যাকাতের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য :

111

১. যাকাত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যতম রুকন বা স্তম্ভ। এটি নিছক একটি নেক কাজ ও ভালো অভ্যাসই নয় চারটি প্রধান ইবাদতের অন্যতম একটি ইবাদত। যার অস্বীকার করা কুফরির সামিল।

২. যাকাত ধনীদের ধন-মালে গরিবদের সুনির্দিষ্ট হক। ধন-মালের প্রকৃত মালিক মহান আল্লাহই যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এতে গরিবদের উপর ধনীদের অনুগ্রহের কোনো ভাবধারা নেই।

৩. হক সুপরিজ্ঞাত। ইসলামী শরিয়াতই যাকাতের নিসাব ও পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এর সীমা ও শর্ত নির্ধারিত।  প্রত্যেকটি মুসলিমই জানে তার দলিল প্রমাণ।

৪. এ অধিকারটি ব্যক্তিদের মনের ভালোলাগা না লাগার উপর ছেড়ে দেয়া হয়নি। তা সংগ্রহ বা আদায় করা ন্যায়নীতির ভিত্তিতে এবং বণ্টন করা ইনসাফের নীতি অনুযায়ী সরকারের ওপর অর্পিত দায়িত্ব। আর তা করা হবে এ কাজে নিযুক্ত বিশেষ কর্মচারীর মাধ্যমে এবং সরকার কর্তৃক ধার্যকৃত করের মতই তা আদায় করা হবে।

৫. এই ফরজ কাজ করতে অর্থাৎ যাকাত দিতে অস্বীকারকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকেই সরকার শাস্তি দেবে।

৬. যাকাত বাবদ সংগৃহীত সম্পদ শাসক-প্রশাসকদের খামখেয়ালীর উপর ছেড়ে দেয়া যাবে না। এজন্য ইসলাম তার সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে এবং পাওনাদারদের তালিকাও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে।

৭. গরিবদের উপস্থিত প্রয়োজন পূরণ কিংবা তাদের সাময়িক দৈন্য-দুর্দশা বিদূরণের জন্য এ যাকাত কোনো বদান্যতার ব্যাপার নয়। আসল লক্ষ্য হচ্ছে দারিদ্র্যের উপর চূড়ান্ত আঘাত হানা, দরিদ্রদের দারিদ্র্য থেকে চিরমুক্তির ব্যবস্থা করা।

৮. কুরআন নির্ধারিত ও সুন্নাত কর্তৃক বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যাকৃত যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্রসমূহের প্রতি দৃষ্টি দিলে স্পষ্ট হয় যে, তা দিয়ে বহু সংখ্যক আত্মিক, নৈতিক, সামাজিক, ও রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করাই উদ্দেশ্য। এ কারণে যাদের মন জয় করতে হবে, যারা বন্দী, ঋণগ্রস্ত এবং আল্লাহর পথে এ সবকে ব্যয়ের ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

তাই যাকাত ইসলামী সমাজে এমন এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে সামাজিক ও সামষ্টিক নিরাপত্তামূলক ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠনের কার্যকর মাইলফলক।

যাকাত মুমিনের অর্থনৈতিক জীবনে ঈমানের প্রতিনিধি : মুসলিম ব্যক্তি মাত্রই অনুভব করে যে, যাকাত তার ও তার সরকার বা আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যবর্তী সম্পর্কের ব্যাপার নয়, বরং সবকিছুর পরিবর্তে তা তার ও আল্লাহর মধ্যকার সম্পর্কের ব্যাপার। আর বস্তুত তাই  হচ্ছে ঈমানের প্রকৃত দাবি।

কাজী আবু বকর ইবনুল আরাবী আল খালেকী লিখেছেন, প্রকৃত পাওনাদার তো স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। কিন্তু তিনি তাঁর এ পাওনাদার অধিকারটি তাদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, যাদের রিজিকের দায়িত্ব তিনি নিজে গ্রহণ করেছেন এ বলে, ‘পৃথিবীতে যে কোন প্রাণীই রয়েছে, তারই রিজিকের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহর ওপর বর্তেছে। সূরা হুদ।

