Originally posted 2013-06-05 17:00:14.
যাকাত একটি ফরজ ইবাদত। ইসলামের মৌলিক পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয় স্তম্ভ। নামাজের পরেই যাকাতের স্থান। জাকাত কী এ কথার সহজ উত্তর হলো : জাকাত আল্লাহ তায়ালার নির্দেশানুযায়ী ঈমানদারদের জন্য অবশ্যপালনীয় একটি ইবাদত। ঈমানের সাথে সম্পৃক্ত একটি প্রত্যয়। একটি বিশ্বাস। একটি অনুভূতি। সামাজিক নিরাপত্তার জন্য যাকাত অত্যন্ত ফলপ্রসূ একটি ব্যবস্থা। গরীব ও দুস্থদের জন্য একটি হক। যাকাত কোনো প্রকার দান বা অনুকম্পা নয়।
যাকাত অর্থ ও সম্পদ হস্তান্তরের একটি কৌশল। একটি প্রক্রিয়া। সুষম অর্থব্যবস্থার অন্যতম হাতিয়ার হলো যাকাত। সম্পদ বিকেন্দ্রীকরণে যাকাত একটি অন্যতম প্রক্রিয়া। যাকাত আয়ের বৈষম্য দূরীকরণে একটি পদ্ধতি। সমষ্টিগত অর্থনৈতিক মৌল কাঠামো নির্মাণে এটি একটি অন্যতম উপাদান।
যাকাত সমাজের বঞ্চিতদের অর্থনৈতিক সাহায্যপ্রাপ্তির একটি উপায়। আর্থসামাজিক উন্নয়নে যাকাত অত্যন্ত ফলপ্রসূ একটি ব্যবস্থা। সর্বোপরি যাকাত মানুষের মানবীয় ও আধ্যাত্মিক সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে সহায়ক। যাকাতের কল্যাণধর্মিতা বহুমাত্রিক। সমকালীন কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যাকাতের বিকল্প নেই।
যাকাতের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পবিত্রকরণ, পরিশুদ্ধীকরণ, বৃদ্ধি পাওয়া, বরকতময় হওয়া, বিশুদ্ধ হওয়া। পবিত্র কুরআন মজীদে যাকাতের বিকল্প শব্দ হিসেবে সাদাকাহ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আল-কুরআনের অনেক জায়গায় যাকাত শব্দের উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে আবার অনেক জায়গায় যাকাত সালাতের সাথে বিধৃত হয়েছে। সঞ্চিত বা উপার্জিত মালের পরিমাণ একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে তার অংশবিশেষ নির্দিষ্ট ব্যক্তির অনুকূলে ও নির্ধারিত খাতে ব্যয় করতে হয়, যা ইসলামী পরিভাষায় যাকাত বলে খ্যাত। এ ছাড়া অন্যভাবেও যাকাতের সংজ্ঞা প্রদান করে বলা হয়েছে : প্রত্যেক সাহেবে নিসাব মুসলমান তার মাল ও সম্পদ থেকে ইসলামী শরীয়তে নির্ধারিত অংশটুকু নির্ধারিত হকদারকে দিয়ে দেয়াকে যাকাত বলে। আরো একটি সংজ্ঞা এরূপ: উৎপাদিত বস্তুতে পুঁজি ও শ্রমের যেমন অধিকার আছে তেমনি তৃতীয় উপকরণ ঐশ্বরিক দানের জন্যও একাংশ স্থিরকৃত থাকা উচিত তাই যাকাত। আরো বলা হয়েছে, যাকাত হচ্ছে বিত্তবানদের ধনসম্পদে আল্লাহ-নির্ধারিত সেই অপরিহার্য অংশ যা সম্পদ ও আত্মার পবিত্রতা বিধান। সম্পদের ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং সর্বোপরি আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের আশায় শরীয়ত-নির্ধারিত খাতে ব্যয় বন্টন করার জন্য দেয়া হয়।
