Main Menu

হিজরতের ইতিকথা

রাসূলুল্লাহর হিজরত

হিজরতের ইতিকথা

 হিজরতের ইতিকথা

আল্লাহ পাক তার ইবাদতের জন্য যেমন মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন, তেমনি তাদের হিদায়াতের জন্য যুগে যুগে নবী ও রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। তাঁরা নিজেদের সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা, শ্রম-সাধনা এ পথে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। দিন-রাত মানুষকে আহ্বান করেছেন আল্লাহর পথে। কিন্তু খুব কম লোকই নবী রাসূলগণের হক্বের দাওয়াতকে কবুল করেছে। অধিকাংশ লোক তাদের দাওয়াতকে অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং আল্লাহর এই প্রিয় বান্দাদেরকে নানাভাবে অত্যাচার ও নিপীড়ন করেছে। তাঁদের ইবাদতে-দাওয়াতে বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে। তাদেরকে মাতৃভূমি থেকে উৎখাত করার, এমনকি হত্যা করার চক্রান্ত করা হয়েছে। এহেন কঠিন পরিস্থিতিতেই তাঁদের জীবনে নেমে আসত হিজরতের আসমানী আদেশ। মাতৃভূমির আকর্ষণ ত্যাগ করে, আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার-পরিজনের মায়া-বন্ধন ছিন্ন করে আল্লাহর রাহে বাড়ি-ঘর ত্যাগের এই মহান গুরুত্বপূর্ণ আমল যেমন বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাঁদের জন্য খোদার প্রেমের কঠিন পরীক্ষা তেমনি তার অভ্যন-রে নিহিত থাকে আল্লাহর সাহায্যের সূচনা।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

حَتَّىٰ إِذَا اسْتَيْأَسَ الرُّ‌سُلُ وَظَنُّوا أَنَّهُمْ قَدْ كُذِبُوا جَاءَهُمْ نَصْرُ‌نَا فَنُجِّيَ مَن نَّشَاءُ ۖ وَلَا يُرَ‌دُّ بَأْسُنَا عَنِ الْقَوْمِ الْمُجْرِ‌مِينَ

‘অবশেষে যখন রাসূলগণ নিরাশ হয়ে পড়েন এবং কাফিররা ভাবল যে, তাদেরকে মিথ্যা ধমকই দেওয়া হয়েছিল, তখন তাদের নিকট নেমে এল আমার সাহায্য। সূরা ইউসুফ : ১১০

হিজরত বিজয়ের সূচনা:

যে সকল নবীর জীবনে হিজরতের ঐশী আদেশ এসেছে, তা এসেছে চূড়ান্ত পরীক্ষা ও বিজয়ের সূচনা হিসেবে। উদাহরণস্বরূপ হযরত ইবরাহীম আ.-এর কথা বলা যেতে পারে। নবুওয়ত লাভের পর হতে তিনি নিজ মাতৃভূমির মানুষকে রাত-দিন দাওয়াত দিলেন। কিন্তু তা গ্রহণ করেনি তারা, ত্যাগ করেছে তার সঙ্গ। তাকে অকথ্য নির্যাতন করতেও দ্বিধা করেনি। দ্বিধা করেনি তাঁকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করতে। তখন আল্লাহর পক্ষ হতে সিরিয়ায় হিজরতের নির্দেশ আসে। তাই তিনি ঘোষণা করেন, وَقَالَ إِنِّي مُهَاجِرٌ‌ إِلَىٰ رَ‌بِّي ۖ إِنَّهُ هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ﴿٢٦﴾ (তরজমা) ‘নিশ্চয়ই আমি আমার রবের দিকে হিজরত করছি, তিনি মহা পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’। -সূরা আনকাবুত : ২৬

তাঁর এই হিজরতের ফলে সূচিত হয় এক বিপ্লবের। আসে ব্যাপক সফলতা ও আল্লাহর সাহায্য। আল্লামা ইবনে কাসীর রাহ. বলেন, ‘যখন তিনি (ইবরাহীম (আ.) মাওলার সন্তুষ্টির জন্য স্বীয় কওমকে ত্যাগ করলেন এবং সে দেশ থেকে হিজরত করলেন, তখন তাঁর স্ত্রী ছিলেন বন্ধ্যা ও নিঃসন্তান। তাঁদের কোনো সন্তান ছিল না। ছিল শুধু ভাতিজা-লুত ইবনে হারূন ইবনে আজর। হিজরতের পর আল্লাহ তাঁকে অনেক নেক সন্তান-সন্ততি দান করলেন। তাঁর বংশে দেওয়া হল নবুওয়ত ও আসমানী কিতাব। এরপর পৃথিবীতে যত নবী তাশরীফ এনেছেন তারা সবাই হযরত ইবরাহীম আ.-এর বংশধর। এরপর যমীনে যত আসমানী কিতাব নাযিল হয়েছে তা নাযিল হয়েছে হযরত ইবরাহীম আ.-এর সন্তানের উপর। এটি আল্লাহ প্রদত্ত সম্মান ও অপার অনুগ্রহ। কেননা, তিনি তাঁরই সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিজ ভিটেমাটি ও স্বজন-পরিজনকে ত্যাগ করেছেন। এমন ভূমির দিকে হিজরত করেছিলেন যেখানে নিরাপদে আল্লাহর ইবাদত করা যায় এবং তাঁর পথে মাখলুককে দাওয়াত দেওয়া যায়। -আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া ১/৩৪৬

