উম্মুল মু’মেনীন হযরত উম্মে হাবীবা (রা:)

উম্মুল মু’মেনীন হযরত উম্মে হাবীবা (রা:)

উম্মুল মু’মেনীন হযরত উম্মে হাবীবা (রা:)

তার নাম ছিল রামলা। এ নামেই প্রসিদ্ধ। কারো কারো মতে তার নাম ছিল হিন্দ। কিন্তু নামের তুলনায় কুন্ইয়াত বা ডাক নাম উম্মে হাবীবা বেশি পরিচিত। তার মাতা ছিলেন ছফিয়া ইবনেতে আবিল আছ। ইনি ছিলেন হযরত ওসমান (রা:) এর ফুফী। তার পিতার নাম ছিল আবু সুফিয়ান ছখর ইবনে হারব ইবনে উমাইয়্যা ইবনে আবদে শামস।
নবীজীর নবুয়্যাত লাভের ১৭ বৎসর পূর্বে তার জন্ম হয়। ওবায়দুল্লাহ্ ইবনে জাহাশ ইবনে রুবাবের সাথে তার প্রথম বিয়ে হয়। তিনি ছিলেন বনু আসাদ ইবনে খোযায়মা খান্দানের লোক এবং হারব ইবনে উমাইয়্যার বন্ধু।
হিজরত ও ইসলাম গ্রহণ
স্বামীর সঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং হাবশায় হিজরত করেন। এখানে পৌঁছলে ওবায়দুল্লাহর ঔরসে তার কন্যা সন্তান হাবীবার জন্ম হয়। এ কন্যার নামেই তিনি উম্মে হাবীবা বলে খ্যাত হন। কিছুদিন পর স্বামী ওবায়দুল্লাহ্ ইসলাম ত্যাগ করে খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। তার ধর্ম ত্যাগের পূর্বে হযরত উম্মে হাবীবা তাকে অত্যন্ত বীভৎস আকৃতিতে স্বপ্নে দেখেন। এ স্বপ্নের ফলে তিনি খুব ঘাবড়ে যান এবং মনে মনে বলেন, সত্যিই তার অবস্থা খারাপ বলে মনে হচ্ছে। ভোরে ওবায়দুল্লাহ তাকে বললেন, উম্মে হাবীবা! ধর্মের ব্যাপারে চিন্তা করে বুঝলাম খ্রীষ্টবাদের চেয়ে উত্তম ধর্ম নেই। আমি ইতোপূর্বে মুসলমান হলেও এখন পুনরায় খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহন করছি। হযরত উম্মে হাবীবা খুব তিরস্কার করলেন, স্বপ্নের কথাও বললেন। কিন্তু তার ওপর কোন প্রভাব পড়লোনা কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। শেষ পযর্ন্ত তিনি খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। ধর্মত্যাগীর জীবন যাপন করে মদ্যপান অবস্থায় মৃত্যু বরন করেন।
দ্বিতীয় বিয়ে
স্বামীর ধর্ম ত্যাগের পর উম্মে হাবীবা হাবশায় নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছিলেন। ইদ্দত পূর্ণ হলে মহানবী বিয়ের পয়গাম নিয়ে আমর ইবনে উমাইয়া যামরীকে হাবশার বাদশা নাজ্জাশীর নিকট প্রেরণ করেন। তার পৌঁছা মাত্রই নাজ্জাশী স্বীয় দাসী আবরারার মাধ্যমে উম্মে হাবীবার নিকট রাসুলের বিয়ের পয়গাম পৌঁছান। তিনি একথাও মুখে বলে দেন যে, মহানবী তোমার বিয়ের জন্য আমার কাছে লিখেছেন। বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্য তুমি কাউকে উকীল নিযুক্ত কর। নবীজীর পক্ষ থেকে বিয়ের পয়গামের কথা শুনে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে আবরাহাকে দু’টি রূপার চুড়ি, পায়ের দুটি মল এবং দু’টি রূপার আংটি দান করেন। খালেদ ইবনে সাঈদকে এ সম্পর্কে অবহিত করে তাকে উকীল নিযুক্ত করেন। সন্ধ্যা হলে নাজ্জাশী স্থানীয় মুসলমান এবং জাফর ইবনে আবু তালেবকে ডেকে নিজে বিবাহ পড়ান। মোহরানার চারশ’ দীনারও নিজের পক্ষ থেকে খালেদ ইবনে সাঈদকে দেন। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে সকলে খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলে খালেদ ইবনে সাঈদ দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশ্য বলেন, বিবাহ উপলক্ষ্যে খাওয়ার আয়োজন করা আম্বিয়ায়ে কিরামের সুন্নাত। অতঃপর সকলকে ভোজে আপ্যায়িত করে বিদায় দেন।
এ বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে হিজরী ৬ বা ৭ সালে। তখন উম্মে হাবীবার বয়স ৩৬/৩৭ হবে। বিয়ের পর হাবশা থেকে জাহাজ যোগে রওয়ানা হন। জাহাজ এসে মদীনার বন্দরে ভিড়ে। নবীজী তখন খায়বরে অবস্থান করছিলেন।