ইসলামী বিধিব্যবস্থাকে খাটো করা অথবা হেয় করার উদ্দেশ্যে কেউ কেউ বলে থাকেন যাকাত ও কর এক ও অভিন্ন। তারা মুনাফা ও সুদকেও অনুরূপভাবে অথবা মনগড়াভাবে উপস্থাপন করে থাকেন। অথচ যাকাত ও কর এর মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। যাকাত মহান আল্লাহ তায়ালার একটি নির্দেশ যা ফরজ ইবাদত হিসেবে বাস্তবায়ন হয়। পক্ষান্তরে কর রাষ্ট্র কর্তৃক একশ্রেণীর নাগরিকের ওপর আরোপিত হয়ে থাকে। যাকাত ঈমানদার স্বেচ্ছাপ্রণোদিত প্রদান করে। অপর দিকে নাগরিকবৃন্দ কর বাধ্য হয়ে পরিশোধ করে। যাকাত ব্যয়ের নির্ধারিত আটটি খাত স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা নির্ধারিত করে দিয়েছেন। কর সরকারী কোষাগারে জমা হয়। কর ব্যয়ের নির্ধারিত কোনো খাত নেই।
যাকাতের উদ্দেশ্য পর্যালোচনা করা হলে দেখা যায়, যাকাতের উদ্দেশ্য দু টি। এক. যাকাত অর্থ পবিত্রকরণ, পরিশুদ্ধীকরণ, বৃদ্ধি। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে ব্যক্তির আত্মা ও সম্পদ পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হয়। দুই. যাকাতের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস পায়। সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে যাকাত অত্যন্ত ফলপ্রসূ মেকানিজম হিসেবে কাজ করে।
যাকাতের তিনটি দিক বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এই তিনটি দিক হলো : অর্থনৈতিক, সামাজিক, মানবীয় ও আধ্যাত্মিক দিক। নিম্নে বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে দেখা যাক।
যাকাত দানের মাধ্যমে সম্পদের নির্দিষ্ট একটা অংশ ধনীদের কাছে থেকে গরীব-দুস্থদের মধ্যে হস্তান্তরিত হয়। ফলে গরীব-দুস্থরা অর্থনৈতিকভাবে কিঞ্চিত হলেও লাভবান হওয়ার সুযোগ লাভ করে। সমাজে তাদের পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিত্তবান ও বিত্তহীনদের মধ্যে এতে সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়। আরো দেখা যায়, আয়ের ক্ষেত্রে সামান্য হলেও আয় বৃদ্ধি পায়।
যাকাত সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখার প্রবণতা হ্রাস করে। অর্থসম্পদ অনুৎপাদনশীল খাতে সঞ্চয় করে রাখার প্রবণতাও অনেকটা দূর করে। যাকাত সম্পদ বন্টনব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করে। সমষ্টিগত অর্থনৈতিক মৌল কাঠামো নির্মাণে যাকাত ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। মানুষ এ পৃথিবীতে সম্পদের আমানতদার মাত্র। নিজের প্রয়োজন অতিরিক্ত সম্পদ কাজে লাগিয়ে উদ্বৃত্ত সম্পদ থেকে মানবকল্যাণে ব্যয় করবে,এটি ইসলামের অন্যতম একটি চেতনা। আর এটা করা হলে সম্পদ ও আয় পুনর্বন্টনে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়ে।
সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যাকাতের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা লক্ষ করা যায়। বিত্তবানদের উপার্জিত সম্পদ ও আয়ে গরীব-দুস্থদের অধিকারকে পবিত্র কুরআন মজীদে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। যাকাতের মাধ্যমে বিত্তবানদের সম্পদ ও আয়ের কিয়দংশ গরীব ও দুস্থদের কাছে হস্তান্তরিত হয়। এর দ্বারা কিছুটা হলেও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা হয়। সম্পদ ও আয় এভাবে হস্তান্তরের মাধ্যমে একটা বন্টনগত মেকানিজম অথবা একটা শিফটিং মেকানিজমের উন্মেষ ঘটে। সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এর বড়ই প্রয়োজন রয়েছে।
