Originally posted 2013-07-12 14:29:31.
শেষ পাঠ
আল্লাহর দলে কেবল এমন লোকদের ভর্তি করা যেতে পারে, যারা কেউ তাদের শত্রুতা করলেও, তাদেরকে দু:খ দিলেও,তাদের ক্ষতিসাধন করলেও এবং তাদের কলিজাকে টুকরো কুকরো করলেও-কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই তারা পেটের খাদ্য এবং পরণের কাপড় দিতে অস্বীকার করবে না এবং বিপদের সময় তার সাহায্য করতেও কুণ্ঠিত হবে না:
তোমাদের মধ্যে যারা বড় এবং সংগতি সম্পন্ন লোক তারা যেন নিজেদের প্রিয়জনদের,নিকটাত্মীয়দের,গরীব-দু:খীদের এবং আল্লাহর পথে হিজরতকারীদের (কোনো অপরাধের জন্য বিরক্ত হয়ে তাদেরকে) সাহায্য দান বন্ধ না করে। বরং তাদেরকে মাফ করে দেয়াই বাঞ্ছনীয়। আল্লাহ তোমাদের মাফ করে দেন তা কি তোমরা দাও না? অথচ আল্লাহ তাআলা সবচেয় বড় ক্ষমাশীল এবং দয়াবান। সূরা আন নূর: ২২
এ দলে এমন লোকদের আবশ্যক, যারা আল্লাহর দেয়া ধন-সম্পদ থেকে বেছে বেছে ভাল ভাল জিনিস আল্লাহর জন্যই খরচ করে:
১. হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর জনৈক প্রিয় লোক যখন তাঁর কন্যা হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার চরিত্র সম্পর্কে অপবাদ দেয়ার ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করেছিল এবং হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার প্রতি অসন্তষ্ট হয়ে তার আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছিলেন তখন এই আয়াতটি নাযিল হয়। আয়াতটি নাযিল হওয়ার সাথে সাথে তিনি কম্পিত ও ভীত হয়ে বললেন:আমি আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাই এবং তখনই তিনি সেই লোকটির আর্থিক সাহায্য পুনরায় জারি করলেন।
হে ঈমানদার! তোমরা নিজেরা যে ধন-সম্পত্তি উপার্জন করেছ এবং আমি তোমাদের জন্য যমীন থেকে যে রিযক দিয়েছি তা থেকে ভাল ভাল সামগ্রী (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর। খারাপ দ্রব্য থেকে কিছু সেই পথে খরচ করো না। (সূরা আল বাকারা : ২৬৭) এখানে এমন বড় আত্মার লোকদের আবশ্যক,যারা নিজেদের অভাব-অনটন, দারিদ্র ও রিক্ততার দুঃসহ অবস্থায় নিজেদের অপরিহার্য প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করাকে তারা নিষ্ফল মনে করবে না। বরং তারা একান্তভাবে বিশ্বাস করবে যে,আল্লাহর পথে যাকিছু খরচ করা যায়,দুনিয়া এবং আখেরাত তিনি তার উত্তম ফল দান করবেন। এজন্য তারা কেবল আল্লাহর সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যেই খরচ করে। তাদের এ দানশীলতার কথা দুনিয়ার প্রচার হোক না হোক কিংবা কেউ তার দানের শুকরিয়া আদায় করুক বা না করুক সে দিকে কিছুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করে না:
তোমরা আল্লাহর পথে যা কিছু খরচ করবে তা তোমাদেরই কল্যাণ সাধন করবে- অবশ্য যদি তোমরা সেই খরচের ব্যাপার আল্লাহ ছাড়া আর কারো সন্তুষ্টি পেতে না চাও। এভাবে তোমরা ভাল কাজে যা কিছু দান করবে তার পূর্ণ ফল তোমরা লাভ করবে। সে দিক দিয়ে তোমাদের প্রতি বিন্দু পরিমাণও যুলুম করা হবে না। সূরা আল বাকারা : ২৭২