তবকাত এবং মুসনাদ ইত্যাদি নিভর্রযোগ্য জীবন চরিত গ্রন্থ থেকে বিয়ের বর্ণনা গৃহীত হয়েছে। বর্ণনার সত্যতা সর্ম্পকে কোন প্রশ্নেই উঠতে পারে না। কিন্তু এ বিবাহে মোহরানার পরিমাণ সম্পর্কে রেওয়ায়েত ঠিক বলে মনে হয় না। আল্লামা ইবনে আবদুল বার, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এসব বিশেষজ্ঞরা নির্ভরযোগ্য সূত্রে লিখেছেন যে, আযওয়াজে মুতাহহারাত এবং নবী দুলালীদের মোহর ছিল চারশ’ দিরহাম। এ ব্যাপারে তেমন মতবিরোধ নেই। এ কারণে মোহরের পরিমাণ নির্ভরযোগ্য নয় বলে মনে হয়।
চরিত্র মাধুর্য
হযরত উম্মে হাবীবা ছিলেন বড় মযবুত ঈমানের অধিকারী মহিলা। এ ব্যাপারে তিনি কারো কোন পরোওয়া করতেন না, তা সে যতবড় বন্ধু এবং আত্মীয়ই হোকনা কেন। তার পিতা আবূ সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণের আগে মহানবীর দরবারে মদীনায় হাযির হন সন্ধির মেয়াদ বৃদ্ধির ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য। এ সময় তিনি স্বীয় কন্যা উম্মে হাবীবাকেও দেখতে পান এবং হযরতের বিছানা মোবারকে বসতে উদ্যত হলে হযরত উম্মে হাবীবা তা গুটিয়ে দেন। নবীজীর বিছানায় পিতার বসাও তিনি বরদাশ্ত করতে পারেননি। এতে আবূ সুফিয়ান অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, কন্যা! তোমার কাছে বিছানাটাই প্রিয় যে, তুমি আমার মুখের দিকেও তাকালেনা? জবাবে তিনি বললেন, পিতা! এটা রাসূলুল্লাহ্ (সা:) এর বিছানা। আপনি যেহেতু মুশরেক, তাই নাপাক। আবূ সুফিয়ান বললেন, আমার পর তুমি অনেক অকল্যাণে জড়িয়ে পড়লে।
হাদীসের ওপর আমল করার ব্যাপারে তিনি ছিলেন কঠোর। এ জন্য অন্যদেরকেও তাকীদ করতেন। একবার তার ভাগ্নে আবূ সুফিয়ান ইবনে সাঈদ আসেন। তিনি ছাতু খেয়ে কুলী না করলে বললেন, তোমার কুলী করা উচিত ছিল। কারণ নবীজী বলেছেন, আগুনে পাকানো জিনিস খেলে অযু করতে হয়। তিনি মহানবীর নিকট শুনেছিলেন, যে ব্যক্তি দৈনিক ১২ রাকাত নফল নামায পড়ে, তার জন্য জান্নাতে ঘর তৈরী করা হবে। হুজুরের এ বাণী তিনি নিষ্ঠার সাথে নিয়মিত পালন করতেন। এ সর্ম্পকে তিনি নিজেই বলেন, অতঃপর আমি নিয়মিত ১২ রাকায়াত নামায পড়তাম।
তার পিতা আবূ সুফিয়ানের ইন্তিকাল হলে খোশবু চেয়ে নিয়ে চেহারা এবং বাহুতে মাখেন এবং বলেন, ঈমানদার নারীর জন্য তিন দিনের বেশি শোক করা জায়েয নেই, অবশ্য স্বামী ছাড়া। স্বামীর জন্য স্ত্রীর শোক করার মেয়াদ হচ্ছে চার মাস দশ দিন। নবীজীকে একথা বলতে না শুনলে এ ব্যাপারে আমার কোন খবরই ছিল না।
ওফাত
হিজরী ৪৪ সালে আমীর মু’আবিয়ার (রা:) শাসনামলে ৭৩ বৎসর বয়সে তিনি ইনতিকাল করেন এবং মদীনা শরীফে তাকে দাফন করা হয়। ইনতিকালের পূর্বে হযরত আয়েশাকে ডেকে বললেন, আমার এবং আপনার মধ্যে সতীনের মতো সর্ম্পক ছিল। কোন ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে মাফ করে দেবেন এবং আমার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করবেন। হযরত আয়েশা দোয়া করে বললেন, আপনি আমাকে খুশি করেছেন, আল্লাহ্ আপনাকে খুশি করুন।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিজ্ঞ এবং বহুগুণের অধিকারীণী। হাদীস শাস্ত্রে তার কয়েকজন শাগরেদ ছিলেন এবং বলা হয়ে থাকে, তার কাছ থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৬৫। নবীজী এবং উম্মুল মুমেনীন হযরত যয়নব ইবনেতে জাহাশ থেকে তিনি এ হাদীসগুলো বর্ণনা করেন। যারা তার কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করা হলো ঃ