যাকাতের মূল কথা হচ্ছে, ধন-মালের নিসাব পরিমাণ থেকে একটা অংশ আল্লাহর জন্যে বের করে দেয়া তা তারই উদ্দেশ্যে সমর্পিত করা। অর্থাৎ মালিকানার অধিকার নিজের উপর থেকে তুলে নিয়ে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বকারীর হস্তে সোপর্দ করা আল্লাহর কাছেই সমর্পণ করার লক্ষ্যে। সূরা তওবায়  তাই বলেছেন, ‘এ লোকেরা কি জানে না যে, আল্লাহ নিজেই তওবা কবুল করে থাকেন তাঁর বান্দাগণের পক্ষ থেকে এবং সাদকা দান গ্রহণ করেন।’

যাকাত অর্থ পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা। নিজের ধন সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ গরিব মিসকিন ও অভাবী লোকদের মধ্যে বণ্টন করাকে যাকাত বলা হয়। কারণ এর ফলে সমগ্র ধন-সম্পত্তি এবং সেই সাথে তার নিজের আত্মার পরিশুদ্ধি হয়ে থাকে। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রদত্ত ধন-সম্পদ তাঁর বান্দাদের জন্য নির্দিষ্ট অংশ ব্যয় করতে চায় না, তার সমস্ত ধন অপবিত্র এবং সেই সাথে তার নিজের মন ও আত্মা পঙ্কিল হতে বাধ্য। কারণ হৃদয়ে কৃতজ্ঞতার নাম মাত্র বর্তমান নেই। তার অন্তর এতদূর সংকীর্ণ যে, এতদূল স্বার্থপর এবং এতদূর কৃপণ যে, যে আল্লাহর অনুগ্রহপূর্বক তাকে প্রয়োজনাতিরিক্ত ধন-সম্পদ দান করেছেন তাঁর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতেও তার মন কুণ্ঠিত হয়। সুতরাং বলা যায়, যে ব্যক্তি যথাযথভাবে যাকাত আদায় করে না, তার দিল নাপাক, আর সেই সাথে তার সঞ্চিত অর্থ ধন-মালও অপবিত্র তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

যাকাত ফরজ করে আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেকটি মানুষকে এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন। যে ব্যক্তি ইচ্ছানুক্রমেই প্রয়োজনাতিরিক্ত ধন-মাল হতে আল্লাহর নির্দিষ্ট হিস্যা আদায় করে এবং আল্লাহর বান্দাহদের যথাসাথ্য সাহায্য করে, বস্তুত সে ব্যক্তিই আল্লাহর কাজ করার উপযুক্ত, ঈমানদার লোকদের মধ্যে গণ্য হওয়ার যোগ্যতা তারই আছে। পক্ষান্তরে যার দিল এতদূর সংকীর্ণ যে, আল্লাহর জন্য এতটুকু কোরবানি করতে প্রস্তুত হয় না, তার দ্বারা আল্লাহর কোন কাজই সাধিত হতে পারে না।  সে ইসলামী সমাজে  গণ্য হবার যোগ্য নয়। এজন্য রাসূলে করিম (সা.) এর ইন্তেকালের পর আরব গোত্রের যে অংশ যাকাত দানে অস্বীকার করেছিল হযরত আবু বকর (রা.) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন। অথচ তারা নামাজ পড়তো এবং আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমানও রাখতো। এতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, যাকাত আদায় না করলে নামাজ রোজা ইত্যাদি কোনোটাই আল্লাহর কাছে গৃহীত হতে পারে না। আর এরূপ ব্যক্তির ঈমানদার হওয়ার দাবি করার আদৌ কোনো মূল্য নেই।

