তাকদীর একটি জটিল বিষয়

তাকদীর একটি জটিল বিষয়

তাকদীর একটি জটিল বিষয়

আরবী কদর (قدر) বা তাকদীর (تقدير) শব্দের অনেকগুলো অর্থ রয়েছে, যেমন- অদৃষ্ট, ভাগ্য নিয়তি, ফলাফল, পরিণতি। এবং কোনকিছু পরিচালিত বা সংঘটিত হওয়ার বিধি-বিধান, আইন কানুন, নিয়ম-নীতি বা পদ্ধতি।

বক্তব্যসমূহে উল্লিখিত কদর (قدر) বা তাকদীর (تقدير) শব্দের অর্থ যদি পরিচালিত বা সংঘটিত হওয়ার বিধি-বিধান, আইন-কানুন, নিয়ম-নীতি বা পদ্ধতি ধরা হয় তবে যে তথ্য বের হয়ে আসে তা হচ্ছে –

১. মানুষের কৃত সকল কাজের ভাল বা মন্দ ফলাফল, জীবন-মৃত্যু, বেহেশত বা দোযখ প্রাপ্তি এবং

২. মহাবিশ্বের অন্য সকল সৃষ্টির মধ্যে সংঘটিত হওয়া সকল ঘটনা-দুর্ঘটনার ব্যাপারে,মহান আল্লাহ, সৃষ্টির শুরুতে পৃথক পৃথক বিধি-বিধান আইন-কানুন, নিয়ম-নীতি তথা প্রাকৃতিক আইন (Natural Law) তৈরী করে রেখেছেন এবং তা মানুষ বা অন্য কোন সৃষ্টির পক্ষে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। মানুষের জীবনে এবং মহাবিশ্বে সংঘটিত হওয়া সকল ঘটনা-দুর্ঘটনা আল্লাহর তৈরী ঐ প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী সংঘটিত হয়। মানুষের কৃত কাজের ব্যাপারে ঐ প্রাকৃতিক আইনে যথাযথ গুরুত্বসহকারে অন্তর্ভুক্ত আছে –

  1. মানুষের ইচ্ছা, কর্মপ্রচেষ্টা, ধৈর্য, দৃঢ়তা, নিষ্ঠা, সাহসিকতা, ত্যাগ, একতা, সংঘবদ্ধতা ইত্যাদি সহ,
  2. আল্লাহর নির্দিষ্ট ও জানা কিন্তু মানুষের অজানা বা জানা অসংখ্য বিষয়।

মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনে আল্লাহর উদ্দেশ্য

তাকদীরের সঠিক অর্থ ও ব্যাখ্যা বুঝার জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনে আল্লাহর উদ্দেশ্যটি নির্ভুলভাবে জানা ও বুঝা। তাই চলুন প্রথমে সে উদ্দেশ্যটি কুরআন থেকে নির্ভুলভাবে জেনে ও বুঝে নেয়া যাক-

তথ্য ১:

الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلاً وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ

অর্থ: তিনি (মহান আল্লাহ) মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যেন পরীক্ষা করে নিতে পারেন কে কাজে-কর্মে উত্তম (শ্রেষ্ঠ)। আর তিনি পরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীল৷  (মুলক: ২)

v   করণীয় বা নিষিদ্ধ কাজ করার ইচ্ছা করা এবং সে ইচ্ছা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে চেষ্টা-সাধনা করার ব্যাপারে মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা।

বাস্তবে আমরা দেখি ইসলাম সিদ্ধ বা নিষিদ্ধ যেকোন কাজ করার ইচ্ছা করা বা সিদ্ধান্ত নেয়া এবং সে ইচ্ছা বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার জন্যে চেষ্টা-সাধনা করার ব্যাপারে মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন। আর মহান আল্লাহ যে মানুষকে এ স্বাধীনতা দিয়েছেন তা তিনি আল-কুরআনের মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন।

t ঈমান আনার ব্যাপারে মানুষ স্বাধীন

আল্লাহ বলছেন: ১

وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ ۖ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ ۚ