যাকাত স্বনির্ভরতা অর্জনে সাহায্য করে: যাকাতের অর্থ পেয়ে একজন বিত্তহীন তার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে সামাজিক ভারসাম্য সৃষ্টি হয় এবং সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। যাকাত একজন দুস্থ বা গরীবকে নিজ পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে। সমাজের কম ভাগ্যবান এই বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করা সমাজের সঙ্গতিপূর্ণ এবং ধনী জনগোষ্ঠীর জন্য নৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়।
সঞ্চিত অর্থের ওপর যাকাত প্রদানের বিধান মানুষকে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করে: রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা হলে বিনিয়োগ প্রবণতা আরো বৃদ্ধি পাবে এবং অলস সঞ্চয়ের প্রবণতা আস্তে আস্তে হ্রাস পাবে। ফলে উদ্বৃত্ত সম্পদ ও অর্থ বিনিয়োগের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। আধুনিক অর্থনীতিতে উদ্বৃত্ত অর্থ ও সম্পদের ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
আধুনিক অর্থনীতিতে উদ্বৃত্ত সম্পদের সমষ্টিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফসল মনে করা হয়। ইসলাম উদ্বৃবৃত্ত সম্পদের ওপর যাকাত প্রবর্তন করেছে। কেউ কেউ মনে করে থাকেন উদ্বৃত্ত সম্পদ সৃষ্টিতে মানুষ নিরুৎসাহিত হবে। ইসলামী অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত মালিকানার সম্পর্ক অন্যান্য অর্থনৈতিক মতাদর্শ থেকে ভিন্নতর।
মার্কসীয় দর্শনে বলা হয়, পুঁজিবাদী পদ্ধতিতে উৎপাদনপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুঁজিপতিরা উদ্বৃত্ত সম্পদ সৃষ্টি করে। এ ক্ষেত্রে শ্রমিকরা উদ্বৃত্ত সম্পদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে একমাত্র হাতিয়ার। সমাজতান্ত্রিক দর্শনে সম্পদ শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ তায়ালা। মানুষ আমানতদার মাত্র। সম্পদে গরীব-দুস্থদের হক স্বীকৃত। বলা যায়,শক্তি প্রয়োগ ছাড়াই সম্পদ সমাজের।
মার্কসীয় দর্শনে উদ্বৃত্ত সম্পদে ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদপূর্বক রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ কায়েম প্রতিষ্ঠা করে জোরপূর্বক রাষ্ট্রীয় অধিকারে নিয়ে নেয়াই উদ্বৃত্ত সম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একমাত্র সমাধান। ইসলাম মনে করে আয় ও ব্যয়ের ব্যালান্স থেকে উদ্বৃত্ত সম্পদের সৃষ্টি ব্যক্তির কী আছে এবং প্রয়োজনপূরণে কী দরকার। এ দুয়ের পার্থক্য দ্বারা উদ্বৃত্ত পরিমাপ করা হয়। ইসলাম উদ্বৃত্ত সম্পদ থেকে কিয়দংশ সমাজের কম সঙ্গতিসম্পন্ন ও গরীব-দুস্থদের কাছে পৌঁছাতে চায়। উদ্বৃত্ত সম্পদ বিনিয়োগপূর্বক প্রাপ্য লভ্যাংশ থেকে ইসলাম শ্রমিককে হিস্সা দিতে চায়।
সুতরাং যাকাত সাধারণ কোনো দান নয়। অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব বিদ্যমান। উদ্বৃত্ত সম্পদ থেকে যাকাতের মাধ্যমে কিয়দংশ গরীব-দুস্থদের মধ্যে হস্তান্তরের দ্বারা সম্পদ ও আয়ের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য কিছুটা হলেও হ্রাস পায়। ফলে এ কথা বলা যায়,যাকাত কল্যাণকর একটি ব্যবস্থা।