ঈমানদার পুরুষ এ ঈমানদার স্ত্রী লোকেরাই প্রকৃতপক্ষে পরস্পর পরস্পরের বন্ধু ও সাহায্যকারী। এদের পরিচয় এবং বৈশিষ্ট্য এই যে, এরা নেক কাজের আদেশ দেয়, অন্যায়  পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। নামাজ কায়েম করে এ যাকাত আদায় করে, আল্লাহ ও রাসূলের বিধান মেনে চলে। প্রকৃতপক্ষে এদের প্রতিই আল্লাহ রহমত বর্ষণ করবেন। (সূরা তাওবা ৭১)

অন্য কথায় কোনো ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত ঈমান এনে কার্যত নামাজ ও যাকাত আদায় না করবে, ততক্ষণ সে মুসলমানদের দ্বীনী ভাই রূপে পরিগণিত হতে পারবে না। বস্তুত ঈমান, নামাজ, যাকাত এ তিনটি জিনিসের সমন্বয়েই ঈমানদার লোকদের দল গঠন হয়। যারা এ কাজ যথারীতি করে তারা সবাই একই সমাজের অন্তর্ভুক্ত এবং পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্ব, ভালোবাসা ও সহানুভূতির সম্পর্ক স্থাপিত হবে। সত্যিকার ঈমানদার ব্যক্তি যাকাতকে তার উপর জুলুম মনে করে না। মনে করে না যে, যাকাত দিতে বাধ্য করে তার উপর কোনোরূপ অবিচর করা হয়েছে। কেননা, এর বিধান প্রবর্তনকারী কোনো মানুষ তো নয় যে, যে পক্ষপাতিত্ব করবে বা অবিচার করবে  তার ঈমান তাকে বলে দেয় যে, তিনি সুবিচারপূর্ণ বিধান প্রবর্তক, যিনি বান্দাদের উপর জুলুম করেন না। কেননা তিনিই তো রাব্বুল ইবাদত  সমস্ত মানুষের মাবুদ ও রব।

আর যাকাত যখন ব্যক্তি ও তার আল্লাহর মধ্যকার সম্পর্কের মাধ্যমে সর্বোচ্চ পর্যায়ে, তখন সে লোক কি করে যাকাত ফাঁকি দিতে পারে তাঁর বিধান অমান্য করে, যাঁর কাছে কোনো কিছুই গোপন থাকতে পারে না, যিনি গোপন প্রকাশ্য সব কিছুই জানেন, সে লোক এত জানে যে, আল্লাহ তার হিসাব নেবেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সেদিন, যেদিন মানুষ রাব্বুল আলামীনের সমীপে দাঁড়িয়ে সব কাজের হিসাব দেবে। সহিহ ঈমান মুসলিম ব্যক্তির মন মগজে যে ইসলামী চরিত্রের বীজ বপণ করে তাই যাকাত আদায় হওয়ার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে।

মুসলিম ব্যক্তির লালন-প্রশিক্ষণ হয় দুনিয়ার প্রতি অনাশক্তির ভাবধারায় এবং পরকালীন কল্যাণের প্রতি আগ্রহ উৎসাহ সৃষ্টির মাধ্যমে। আল্লাহর কাছে যা আছে, তা পাওয়াই হয় তার বড় কামনা ও বাসনা। এজন্য আল্লাহর পথে ব্যয় করতে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসাকে সবকিছুর উপর অগ্রাধিকার দিতে সে সব সময়ই প্রস্তুত থাকে। এ পর্যায়ে রাসূলে করিম (সা.) এর যুগের একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরা হলো যাকাত আদায়ের ব্যাপারে। উবাইদ ইবন কাসাব থেকে বর্ণিত  তিনি বলেছেন, একবার রাসূলে করিম (সা.) আমাকে যাকাত আদায়কারী বানিয়ে পাঠালেন। আমি এক ব্যক্তির নিকট পৌঁছলাম। আমার সামনে তার সব মাল উপস্থিত করলে আমি দুই বছরের একটি উষ্ট্রী ছাড়া যাকাত নেবার জন্য আর কিছু পেলাম না। লোকটি আমাকে বলল  এটি যাকাত হিসেবে নেবেন। এর তো দুধও নেই পিঠও নেই। বরং যৌবন বয়সের একটি মোটা তাজা উট দেখিয়ে বললো এটি নিয়ে যান। আমি নবী করিম (সা.)-এর অনুমতি ছাড়া এটি নিতে অস্বীকার করলাম। লোকটি অবশেষে সেটিকে রাসূল (সা.)-এর কাছে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, আমি আল্লাহকে এমন জন্তু ‘করয’ দেব না, যার দুধও নেই, পিঠও নেই’। রাসূল (সা.) বললেন, এটিই তোমার দেয়া। তা সত্ত্বেও যদি অতি উত্তম জিনিস নফল হিসেবে দান কর তাহলে আল্লাহই তোমাকে সে জন্য পুরস্কৃত করবেন। সে লোক বিশ্বাস করতো যে, তার ও আল্লাহর মধ্যকার সম্পর্ক সর্বাগ্রে। যে আল্লাহকে যে উট ‘করয’ দিতে লজ্জাবোধ করছিল, যার দ্বারা কোনো ফায়দা পাওয়া যাবে না। সেটির পিঠ নেই বলে পৃষ্ঠে সওয়ার হওয়া চলবে না, ওলান নেই বলে দুধও দোহানো যাবে না।