ধনী হয়ে সুখের মধ্যে ডুবে থেকেও যারা আল্লাহকে ভুলে যায় না, আল্লাহর দলে এ ধরনের ধীর প্রকৃতির লোকদেরই দরকার। তারা বড় বড় প্রাসাদে সুখ ও সম্ভোগের ভিতরে থেকেও আল্লাহকে ভুলে যাবে না:
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের সম্পদ আর সন্তান যেন তোমাদেরকে কখনও আল্লাহর যিকর থেকে বিরত না রাখে। এসবের জন্য যারা আল্লাহকে ভুলে যাবে তারা বড়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সূরা মুনাফিকূ: ৯
ওপরে বর্ণিত গুণাবলী আল্লাহ তাআলার দলের লোকদের মধ্যে বর্তমান থাকা অপরিহার্য। এছাড়া কোনো ব্যক্তি আল্লাহর বন্ধুদের মধ্যে গণ্য হতে পারে না। বস্তুত এটা মানুষের শুধু নৈতিক চরিত্রেরই নয়, তার ঈমানেরও বড় কঠিন এবং তিক্ত পরীক্ষা। আল্লাহর পথে খরচ করতে যে ব্যক্তি কুণ্ঠিত হবে, এরূপ খরচকে যে নিজের ওপরে জরিমানা বলে মনে করবে, কৌশল ও শঠতা করে তা থেকে যে আত্মরক্ষা করতে চায়, আর কিছু খরচ করলেও সে জন্য লোকের প্রতি নিজের অনুগ্রহ প্রকাশ করে মনের জাল মিটাতে চায় কিংবা নিজের বদান্যতার কথা দুনিয়ায় প্রচার করতে চায়, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি এমন লোকদের আদৌ ঈমান থাকতে পারে না। সে মনে করে, আল্লাহর জন্য সে যা কিছু করেছে, তা একেবারে নিষ্ফল হয়েছে। তার নিজের সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ, নিজের স্বার্থ ও খ্যাতিরেই সে আল্লাহ এবং তাঁর সন্তষ্টি অপেক্ষাও বেশী প্রিয় বলে মনে করে। তার মতে এ দুনিয়াটাই সবকিছু। টাকা-পয়সা খরচ করলেও এ দুনিয়ায়ই সে জন্য সুনাম ও খ্যাতি লাভ হওয়া আবশ্যক। কারণ তাহলে সে টাকার বিনিময় এখানেই পাওয়া যেতে পারে। নতুবা টাকাও খরচ করলো আর কেউ জানতেও পারলো না যে, অমুক ব্যক্তি ভাল কাজে এতগুলো টাকা দিয়ে দিয়েছে, তবে তা সবই অর্থহীন হয়ে যায়। কুরআন মজীদে পরিষ্কার বলে দেয়া হয়েছে যে, এ ধরনের মানুষ আল্লাহর কোনো কাজেই আসতে পারে না। সে যদি নিজেকে ঈমানদার বলে প্রচার করে তথাপি সে ঈমানদার তো নয়ই বরং সে প্রকাশ্য মুনাফিক নিন্মের আয়াতগুলো তার প্রমাণ:
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের দানকে অন্যের ওপরে নিজের অনুগ্রহ প্রচার করে বা কাউকে কষ্ট দিয়ে তার মতো নিষ্ফল করে দিও না, যে ব্যক্তি শুধু অন্যকে দেখাবার জন্য কিংবা সুনাম কিনার জন্য অর্থ ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস রাখে না।
যারা স্বর্ণ এবং রৌপ্য সঞ্চয় করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না, তাদেরকে কঠিন শাস্তির সুসংবাদ দাও। সূরা তাওবা : ৩৪।
হে নবী! যারা আল্লাহ ও পরকালকে বিশ্বাস করে, তারা নিজেদের জান-মালসহ জিহাদে যোগদান করার কর্তব্য থেকে দূরে সরে থাকার জন্য কখনও অনুমতি চাইবে না। আল্লাহ তাআলা প্রকৃত মুত্তাকী বান্দাহগণকে খুব ভাল করেই জানেন। অবশ্য সেসব লোক ওজর আপত্তি করতে পারে, আল্লাহ ও পরকালের প্রতি যাদের আদৌ বিশ্বাস নেই-যাদের মনের মধ্যে সন্দেহ জমাট বেঁধে রয়েছে এবং নিজেদের সন্দেহের মধ্যে নিমজ্জিত থেকেই ইতস্তত করে। সূরা আত তাওবা : ৪৪-৪৫