হাবীবা ইবনেতে ওবায়দুল্লাহ, মুয়াবিয়া ইবনে আবূ সুফিয়ান, আকীলা ইবনেতে আবূ সুফিয়ান, আবদুল্লাহ ইবনে ওতবা ইবনে সুফিয়ান, আবূ সুফিয়ান ইবনে সাঈদ ইবনুল মুগীরা, সালেম ইবনে সেওয়ার ইবনুল জারারহ্, ছফিয়াহ ইবনেতে শায়বা, যয়নব ইবনেতে উম্মে সালমা, ওরওয়া ইবনে যুবাইর, আবূ ছালেহ সাম্মান প্রমুখ।
তার কবর সর্ম্পকে একটি বিস্ময়কর বর্ণনা রয়েছে। আল-এস্তীআব গ্রন্থ রচয়িতা লিখেছেন যে, যয়নুল আবেদীন (রা:) তার গৃহের একাংশ খনন করলে একটা শিলালিপি পাওয়া যায়। এতে লেখা ছিল ঃ هذا قبر رملة بنت صخر.
এটা রামলা ইবনেতে ছাখর এর কবর। তিনি এটা দেখে শিলালিপিটি যথাস্থানে রেখে দেন। এ থেকে জানা যায় যে, তার কবর ছিল হযরত আলীর (রাঃ) ঘরে। তার দফন সর্ম্পকে এর চেয়ে বেশি কিছু জানা যায়নি।

Related Post