া যেতো, তাহলে কুরআন বুঝতে আরো সহজ হতো। এই কথাগুলি মনে মনে যখন ভাবছিলাম, ঠিক এর অল্প ক’দিন পরেই সৌদি আরবের আন্তর্জাতিক কুরআন প্রকাশনা কেন্দ্র, দারুস সালাম থেকে প্রকাশিত প্রফেসর ডক্টর মুহাম্মাদ মুজিবুর রহমান কর্তৃক অনুবাদকৃত “কুরআনুল কারীম” নামের সংক্ষিপ্ত বাংলা তাফসীর-এর ২/৩ টা কপি কে যেন আমাদের ব্যারাকের মসজিদে রেখে গেছেন। হঠাৎ চোখে পড়লো সেই কপিগুলো। সেখান থেকে একটা কপি নিয়ে পড়ে দেখে মনে হলো, এ যেন আমার অন্তঃকরণের চাহিদা অনুযায়ী অনুবাদকৃত কুরআন। অত্যন্ত সাবলিল ও সহজ ভাষায় বোধগোম্য করে অনুবাদকৃত বাংলা বাক্যগুলো আলাদা করে খুব সুন্দরভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে। মাঝে মাঝে অনেক আয়াতের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে পবিত্র হাদীসের উদ্বৃতি দিয়ে। কুরআন পড়তে বসলে পড়া ছেড়ে উঠতে মন চাইতো না, এমন কি খানা-দানার প্রতিও তেমন আগ্রহ থাকতো না। মনে হতো সারা দিন-রাতই কুরআন পড়তে থাকি। (চলবে)

Related Post