আল্লাহর পথে তাদের দান শুধু এজন্যই কবুল করা যায় না যে, মূলত আল্লাহ এবং রাসূলের প্রতি তাদের ঈমান নেই; নামাযের জন্য তারা আসে বটে; কিন্তু মনক্ষুণ্ন হয়ে; আর টাকা-পয়সাও তারা দান করে, কিন্তু বড়ই বিরক্তি সহকারে । সূরা আতাওবা : ৫৪
মুনাফিক পুরুষ আর মুনাফিক স্ত্রী সব এব একই দলের লোক-একে অন্যের সাহায্যকারী। এরা সকলেই মিলে অন্যায়ের আদেশ করে, ন্যায় ও সত্যকে নির্মূল রাখে। এরা সকলেই আল্লাহকে ভুলে গেছে। তাই আল্লাহ তাদেরকে ভুলে গেছেন। এসব মুনাফিক যে ফাসেক (আল্লাহর নির্ধারিত সীমালংঘনকারী) তাতে সন্দেহ নেই। সূরা আত তাওবা : ৬৭
এ আরাব (মুনাফিকদের) অনেকেই আল্লাহর রাস্তায় কিছু খরচ করলেও তা করে একান্তভাবে ঠেকে-যেন জরিমানা আদায় করছে।
জেনে রাখ, তোমাদের অবস্থা এতদূর খারাপ হয়ে গিয়েছে যে, তোমাদের আল্লাহর রাস্তায় কিছু খরচ করতে বললে তোমরা সেজন্য মোটেই প্রস্তুত হও না বরং তোমাদের অনেকেই তখন কৃপণতা করতে থাকে। অথচ যে ব্যক্তি এসব কাজে কৃপণতা করে সেই কৃপণতায় তার নিজেরই ক্ষতি হয়। মূলত আল্লাহ একমাত্র ধনশালী আর তোমরা সকলেই দরিদ্র-তাঁরই মুখাপেক্ষী। আল্লাহর রাস্তায় যদি তোমার আদৌ অর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত না হও তবে এ অপরাধের অনিবার্য ফলস্বরূপ আল্লাহ তাআলা তোমাদের স্থানে এক ভিন্ন জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। তারা নিশ্চয়ই তোমাদের মত (কৃপণ) হবে না। সূরা মুহাম্মাদ : ৩৮
মোটকথা, যাকাত ইসলামের একটি স্তম্ভ এবং এটাই তার মূল কথা। একে প্রচলিত সরকারী ট্যাক্সের মত মনে মারাত্মক ভুল। কারণ আসলে এটা ইসলামের প্রাণ, ইসলামের জীবনী শক্তি। যাকাত ফরয করার মূলে ঈমানের পরীক্ষা করাই হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য। ক্রমাগত পরীক্ষা দিয়ে ডিগ্রী লাভ করে, অনুরূপভাবে আল্লাহও মানুষের ঈমান যাচাই করার জন্য কতগুলো পরীক্ষা নির্দিষ্ট করে দেন; প্রত্যেক মানুষকেই এ পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। একজন মানুষ যখন এরূপ পরীক্ষা দিয়ে চতুর্থ পরীক্ষা-অর্থাৎ অর্থদানের পরীক্ষায়ও সাফল্য লাভ করে, তখনই সে ঘাঁটি মুসলমান হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, এটা নিশ্চয়ই সর্বশেষ পরীক্ষা নয়।
এরপরে আসে প্রাণের পরীক্ষা। সেই সম্পর্কেও আমি পরে আলোচনা করবো। কিন্তু ইসলামের সীমার মধ্যে আসার জন্য-অন্য কথায় আল্লাহর দলভুক্ত হবার যে কয়টি প্রবেশিকা পরীক্ষা নির্দিষ্ট করা হচ্ছে, তার মধ্যে যাকাত হচ্ছে সর্বশেষ পরীক্ষা। বর্তমানে অনেকেই বলে বেড়াচ্ছে যে, টাকা-পয়সা খরচ বা দান করার অনেক ওয়াজই মুসলমানকে শুনান হয়েছে, বর্তমানে এ অভাব ও দারিদ্রের কঠিন মুহূর্তে তাদেরকে খানিকটা উপার্জন ও সঞ্চয় করার ওয়াজ শুনানো উচিত; কিন্তু তারা বুঝতে পারে না যে, যে জিনিসটির প্রতি তারা নাক ছিটকাচ্ছে তা হচ্ছে ইসলামের এ প্রাণ বস্তুটি। আর এ জিনিসটির অভাবই মুসলমানকে নৈতিক ও আর্থিক অধ:পতনের চরম সীমায় নিয়ে পৌঁছিয়েছে। এ প্রাণ বস্তুটি তাদেরকে অধপতিত করেনি। তাদের সর্বব্যাপী পতন হয়েছে শুধু এজন্য যে, এ প্রাণ বস্তুটিই তাদের দেহ থেকে নির্গত হয়ে গেছে।
=সমাপ্ত=