অর্থ: বলে দাও এ মহাসত্য এসেছে তোমাদের রবের নিকট থেকে। এখন যার ইচ্ছা ঈমান আনতে পা‡র, আর যার ইচ্ছা অস্বীকার করতে পারে। (কাহাফ : ২৯)

وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَآمَنَ مَنْ فِي الْأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيعًا ۚ أَفَأَنْتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتَّىٰ يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ

অর্থ: তোমার রব যদি ইচ্ছা করতেন তবে পৃথিবীর সকলেই ঈমান আনত। তুমি কি লোকদের মুমিন হওয়ার জন্যে জবরদস্তি করবে? (ইউনুস:৯৯)

vv আল-কুরআনের এ সকল তথ্য এবং এ ধরনের আরো অনেক তথ্য থেকে নিঃসন্দেহে জানা ও বুঝা যায় ঈমান আনার ব্যাপারে মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন। অর্থাৎ ঈমান আনা বা না আনা সম্পূর্ণ মানুষের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।

সিদ্ধ বা নিষিদ্ধ উভয় ধরনের কাজ করার ব্যাপারে মানুষ স্বাধীন

আল্লাহ বলছেন:

 إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا

অর্থ: আমি তাদের (মানুষদের) সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছি। এখন ইচ্ছা করলে তারা (তা অনুসরণ করে কল্যাণপ্রাপ্ত হয়ে) শোকরকারী হতে পারে, অথবা তা অস্বীকার করতে পারে (অস্বীকার করে ভুল পথ অনুসরণ করতে পারে)। (দাহার:৩)

আল্লাহ বলছেন:

   إِنَّ هَذِهِ تَذْكِرَةٌ فَمَنْ شَاءَ اتَّخَذَ إِلَى رَبِّهِ سَبِيلًا * الإنسان

অর্থ: এটা (আল-কুরআনের বক্তব্য) একটি নসিহত বিশেষ। এখন যার ইচ্ছা নিজের রবের পথ অবলম্বন করুক।

উপরের আলোচনা থেকে তাকদীরের বিষয়টি জটিলই মনে হচ্ছে: এখন আমরা এর সমাধান খুঁজার চেষ্টা করবো। ইনশা আল্লাহ

তাকদীর একটি জটিল বিষয়: সমাধান

 অনেকে প্রশ্ন করেনঃ মানুষ ভাল-মন্দ যত কাজ করে তা আল্লাহর ইচ্ছায় ও তাকদীরের লেখনে করে। তাই মানুষের কি দোষ?

কেন আল্লাহ তাকে মন্দ কাজের জন্য শাস্তি দিবেন?

আবার অনেকের প্রশ্নের ভাষা এ রকম যে, আমি জান্নাতে যাবো না জাহান্নামে যাবো তাতো অনেক আগেই লেখা হয়েছে। তাই কষ্ট করে নেক আমল করে লাভ কি? তাকদীরে জান্নাত লেখা থাকলে কোন আমল না করেও জান্নাতে যাওয়া যাবে। আর কপালে জাহান্নাম লেখা থাকলে হাজার ভাল কাজ করেও জান্নাতে যাওয়া যাবে না।

 আবার অনেকে বলেনঃ  আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই হয় না। তাই আমি যদি কোন খারাপ কাজ করে থাকি তবে তা আল্লাহর ইচ্ছায় করেছি। আল্লাহ ইচ্ছে করলে আমাকে ফিরিয়ে রাখতে পারতেন।

প্রশ্নের ভাষার ধরণ যাই হোকনা কেন কথা হল সব কিছু যখন আল্লাহর ইচ্ছায় হয় তখন মানুষের কি দোষ?

এ সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে যেয়ে অনেক বিজ্ঞজন হিমশিম খেয়েছেন এক পর্যায়ে বলেছেনঃ  তাকদীর সম্পর্কে বেশি আলোচনা বা প্রশ্ন করা ঠিক নয়। এ ব্যাপারে যুক্তি-তর্ক করতে যেয়ে অনেকে গোমরাহ হয়ে গেছে। উদ্ভব হয়েছে জবরিয়া, কদরিয়া ইত্যাদি বাতিল ফেরকার। তাই আমি এ বিষয়টি সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করবো আজকের আলোচনায়। ইনশা আল্লাহ

এ ধরনের প্রশ্ন কোন মুসলিম করতে পারে কিনা?

