Originally posted 2013-04-21 05:57:27.
কল্যাণ রাষ্ট্র সম্বন্ধে হয়তোবা আমাদের অনেকেরই সঠিক ধারণা নেই। এটা এমন একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেখানে সরকার দেশের জনগণের মৌলিক চাহিদা যেমন- খাদ্য, বস্ত্র,শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা, ও সামাজিক নিরাপত্তাসহ অন্যান্য আরও অনেক প্রয়োজন পূরণ করার জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। এ ব্যবস্থায় সরকার জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে সুরক্ষিত ও উন্নত করা প্রধান কাজ হিসাবে গ্রহণ করে থাকে। সুযোগ-সুবিধার সমতা, সম্পদের সুসম বন্টন এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সচ্ছলতা আনয়নের দায়িত্বের ভিত্তিতে প্রণীত নীতিমালার উপর এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত। দারিদ্র বিমোচন, বয়োস্কদের ও অসুস্থ্যদের জন্য সেবামূলক কার্যক্রম, বেকার সমস্যা দূর করার পরিকল্পনা বিশেষভাবে গ্রহণ করে থাকে। তাছাড়াও বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়া-লিখা করার ব্যবস্থা করে থাকে।
‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ শব্দটি শুনলেই যে কোন ব্যক্তির মনে এরূপ রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হওয়ার আগ্রহ সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। তথাকথিত ‘কল্যাণ রাষ্ট্রের’ নাগরিক হওয়ার পরও হয়তোবা এ রকম চিন্তার উদ্রেক হতে পারে। কারণ কল্যাণকর কাজের কিছু অংশ একটি সরকারের পক্ষে কার্যকর করা সম্ভব হলেও শতভাগ করা সম্ভব নয়। আর এ ফাঁক টুকুই কারোর জন্য অসন্তোষের কারণ হতে পারে ।
পৃথিবী নামক আমাদের গ্রহে সংজ্ঞানুযায়ী শতভাগ কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আছে কি না সে প্রশ্ন থাকতে পারে, তবে অষ্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। এ সমস্ত দেশের জনগণ উচ্চ হারে ট্যাক্স প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সেবামূলক কাজ পেয়ে থাকে। উল্লেখ্য, এ সব দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠির চেয়ে ধনী লোকদেরকে অধিক পরিমাণে ট্যাক্স প্রদান করতে হয়। এতে করে ট্যাক্স প্রদানকারীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ অধুনা কালের সৃষ্ট কোন পরিভাষা নয়। ইসলামের ইতিহাস থেকে আমরা এ ধরণের রাষ্ট্রের ধারণা অনেক আগেই লাভ করেছি। আমাদের শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর জীবদ্দাশায় ‘কল্যাণ রাষ্ট্রের’ স্বরূপ দেখিয়ে দিয়েছেন। তাঁর তিরোধানের পর খোলাফায়ে রাশেদাগণ ইসলামী ‘কল্যাণ রাষ্ট্রের’ সফল পরিচালক ছিলেন। তা ছাড়াও অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় শাসনামলে এ রাষ্ট্রের নমুনা আমরা দেখতে পাই। আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রে কিছু নতুন পরিভাষা ব্যবহৃত হয়ে থাকে বলে হয়তো মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দ্বারা প্রবর্তিত কল্যাণ রাষ্ট্রের সাথে আমরা এর মিল খুঁজে পাইনা। গভীরভাবে তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে তা পরিষ্কার হতে পারে।
অর্থ-সম্পদ এরূপ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যতম একটি উপাদান। ফলে যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যোগান দিতে না পারলে ‘কল্যাণ রাষ্ট্রের’ স্বপ্ন দেখা সম্ভব নয়। ইসলামের মূল স্তম্ভের একটি হলো যাকাত। নিসাব পরিমাণ অর্থ এক বছর কারো নিকট জমা থাকলে যাকাত প্রদান করা আল্লাহর ফরজ করেছেন। যাকাত ইসলামী ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ তৈরিতে বড় ভূমিকা রেখে থাকে। যাকাত প্রদান একজন সামর্থ্যবান মুসলিমের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের কোষাগারের যাকাত বিভাগে তা জমা দিতে হবে।
যাকাত ধনীদের পক্ষ থেকে গরিবদের প্রতি কোন অনুকম্পা নয়। এটা গরিবদের অধিকার। রাষ্ট্র কর্তৃক যাকাত আদায় ও তা সঠিকভাবে ব্যবহার করার পরিবেশ রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে পারেনি বলেই আমাদের সমাজের যাকাত প্রদানকারীরা সরাসরি যাকাত দিয়ে থাকে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে যাকাত প্রদানকারীগণ ইসলামের নীতির আলোকে মহানুভবতা দেখাতে পারেনা বলে আমরা ব্যথিত হই।
ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার যাকাত আদায় করবে এবং হকদারদের মধ্যে তা বিতরণ অথবা কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করবে। কোন মুসলমান যদি যাকাত প্রদান করতে অস্বীকার করে, তাহলে সরকার তা আদায়ের জন্য বল প্রয়োগ করবে। একইভাবে জিযিয়া-কর সরকার অমুসলিমদের নিকট থেকে আদায় করবে যা কিনা অমুসলিম জনগণের কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হবে।
