ইহকালীন ও পরকালীন উভয় জীবনের কল্যাণের বার্তা নিয়ে ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম রূপে এ ধরায় আবির্ভূত হয়েছে। কেবল পরকালীন জীবনের কর্তব্য পালনের জন্যই এ ধর্মে নির্দেশ দেয়া হয়নি; বরং ইহলৌকিক জীবনকে পারলৌকিক জীবনের ভিত্তি হিসেবে তুলে ধরে ইসলাম দুনিয়ার জীবনকেও সমধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। দুনিয়ার জীবনে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করার জন্য ইসলাম কেবল মানুষকে অনুমোদনই দেয়নি বরং কীভাবে দুনিয়ার জীবনে শান্তি আসবে সে সম্পর্কিত বিভিন্ন বৈষয়িক বিষয়েও ইসলাম মানুষকে পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রদান করেছে।দুনিয়ার জীবনের সুখ-শান্তি বা স্বাচ্ছন্দ্য অনেকাংশেই অর্থসম্পদের সঙ্গে শর্তায়িত। মানুষের বৈষয়িক জীবন নিয়ন্ত্রণ করে অর্থ।
এজন্য অনেক চিন্তাবিদ অর্থকেই গোটা মানবসমাজ ও সভ্যতার বিবর্তনের মূল নিয়ামক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। পার্থিব জীবনের নিয়ন্ত্রক এই গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক সম্পর্কে ইসলাম সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। ইসলাম ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রযোজ্য একটি পরিপূর্ণ অর্থব্যবস্থার পর্যাপ্ত দিকনির্দেশনা বা রূপরেখা প্রদান করেছে। ইসলামী অর্থনীতি একটি সত্যিকার বাস্তবধর্মী জনকল্যাণ অর্থনীতি। ইসলামী অর্থনীতিতে জাকাতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম যে জনকল্যাণমূলক অর্থব্যবস্থা প্রদান করেছে জাকাত তার একটি প্রধান ভিত্তি।
জাকাত কী : জাকাত একটি আরবি শব্দ। এর আবিধানিক অর্থ বৃদ্ধি ও পবিত্রতা। জাকাত প্রদানের ফলে সমাজের বিত্তহীন বা গরিব মানুষের অর্থ বৃদ্ধি হয় এবং বিত্তশালী বা ধনীর ধনসম্পদ পবিত্র হয়।জাকাত প্রদান ইসলাম ধর্মের একটি আবশ্যিক ইবাদত। এটি ধনী বা সম্পদশালীদের ওপর ফরজ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ বর্ণিত রয়েছে। আল্লাহ বলেছেন : ‘তোমরা সালাত কায়েম কর এবং জাকাত প্রদান কর’ (সূ: ৭৩, আ: ২০)। ইসলামী শরীয়ত অনুসারে কোনো মুসলমানের অর্জিত অর্থের দ্বারা তার পরিবারের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের পর যদি একটি নির্দিষ্ট সীমার অতিরিক্ত অর্থ অন্তত এক বছর উদ্বৃত্ত হিসেবে থেকে যায় তবে ওই মুসলমানকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ধনসম্পদ গরিব লোকদের দিয়ে দিতে হবে; ধনীদের সম্পদের একটি অংশ এভাবে গরিবদের প্রদান করার যে বাধ্যতামূলক বিধান ইসলামে দেয়া হয়েছে তাই হচ্ছে জাকাত।
উপরোক্ত বর্ণনা থেকে জাকাতের নিম্নোক্ত মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো ধরা পড়ে :