কুরআনুল কারীমে যা দেখা যায় তাতে প্রমাণিত হয় যে, এ ধরনের প্রশ্ন কাফির মুশরিকরা করত। যেমন ইরশাদ হচ্ছেঃ

 سَيَقُولُ الَّذِينَ أَشْرَكُوا لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا أَشْرَكْنَا وَلا آبَاؤُنَا وَلا حَرَّمْنَا مِنْ شَيْءٍ كَذَلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ حَتَّى ذَاقُوا بَأْسَنَا*   الأنعام: ١٤٨

যারা শিরক করেছে তারা বলবে আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন, তবে আমরা ও আমাদের পূর্ব-পুরুষগণ শিরক করতাম না, এবং কোন কিছুই নিষিদ্ধ করতাম না। এভাবে তাদের পূর্ববর্তীগণও প্রত্যাখ্যান করেছিল অবশেষে তারা আমার শাস্তি ভোগ করেছিল। (সূরা আনআম: ১৪৮)

 দেখুন! মুশরিকরা তাদের শিরকের ব্যাপারে আল্লাহর ইচ্ছার কথা বলে রেহাই পাবার প্রয়াস পেয়েছে। এবং তাদের এ কথা দ্বারা তারা ইসলামকে প্রত্যাখ্যান করেছে। অতএব যারা আল্লাহর ইচ্ছার দোহাই দিয়ে সত্যকে প্রত্যাখ্যান ও সৎকর্ম থেকে দূরে থাকতে চায় তারা মূলত মুশরিকদের মতই কাজ করল ও তাদের অনুসরণ করল।

 আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরো বলেনঃ

وَقَالَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا عَبَدْنَا مِنْ دُونِهِ مِنْ شَيْءٍ نَحْنُ وَلَا آَبَاؤُنَا

মুশরিকরা বলে আল্লাহ ইচ্ছা করলে আমাদের বাপ-দাদারা ও আমরা তিনি ব্যতীত অপর অন্য কিছুর ইবাদত করতাম না। (নাহল: ৩৫)

তিনি আরো বলেনঃ তারা (মুশরিকরা) বলেঃ

وَقَالُوا لَوْ شَاء الرَّحْمَنُ مَا عَبَدْنَاهُم مَّا لَهُم بِذَلِكَ مِنْ عِلْمٍ إِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ  (20)الزخرف

দয়াময় আল্লাহ ইচ্ছা করলে আমরা তাদের পূজা করতাম না। এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নাই; তারা কেবল মিথ্যাই বলে।(সূরা যুখরুফঃ ২০)

উল্লিখিত তিনটি আয়াতে কারীমা হতে কয়েকটি বিষয় স্পষ্টভাবে জানা গেল –

(এক) মুশরিকরা আল্লাহর ইচ্ছার দোহাই দিয়ে শিরক করত। তাদের শিরকের প্রমাণ হিসাবে তারা আল্লাহর ইচ্ছাকে পেশ করত।

(দুই) তারা বিশ্বাস করত সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছায় হয়। এ বিশ্বাস পোষণ করার পরও তারা কাফির ও মুশরিক রয়ে গেছে।

(তিন) তারা আল্লাহর গুণাবলীতে বিশ্বাস করত (যেমন সূরা যুখরুফের আলোচ্য আয়াতের রহমান) তারপরেও তারা মুশরিক।

(চার) তারা তাদের শিরকের সমর্থনে আল্লাহর ইচ্ছা-কে প্রমাণ হিসাবে পেশ করে বলেছে যে তারা এসব আল্লাহর ইচ্ছায়ই করছে।  আল্লাহ তাদের মিথ্যাবাদী বলেছেন। কারণ তারা বলেছে তারা শিরকি কাজগুলো আল্লাহর ইচ্ছায় করেছে।

এরপরও যদি কোন মুসলিম ব্যক্তি কাফির-মুশরিকদের মত অনুরূপ প্রশ্ন করে থাকেন তাকে আমরা কয়েকটি উত্তর দিতে পারি।