এই ধারায় হিজরত করেছেন আল্লাহর বহু নবী-রাসূলগণ। সকলের হিজরতের অক্লান্ত কষ্টের মাঝেই লুকিয়ে ছিল প্রাপ্তির সু-সংবাদ আর বিজয়ের সূচনা। নিহিত ছিল ইবাদাতের স্পৃহা আর ঈমানের তেজসহ আরো অসংখ্য হিকমত। যা আল্লাহই ভালো জানেন। এই ধারাবাহিকতায় পৃথিবীতে এলেন রহমতের নবী, আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। নবুওয়ত লাভের পর প্রায় তেরটি বছর-তাঁর নবুওয়তী জীবনের সিংহভাগ-তিনি কাটিয়ে দিলেন মক্কার কাফিরদের মাঝে। জনে-জনে, গোত্রে-গোত্রে, গ্রামে-পল্লীতে, পথে-প্রান্তরে মক্কার মানুষদের তিনি আহ্বান করলেন ইসলামের কালেমার দিকে, তাওহীদের সত্য পথে। কিছু মানুষ তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিল, কিন্তু মক্কার অধিকাংশ লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর অনুসারীবৃন্দ এবং ইসলামের দাওয়াতকে প্রতিহত করতে উঠে পড়ে লাগে। নির্যাতন-নিপীড়নের মাত্রা দিন দিন চরম থেকে চরমতর হচ্ছিল। কখনো ফুটন্ত গরম পানিতে ঢেলে দিয়ে কখনো বা প্রচণ্ড উত্তপ্ত মরুভূমির পাথর-বালিতে টানা হেঁচড়া করে সাহাবীদের তারা অতিষ্ঠ করে তোলে। এমন বর্বর নির্যাতনের মাঝে কেটে গেল পাঁচটি বছর। ইতিহাসে এমন একজন সাহাবীর নামও পাওয়া যাবে না, যিনি এই সময়ের এত ভয়াবহ নির্যাতনের মুখে নবীজীকে ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। কিংবা ছেড়ে দিয়েছেন তাওহীদী বিশ্বাস। বরং তাঁরা ছিলেন ঈমানের উপর অটল-অবিচল। প্রাণ দিয়েছেন, দিতে প্রস্তুত ছিলেন; কিন্তু দেননি ঈমান। কারণ তাঁরা তাঁর হাতে হাত রেখে বাইয়াত হয়েছিলেন, এ পথে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার। নিয়েছিলেন তাঁকে ছেড়ে কোথাও পালিয়ে না যাওয়ার বজ্র কঠিন শপথ। আবার আল্লাহরই নির্দেশে কিংবা নবীজীর আদেশে বাসা-ভিটা ত্যাগ করে হিজরতের ওয়াদাও তারা দিয়েছিলেন।

সে যাই হোক, নবুওয়ত প্রাপ্তির প্রায় পাঁচ বছর পর নবীজী ভাবলেন, কাফিরদের নির্যাতন তো সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। সাথে তারা সাহাবীদের ঘরের কোণের ইবাদত-বন্দেগীতেও বাঁধার সৃষ্টি করছে। তখন তিনি আল্লাহর নির্দেশে নিরাপদভাবে আল্লাহর ইবাদতের নিমিত্তে সাহাবীদের মধ্যে যাদের পক্ষে সম্ভব হয় তাদেরকে আবিসিনিয়ায় (ইথিওপিয়ায়) হিজরতের পরামর্শ দিলেন। নবীজীর পরামর্শে নবুওয়তের পঞ্চম সনে প্রথমবারের মতো প্রায় পনেরজন মুসলমানের একটি ছোট্ট কাফেলা আবিসিনিয়ার পথে মক্কা থেকে হিজরত করেন। পরবর্তী বছর আরো প্রায় এক’শ জনের একটি বিশাল কাফেলা একই দেশে হিজরত করেছেন। -(আল মুনতাজাম ২/৩৭৪-৩৭৭)

আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী এসব সৌভাগ্যবান মুসলমানরা সে দেশের তৎকালীন খৃষ্টান রাজা নাজাশী- যিনি পরবর্তীতে ইসলামও গ্রহণ করেছিলেন-এর আশ্রয়ে প্রচুর নিরাপত্তা ও বেশ আতিথেয়তার মাঝে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করতে লাগলেন। কিন্তু নবীজী রয়ে গেলেন মক্কায়। পথহারা মুশরিকদের আল্লাহর পথে আনতে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। অন্যদিকে মক্কার কাফিররা তাঁকে ঘিরে বাঁধার সৃষ্টি করে চলেছে। নানা নির্যাতনসহ নামাযের সময় সিজদারত নবীজীর কাঁধে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ তুলে দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখিয়ে তারা নবীজী ও সাহাবীদের ইবাদতে বিঘ্নতা সৃষ্টি করে চলেছে প্রতিনিয়ত। তায়েফে প্রিয় নবীজী রক্তাক্ত হয়েছিলেন শুধুমাত্র দাওয়াত ইলাল্লাহর অপরাধেই (?)। তবুও নবীজী তাঁর কাজে নিমগ্ন, আপন মিশন নিয়ে ব্যস্ত।

ইসলামের বিজয়ের সূচনা:

এভাবে কেটে যাচ্ছে নবুওয়ত প্রাপ্তির প্রায় বারো-তেরটি বছর। যখন কাফিরদের ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে, তখন আল্লাহ তার সাহায্য ও নুসরত, দ্বীনের বিজয়, কালেমার বিশ্বময় প্রসারের জন্য মুমিনদের সর্বশেষ পরীক্ষার আয়োজন করেন। নবীজী আল্লাহর হুকুমে তাঁদের নির্দেশ দিলেন মদীনায় হিজরতের। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রাহ. বলেন, ‘নবীজী মক্কায় অবস্থান করছিলেন, আর কবীলাগুলোকে আহ্বান করছিলেন আল্লাহর পথে। প্রত্যেক হজ্ব মওসুমে সমবেত সব গোত্র-কবীলার কাছে তিনি তাঁকে আশ্রয় দানের জন্য পেশ করতেন। যাতে তিনি সেখানে থেকে আল্লাহর রিসালাতের তাবলীগ করতে পারেন। আর এর প্রতিদানে তারা অর্জন করে নেয় জান্নাত। কিন্তু কোনো গোত্রই তাঁর এই কথায় কর্ণপাত করেনি। অন্যদিকে আল্লাহ তাআলা এই সম্মান আনসারদের ভাগ্যেই রেখেছিলেন। আল্লাহ যখন তাঁর মনোনীত দ্বীনের প্রসার ও প্রতিষ্ঠা, স্বীয় ওয়াদা পূরণ, তাঁর নবীর সাহায্য, কালেমার বিজয় এবং এই দ্বীনের শত্রুদের প্রতিশোধ নেয়ার ইরাদা করলেন তখন সে দ্বীনকে তিনি মদীনায় নিয়ে যান আনসারদের কাছে। … এভাবে দ্বীন তাঁদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ল। আনসারীদের এমন কোনো ঘর-বাড়ি ছিল না যেখানে নবীজীর আলোচনা হচ্ছিল না। অতপর নবীজী সাহাবীদের আদেশ করলেন মদীনায় হিজরতের। আর তাঁরা দলে দলে মদীনার পথ ধরলেন। আনসারীরা মদীনায় তাঁদের অভ্যর্থনা জানালেন, স্বীয় গৃহে মেহমান বানালেন। তাঁদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন সহযোগিতার হাত। এভাবেই ইসলাম ছড়িয়ে পড়ল পুরো মদীনায়।-যাদুল মাআদ ১/৯৭ সাহাবায়ে কেরামদের দলে দলে এই হিজরত কোনো অদৃশ্য বিষয় ছিল না, ছিল না রাতের আঁধারে পালিয়ে যাওয়া। বরং বাঁধা-বিঘ্নহীনভাবে আপন দ্বীন-ঈমানের সুরক্ষা ও ইবাদতের উপযোগী পরিবেশ প্রাপ্তির জন্য আল্লাহ ও রাসূলের আদেশে, তাঁদেরই সন্তুষ্টির লক্ষ্যে,ছুটে চলেছেন এই ইবাদত পালনের পথে। দিন-দুপুরে কিংবা রাতের গভীরে, প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে কিংবা সকলের অগোচরে, দলে দলে কিংবা ‌একাকী, পায়ে হেঁটে কিংবা সওয়ারীর পিঠে চড়ে, যিনি যেভাবে পেরেছেন, যখনই পেরেছেন এই ইবাদত পালন করেছেন। পালন করেছেন হিজরতের আদেশ। ছুটে গেছেন মদীনায়।