কিছু দিন আগেও আমাদের দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে পুঞ্জীভূত অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। এর মধ্য থেকে সরকার ইচ্ছে করলে মোটা অঙ্কের টাকা যাকাত হিসাবে সংগ্রহ করতে পারে। এ অর্থ দিয়ে সহায় সম্বলহীন ও বেকারদের জন্য কর্ম সংস্থান সৃষ্টি করে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষকে স্বাবলম্বী করা যাবে। এভাবে ক্রমাগতভাবে কয়েক বছর কাজ করতে পারলে দেখা যাবে দেশ থেকে দারিদ্র দূর হয়ে গেছে। ব্যাংক ছাড়াও Stock Exchange-এর শেয়ারের দাম, ব্যবসায় নিয়োজিত সম্পদ, লিজিং কোম্পানী গুলোর পুঁজি, মানুষের কাছে গচ্ছিত নগদ অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কার, উৎপাদিত কৃষি পণ্যের ওশর এবং গৃহপালিত পশুর উপর যাকাত আরোপ করে এবং তা আদায় করে যদি হকদাদের মধ্যে বণ্টন করা হয় তাহলে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সমাজের চেহারা পাল্টে ফেলা সম্ভব।
আধুনিক ‘কল্যাণ রাষ্ট্রে’ ট্যাক্স এবং ইসলামী ‘কল্যাণ রাষ্ট্রে’ যাকাত উভয়টায় সরকার আদায় করে থাকে ও সরকারই তা বণ্টন বা ব্যয় করার ইখতিয়ার রাখে। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে দু ধরণের ‘কল্যাণ রাষ্ট্রের’ মধ্যে পার্থক্য কি? ট্যাক্স সরকার কৃতক ধার্য করা হয়ে থাকে। এটা কোন কোন ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ও যুলুমের পর্যায়ে চলে যেতে পারে। অপর পক্ষে ট্যাক্স দাতা ফাঁকি দেয়ার উদ্দেশ্যে নানান ফন্দি-ফিকির করে থাকে। তা ছাড়া ট্যাক্স প্রদান করলে নেকি হাসিলের মাধ্যমে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের কোন নিশ্চয়তা নেই। পক্ষান্তরে যাকাত প্রদান আল্লাহর দেয়া ফরজ কাজ হওয়াতে একজন মু‘মিন তা স্বতঃস্ফুর্তভাবে প্রদান করে থাকে এবং মু‘মিনের নিকট তা যুলুম নয়। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সাওয়াব হাসিল করা যায় এবং পরকালে পুরস্কার পাওয়ার সুসংবাদও রয়েছে।
ইসলামী রাষ্ট্রের সরকারের দায়িত্বই হলো দেশের জনগণের সকল ধরনের সমস্যার সমাধান করা। এ দায়িত্ব পালন করাটা এবাদতও বটে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও নিরাপত্তাসহ অন্যান্য প্রয়োজন পূরণের জন্য যখন সরকার সকল দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন একজন নাগরিককে আর দুঃশ্চিন্তায় থাকতে হয়না। ফলে একজন নাগরিক দেশের কল্যাণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে কার্পণ্য করবেনা। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম কেউ তার সম্পূর্ণ সম্পদ দেশের জনগণের কল্যাণের জন্য বিলিয়ে দিয়ে (ইসলাম কিন্তু তা করতে বলেনা) নিঃস্ব হয়ে গেল। একটি ইসলামী রাষ্ট্রে তাতে তার কোন সমস্যার সৃষ্টি হবেনা। কারণ, তাৎক্ষণিকভাবে সরকার তার সকল দায় দায়িত্ব গ্রহণ করবে।
বর্তমানের ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ সম্বন্ধে অনেকেই বিরূপ মনোভাব পোষণ করে থাকেন। তাঁদের মতে, বেকার লোকেরা অথবা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী সরকারের সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং নিজের উদ্যোগে সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আধুনিক ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ সম্পর্কে এ মন্তব্য হয়তোবা সঠিক কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের ব্যাপারে এ কথা প্রযোজ্য নয়। ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার যাকাতের অর্থ দ্বারা কল-কারখানা বা উৎপাদনশীল কোন প্রতিষ্ঠান তৈরি করে যাকাতের হকদারদের জন্য কর্ম সংস্থান সৃষ্টি করবে। তাছাড়া কল-কারখানা গুলির মালিকও হবে হকদারেরা । ফলে ভাগ্য উন্নয়নের জন্য নিজেরা সচেষ্ট হবে। এতে করে অনেকেই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে এতটাই সম্পদের মালিক হয়ে যেতে পারে যে তারা নিজেরাই যাকাত প্রদানের জন্য নিসাব পরিমাণ অর্থের মালিক হয়ে যাবে। ইসলাম আমাদেরকে যে ধরণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে তা মূলতঃ একটি কল্যাণ মূলক রাষ্ট্র। কাজেই ইসলামী ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ আলাদাভাবে বলার দরকার হয়না। যাকাত ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থার উপর ‘কল্যাণ রাষ্ট্রের’ প্রকৃত রূপ অনেকাংশে নির্ভরশীল।