এক. যে এ ধরনের প্রশ্ন করবে তাকে বলা হবে আপনি জান্নাতে যেতে চান না জাহান্নামে? উত্তরে সে হয়ত বলবে আমি জান্নাতে যেতে চাই।

 তারপর তাকে জিজ্ঞেস করুন আচ্ছা আপনার তাকদীরে কি লেখা আছে জান্নাত না জহান্নাম তাকি আপনি জানেন? সে বলবে না আমি জানিনা।

আচ্ছা তাহলে বিষয়টি আপনার কাছে অজ্ঞাত। আর অজ্ঞাত বিষয়ের উপর নির্ভর করে কোন ভাল কাজ ছেড়ে দেয়া কি কোন বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে?

পরীক্ষায় পাশ করবে না ফেল করবে এটা অজানা থাকার পরও মানুষ অনেক কষ্ট করে পরীক্ষা দেয় পাশ করার আশায়।  অপারেশন সাকসেস হবে কি হবে না তা অজ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও মানুষ অপারেশন করায় রোগ-মুক্তির আশায়। ফলাফল অজ্ঞাত থাকার অজুহাতে কোন কাজ ছেড়ে দিয়ে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা সুস্থ মস্তিস্কের কাজ হতে পারে না। আপনার তাকদীরে জান্নাত লেখা আছে না জাহান্নাম তা আপনার জানা নেই। কিন্তু আপনার লক্ষ্য যখন জান্নাত তখন লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য অবশ্যই কাজ করতে হবে।

 আর জান্নাত ও জাহান্নামের স্রষ্টা যখন বলে দিয়েছেন এটা জান্নাতের পথ আর ওটা জাহান্নামের পথ তখন তা বিশ্বাস করে আমল করতে অসুবিধা কোথায়?

দুই. যার তাকদীরে জান্নাত লেখা আছে সাথে সাথে এটাও লেখা আছে যে, সে জান্নাত লাভের জন্য নেক আমল করবে তাই জান্নাতে যাবে। আর যার তাকদীরে জাহান্নাম লেখা আছে সাথে সাথে এটাও লেখা আছে যে, সে জাহান্নামের কাজ করবে ফলে সে জাহান্নামে যাবে।

তিন. সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছায় হয়। মানুষ সকল কাজই আল্লাহর ইচ্ছায় করে ঠিকই কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক করে না। আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক কাজ করার জন্য সে জান্নাতে যাবে আর সন্তুষ্টি মোতাবেক কাজ না করার জন্য সে জাহান্নামে যাবে।

চার. মানুষ ভালো-মন্দ যা-ই করে আল্লাহর দেওয়া শক্তি ও ক্ষমতা আদেশের বলেই করে। তবুও গুনাহর কাজ করার ফলে শাস্তি ভোগ করবে। বিষয়টির বোধগম্যের জন্য বলতে হয়, যে হুকুম দুই প্রকার: (ক) আইনগত হুকুম বা বিধান (খ) সৃষ্টিগত হুকুম বা বিধান। সৃষ্টিগত হুকুমের কাজ হলো,আল্লাহ চোখ দিয়েছেন দেখার জন্য। সুতরাং দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি চোখ খুললে দেখবেই। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ আইনগত বিধান রেখেছেন, অর্থাৎ চোখে দেখার সীমা-রেখা নির্দিষ্ট করেছেন। তাই সবকিছু দেখা যাবে না। আল্লাহর দেওয়া আইনগত বিধান লঙ্ঘণ করার কারণেই শাস্তি ভোগ করতে হবে।

 প্রশ্ন হতে পারে ইচ্ছা (ইরাদা বা মাশিয়্যত) ও সন্তুষ্টি (রেজা) এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে কি?