বস্তুত এ দ্বীনী নিশ্চয়তাই হচ্ছে যাকাত ফাঁকি দেয়া থেকে বাঁচাতে নির্ভরযোগ্য রক্ষাকবচ।

এসব দ্বীনী ও নৈতিক নিশ্চয়তার প্রধান নির্ভর হচ্ছে মানুষের মন-মানসিকতা ও ঈমানের উপর। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিভিন্নভাবে ও পর্যায়ে ঈমানের এ পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। বিভিন্ন পর্যায়ে বাছাই করেন, প্রথমত তিনি দেখেন তার প্রতি রাসূল প্রদত্ত বিধানের প্রতি কারা ঈমান এনেছে। দ্বিতীয়ত, তাদের নৈতিক চরিত্র যাচাই করে থাকেন, তৃতীয়ত, তাদের আল্লাহর অনুসরণ ও আনুগত্য স্বীকারে প্রবণতা যাচাই করেন। চতুর্থত, ধন-সম্পদের কুরবানির মাধ্যমে পঞ্চমত, জীবনের সর্বোচ্চ সম্পদ জানের কুরবানির মাধ্যমে।

আল কুরআনের বাণী ‘আল্লাহর পথে তাদের দান শুধু এজন্যই কবুল করা যায় না যে, মূলত আল্লাহ এবং রাসূলের প্রতি তাদের ঈমান নেই; নামাজের জন্য তারা আসে বটে, কিন্তু মনু  হয়ে; আর টাকাপয়সাও তারা দান করে, কিন্তু বড়ই বিরক্তি সহকারে’। (সূরা তওবা ৫৪)।

সর্বোপরি যাকাত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ এটাই মূল কথা। একে প্রচলিত সরকারি ট্যাক্সের মত মনে করা মারাত্মক ভুল। কারণ আসলে এটা ইসলামের প্রাণ, ইসলামের জীবনী শক্তি। যাকাত ফরজ করার মূলে ঈমানের পরীক্ষা করাই হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য। ক্রমাগত পরীক্ষা দিয়ে এক একজন মানুষ যেমন উন্নতি লাভ করে থাকে এবং সর্বশেষ পরীক্ষা দিয়ে ডিগ্রি লাভ করে, অনুরূপভাবে আল্লাহও মানুষের ঈমান যাচাই করার জন্য কতগুলো পরীক্ষা নির্দিষ্ট করে দেন; প্রত্যেক মানুষকেই এ পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। যাকাতও হচ্ছে ব্যক্তির জীবনে পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হওয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। এভাবে সে খাঁটি মুসলমান হওয়ার একেকটি পর্যায় অতিক্রম করে চূড়ান্ত মুসলিম হবার সৌভাগ্য লাভ করে। তবে মুমিনের জীবনে এটাই সর্বশেষ পরীক্ষা নয়। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর রাহে সর্বোচ্চ কুরবানির প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের কবুল করুন। 

 

Related Post