১. জাকাত মুসলমানের জন্য একটি আবশ্যিক ইবাদত, ২. এটা কেবল ধনীক (সমর্থবান) শ্রেণীর ওপর প্রযোজ্য, ৩. জাকাত গরিব বা বিপদগ্রস্তদের প্রদান করা হয়, ৪. জাকাত কোনো দান-খয়রাত নয়; এটা ধনীদের ওপর গরিবদের একটি ধর্মীয় অধিকার, ৫. জাকাত প্রদান না করলে পরকালে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।জাকাতের পরিমাণ : প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর কাছে তাদের পরিবারের সব বৈধ এবং পরিমিত খরচ-খরচা নির্বাহের পর যদি সাড়ে ৭ তোলা স্বর্ণের সমমূল্য অর্থ অন্তত এক বছরকালীন সময়ে মজুদ থাকে তবে তার ওপর শতকরা আড়াই টাকা হারে জাকাত দেয়ার বিধান রয়েছে। তবে বিভিন্ন সম্পদের ক্ষেত্রে জাকাতের হিসাব নির্ধারণে কিছুটা ভিন্নতর নিয়ম করা হয়েছে।
নিচে কিছু কিছু ক্ষেত্রে জাকাতের পরিমাণ দেয়া হলো :১. নগদ অর্থ : উদ্বৃত্ত অর্থের (নির্দিষ্ট পরিমাণের) আড়াই ভাগ, ২.স্বর্ণ : সাড়ে সাত তোলা (বিশ মিছকাল) স্বর্ণ জমা থাকলে তার আগাই ভাগ স্বর্ণ বা তার মূল্যের অর্থ, ৩. রৌপ্য : সাড়ে বাহান্ন তোলা রৌপ্য জমা থাকলে তার আড়াই ভাগ রৌপ্য বা তার সমপরিমাণ অর্থ, ৪. ব্যবসায়িক পণ্য : যে কোনো ব্যবসায়িক পণ্য বা মূলধনের পরিমাণ সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের সমান (গচ্ছিত) থাকলে তার আড়াই ভাগ, ৫. উত্পন্ন ফসল : বিনা যন্ত্রপাতি ব্যবহারে উত্পন্ন ফসলের গচ্ছিত অংশের ১/১০ ভাগ এবং যান্ত্রিকভাবে উত্পন্ন গচ্ছিত ফসলের ১/২০ ভাগ, ৬. গৃহপালিত পশু : অতিরিক্ত প্রতি ৩০টি গরু বা মহিষের জন্য একটি এক বছরের বেশি বয়সের বাছুর এবং প্রতি ৪০টি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বার জন্য একটি ১ বছর বয়সী বাচ্চা।নিজ বসতবাড়ী, গৃহসামগ্রী, স্ত্রী লোকের ব্যবহৃত কাপড় ইত্যাদি কিছু ক্ষেত্রে জাকাত প্রযোজ্য নয়।
যাদের জাকাত দেয়া যাবে : জাকাতের অর্থ কাদের প্রদান করা যাবে সে সম্পর্কেও ইসলামে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে জাকাতের অর্থ প্রদান করা যাবে :১. গরিব মুসলমানদের অভাব মোচনের জন্য, ২. কর্মহীন মুসলমানের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য, ৩. নবদীক্ষিত মুসলমানদের পুনর্বাসনের জন্য, ৪. যুদ্ধবন্দি মুসলিম মুজাহিদদের মুক্তির জন্য, ৫. ঋণগ্রস্ত মুসলমানের ঋণ মুক্তির জন্য, ৬. পঙ্গু মুসলমানের জন্য, ৭. ইসলামী গবেষণা কাজে নিয়োজিত সামর্থ্যহীন মেধাবী গবেষকের গবেষণা কাজের জন্য, ৮. ইসলাম প্রচারের কাজে নিয়োজিত মুসলমানদের প্রয়োজনে, ৯. মুসাফির বা মুসলিম পরিব্রাজকের সাময়িক প্রয়োজনে, ১০. জাকাতের অর্থসংগ্রহকারী ব্যক্তিদের ইত্যাদি ক্ষেত্রে জাকাত প্রদান করা যেতে পারে।
যেসব ক্ষেত্রে জাকাত দেয়া যাবে না : কিছু কিছু ক্ষেত্র রয়েছে যে ক্ষেত্রে জাকাত দিলে তা সঙ্গত হবে না। এরকম কিছু ক্ষেত্র হলো :১. স্বামী তার স্ত্রীকে, ২. স্ত্রী তার স্বামীকে, ৩. মা, বাবা, পুত্র, কন্যা, নানা, নানী, পৌত্র, দৌহিত্র এসব সম্পর্কের ক্ষেত্রে, ৪. মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মাণের ক্ষেত্রে, ৫. অবৈধ ব্যবসায়ীর হঠাত্ দুরবস্থা হলে।