  হ্যাঁ অবশ্যই আছে। ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির মধ্যে পার্থক্য আছে অবশ্যই। ছোট একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা সহজে বুঝান যেতে পারে। যেমন এক ব্যক্তির ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়ল। চিকিৎসক বললেন তার পেটে অপারেশন করতে হবে। অপারেশন ছাড়া অন্য কোন পথ নেই।

 এখন বেচারা অপারেশন করাতে রাজী নয়। এ কাজে সে সন্তুষ্ট নয়, তবুও সে অপারেশন করিয়ে থাকে। এমন কি এ কাজের জন্য ডাক্তারকে টাকা পয়সা দেয়। অতএব দেখা গেল এ অপারেশনে তার ইচ্ছা পাওয়া গেল কিন্তু সন্তুষ্টি পাওয়া যায়নি। অপারেশন করাতে সে ইচ্ছুক,রাজী নয়। দেখা গেল ইচ্ছা ও সন্তুষ্টি দু টো আলাদা বিষয়।

 অনেক সময় ইচ্ছা পাওয়া যায় কিন্তু সেখানে সন্তুষ্টি পাওয়া যায় না। কিন্তু যেখানে সন্তুষ্টি পাওয়া যায় সেখানে ইচ্ছা অবশ্যই থাকে।

তাই সকল কাজ মানুষ আল্লাহর ইচ্ছায় করে ঠিকই কিন্তু তার সন্তুষ্টি ও রেজামন্দি অনুযায়ী করে না। বিভ্রান্তি তখনই দেখা দেয় যখন ইচ্ছা দ্বারা সন্তুষ্টি বুঝানো হয়।

আর আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি কিভাবে বুঝা যাবে?

 কোন কাজে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন আর কোন কাজে তিনি অসন্তুষ্ট হন তা বুঝা যাবে কুরআন ও হাদীস দ্বারা। কোন কাজ সংঘটিত হয়ে গেলেই বুঝে নেয়া হবে যে এটা আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় হয়েছে। কিন্তু তা আল্লাহর সন্তুষ্টিতে হয়েছে কিনা তা বুঝা যাবে কুরআন বা হাদীসের মাধ্যমে। কুরআন বা হাদীসে উক্ত বিষয়টির সমর্থন থাকলে বুঝা যাবে সেটা আল্লাহর সন্তুষ্টিতে সম্পন্ন হয়েছে। আর যদি কাজটি কুরআন বা হাদীসের পরিপন্থী হয় তাহলে ধরে নেয়া হবে কাজটি আল্লাহর সন্তুষ্টির খেলাফ হয়েছে। তাই আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুযায়ী কাজ করলে জান্নাতের অধিকারী হওয়া যাবে। আর তার সন্তুষ্টি অনুযায়ী কাজ না করলে জাহান্নামে যেতে হবে। ভাল করে মনে রাখতে হবে সব কাজ আল্লাহর ইচ্ছায় হয় ঠিকই কিন্তু সব কাজ তার সন্তুষ্টি মোতাবেক হয় না। আরো মনে রাখতে হবে ইচ্ছা ও সন্তুষ্টি এক বিষয় নয়। দুটো আলাদা বিষয়।

পাঁচ. আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তার ইচ্ছায় সবকিছু হয়। তাই তিনি ইচ্ছা করেই মানুষকে ইচ্ছা শক্তি দিয়েছেন। যাতে মানুষ নিজ ইচ্ছায় ও স্বাধীনতায় ভাল ও মন্দ পথ অবলম্বন ও বর্জন করতে পারে। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ

 وقل الحق من ربكم فمن شاء فليؤمن ومن شاء فليكفر

বল,সত্য তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে;সুতরাং যার ইচ্ছা বিশ্বাস করুক ও যার ইচ্ছা সত্য প্রত্যাখ্যান করুক। (কাহাফ: ২৯)

তাই বলা যায় আল্লাহর দেয়া ইচ্ছা শক্তিতেই মানুষ ভাল-মন্দ কাজ করে। তবে আল্লাহ ইচ্ছা করলে মানুষের ইচ্ছাশক্তি রহিত করে ভাল বা মন্দ কাজ করতে বাধ্য করতে পারেন।

মানুষ কোন খারাপ কাজ করলে এ কথা বলা যাবে না যে, এ ক্ষেত্রে মানুষের কোন ইচ্ছা ছিল না। এ কথাও বলা যাবে না যে আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজটি হয়েছে। কাজটা আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছে এটা যেমন সত্য তেমনি মানুষের ইচ্ছাও কাজটা করার ব্যাপারে ভূমিকা রেখেছে।

কিভাবে এটা সম্ভব?

একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে। উদাহরণটা হল বিদ্যুত ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিদ্যুত বিতরণ কর্তৃপক্ষ ও বিদ্যুত গ্রাহকের ভূমিকা। বিদ্যুত বিতরণ কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ করে ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে, তেমনি বিদ্যুত গ্রাহকও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু দায় বহন করতে হবে বিদ্যুত গ্রাহকের। মাস শেষে যখন হাজার টাকার বিদ্যুত বিল আসল তখন কর্তৃপক্ষকে এ কথা বলে দোষ দেয়া চরম বোকামী হবে যে তারা কেন বিদ্যুত সরবরাহ করল, তারা ইচ্ছা করলে আমার বিদ্যুত খরচ কমাতে পারত।

তারা ইচ্ছা করলে বিদ্যুত সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে আপনার খরচ কমাতে পারত এটা যেমন ঠিক, তেমনি আপনিও সাশ্রয়ী হয়ে বিদ্যুত খরচ কমাতে পারতেন। আর খরচের এ দায়ভার বহন করবেন গ্রাহক, কর্তৃপক্ষ নয়। কেননা এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের ইচ্ছা ও কর্ম দায়ী।

 তাই মানুষের ভাল-মন্দ আমলের ব্যাপারেও এটা বলা যায় যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে মন্দটা করত না। আবার করার জন্য মানুষই দায়ী- তার ইচ্ছা শক্তি প্রয়োগের জন্য।

ছয়. আল্লাহ নিজের ইচ্ছায় মানুষকে ভাল ও মন্দ কাজ করার ইচ্ছা শক্তি দান করে থাকেন। তিনি তার ইচ্ছায় কাউকে ভাল বা মন্দ কাজ করার জন্য বাধ্য করেন না। যদি তিনি এরূপ করতেন তাহলে দুনিয়ার সকল মানুষ ঈমানদার হয়ে যেত।

যেমন তিনি বলেনঃ

وَلَوْ شاءَ رَبُّكَ لَآمَنَ مَنْ فِي الْأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيعًا أَفَأَنْتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتَّى يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ (99)

যদি তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করতেন তাহলে পৃথিবীর সকল মানুষই ঈমান গ্রহণ করত। তবে কি তুমি মানুষকে বাধ্য করবে, যাতে তারা মুমিন হয়? (সূরা ইউনুস: ৯৯)

সারকথা; নিজেদের খারাপ কাজগুলো ‘আল্লাহর ইচ্ছায় ও তাকদীরের লেখার কারণে হয়েছে এধরনের কথা বলে খারাপ কর্মের শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। তাকদীরের দোহাই দিয়ে জাহান্নাম থেকে মুক্তি বা জান্নাত লাভ করা যাবে না।

 এ ক্ষেত্রে ছোট একটা ঘটনা উল্লেখ না করে পারছি না। তা হলঃ

উমর (রাঃ) এর খেলাফত যুগে এক লোক চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত হল ও আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত হল। শাস্তি হিসেবে তার হাত কাটার নির্দেশ হল। লোকটি উমর (রাঃ) এর কাছে যেয়ে বলল- মুসলিম জাহানের হে মহান খলীফা! আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছু হয় না। আমিও তো আল্লাহর ইচ্ছার বাহিরে নই। তার ইচ্ছায় চুরি করেছি। আমার হাত কাটা যাবে কেন?

উমর (রাঃ) বললেনঃ সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছায় বা তাকদীরের কারণে হয়। তুমি যেমন আল্লাহর ইচ্ছায় চুরি করেছ তেমনি তোমার হাত আল্লাহর ইচ্ছায়ই কাটা হবে।

মহান বিচার দিবসে যদি কোন মানুষ আল্লাহ তা‘আলাকে বলে যে, হে আল্লাহ! আমি বিশ্বাস করতাম আপনার ইচ্ছা ছাড়া কিছু হয় না, আপনিও তাই বলেছেন। আমি যে অন্যায় করেছি, জুলুম করেছি তা তো আপনার ইচ্ছায়ই করেছি। কাজেই আজ আপনি এ কাজের অপরাধে আমাকে জাহান্নামে পাঠাবেন কেন?

তখন আল্লাহ আহকামুল হাকেমীন যদি বলেনঃ ঠিক আছে। তোমার কথাই ঠিক। আমার ইচ্ছায় যখন পাপাচারে লিপ্ত হয়েছে, আমার না-ফরমানী করেছ তখন আমার ইচ্ছায়ই তোমাকে জাহান্নামে যেতে হবে। তুমি তো জানো আমার ইচ্ছার সামনে তোমার কিছুই করার নেই। আমার ইচ্ছায় যখন পাপাচার করতে তোমার আপত্তি ছিল না তাহলে জাহান্নামে যেতে আপত্তি কেন? তখন সে মানুষটির কিছু বলার থাকবে কি? অতএব সে অবস্থা আসার পূর্বেই বিষয়টি ভালভাবে অনুধাবন করা উচিত নয় কি?

আরো বুঝার চেষ্টা করুন:

মহান আল্লাহ যেহেতু কর্মের মাধ্যমে পরীক্ষা নেয়ার নিমিত্তে উল্লিখিত ‎সুযোগ-সুবিধা তিনটি যথাযথভাবে মানুষকে দিয়েছেন, তাই ঐ পরীক্ষার ‎ফলাফল বা পরিণতির জন্যে মানুষ দায়ী থাকবে- এ কথাটি ১০০% বিবেক বা ‎যুক্তি সংগত। অর্থাৎ কৃত কাজের ফলাফল তথা পুরস্কার বা শাস্তির জন্যে মানুষ ‎‎দায়ী হবে বা দায়ী থাকবে। এ কথাটি ১০০% বিবেক বা যুক্তিসংগত।‎
আল-কুরআন ‎
তথ্য-১ وَمَااَصَابَكُمْ مِّنْ مُّصِيْبَةٍ فَبِمَاكَسَبَتْ اَيْدِيْكُمْ.

অর্থ: তোমাদের ওপর যে বিপদ আসে, তা তোমাদের নিজ হাতের অর্জন ‎‎(নিজ কর্মের দোষেই আসে)। ‎ ‎ (শুরা : ৩০) ‎
তথ্য-২ ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ.
অর্থ: জলে ও স্থলে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ে মানুষের নিজেরই কর্মের দোষে।‎ (রুম : ৪১)

তথ্য-৩ وَمَا اَصَابَكَ مِنْ سَيِّئَةٍ فَمِنْ نَفْسِكَ.

 ‎অর্থ: যা কিছু অশুভ ‎‏)‏অকল্যাণ‏(‏‎ তোমার হয় তা তোমার নিজের কারণেই ‎‎(কর্মদোষেই) হয়। ‎ ‏ ‏‎ (নিসা : ৭৯)‎
তথ্য – ৪ اِنَّ اللهَ لاَيَظْلِمُ النَّاسَ شَيْئاً وَّلَكِنَّ النَّاسَ اَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُوْنَ .

‎অর্থ: আল্লাহ কখনো মানুষের ওপর জুলুম করেন না বরং মানুষ নিজেই ‎নিজের উপর জুলুম করে (নিজের কর্মদোষেই নিজের উপর জুলুম ডেকে ‎আনে)। (ইউনুস : ৪৪)

তথ্য – ৫ اِنَّ اللهَ لاَيُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوْا مَا بِاَنْفُسِهِمْ.

 ‎অর্থ: নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতণ ‎পর্যন্ত জাতির লোকেরা (কর্মের মাধ্যমে) নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন না ‎করে। (রাদ :১১)

 ‎
আল-কুরআনের এ সকল এবং তথায় উল্লেখ থাকা এ ধরনের আরো ‎অনেক তথ্য এবং বিবেক-বুদ্ধির আলোকে তাহলে নিশ্চয়তা দিয়েই বলা যায়, ‎কর্মফল বা পরিণতির জন্যে (দুনিয়ায় ও আখিরাতে) মানুষই দায়ী। আর সে ‎‎দায়ী করা ১০০% যুক্তিসংগত।‎

Related Post