হযরত আলী রা. সূত্রে বর্ণিত একটি রেওয়ায়েতে আছে, ‘হযরত ওমর রা. যখন হিজরতের ইরাদা করলেন, তখন তিনি সাথে তরবারি বেঁধে নিলেন। কাঁধে নিলেন ধনুক, তূণীর থেকে কিছু তীর বের করে হাতে নিলেন। কটিবদ্ধ করলেন তাঁর লাঠি। অতঃপর কাবার প্রাঙ্গনে এলেন। কাবার চারপাশে ছিল কুরাইশদের অনেক লোক। তিনি বাইতুল্লাহর চারপাশে সাতবার তাওয়াফ করে, মাকামে ইবরাহীমে গিয়ে দু’রাকাত নামায আদায় করলেন। অতঃপর মক্কার কাফিরদের উদ্দেশে চিৎকার করে বললেন, ‘দুর্ভাগ্য তোমাদের! তোমাদের মধ্যে যে তার মায়ের বুক খালি করতে চায়, সন্তানকে বানাতে চায় এতিম কিংবা চায় স্বীয় স্ত্রীকে বিধবা বানাতে, সে এসো! মক্কার ঐ প্রান্তরের পাদদেশে আমার মুখোমুখি হও। কিন্তু কেউই তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করতে এল না। সাহসের সাথে তিনি চললেন মদীনার পাণে। তখন তাঁর সাথে ছিল বিশজনেরও অধিক সাহাবীর একটি কাফেলা।’-উসদুল গাবাহ ৩/৩২৪; সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ ৩/২২৫

এভাবে একাকী বা কাফেলার সাথে মুসলমানরা মক্কা ত্যাগ করছিলেন। মুশরিকদের হাতে আটকে পড়া কিছু অক্ষম মুসলমান ছাড়া পুরো মক্কায় তেমন কোনো সাহাবী নেই। কিন্তু তখনও মক্কায় রয়ে গেলেন আল্লাহর নবী। সাথে রাখলেন, তাঁর ‘জানেছার’ দু’জন সাহাবী হযরত আবু বকর ও আলী রা.কে। সহীহ বুখারীর বিশুদ্ধ বর্ণনা মতে,

وَتَجَهَّزَ أَبُو بَكْرٍ قِبَلَ الْمَدِينَةِ ، فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه و سلم: عَلَى رِسْلِكَ ، فَإِنِّي أَرْجُو أَنْ يُؤْذَنَ لِي . فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ : وَهَلْ تَرْجُو ذَلِكَ بِأَبِي أَنْتَ ؟ قَالَ : نَعَمْ . فَحَبَسَ أَبُو بَكْرٍ نَفْسَهُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه و سلم لِيَصْحَبَهُ ، وَعَلَفَ رَاحِلَتَيْنِ كَانَتَا عِنْدَهُ وَرَقَ السَّمُرِ -وَهُوَ الْخَبَطُ- أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ

‘হযরত আবু বকর রা.ও অন্য সাহাবীদের মতো হিজরতের জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু নবীজী তাঁকে বললেন, অপেক্ষা করো, আশা করছি, আমাকেও হিজরতের অনুমতি দেওয়া হবে। … অতঃপর হযরত আবু বকর রা.ও নবীজীর সঙ্গী হতে রয়ে গেলেন মক্কায়। আর সফরের প্রস্তুতিস্বরূপ প্রায় চার মাস যাবত দুটি উষ্ট্রী বাহনের পরিচর্যা করতে লাগলেন।-সহীহ বুখারী হাদীস : ৩৯০৫

নবীজী আল্লাহর ওহীর অপেক্ষায়:

নবীজীর কী পরম দৃঢ়তা! প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি ও শংকা মাথায় নিয়েও নবীজী সাহাবীশূন্য মক্কায় দিব্যি হেঁটে চলেছেন মুশরিকদের নাগালের মধ্যেই। একদিন-দু’দিন নয়, একে একে চারটি মাস। শুধুই আল্লাহর ওহীর অপেক্ষা! এতো ঝুঁকির মাঝে মদীনাবাসীদের বারংবার তাগাদা সত্ত্বেও তিনি স্বেচ্ছায় মক্কা ত্যাগ বা মদীনায় আশ্রয় গ্রহণের জন্য একটি কদমও বাড়াননি। এভাবে কেটে গেল চারটি মাস। এক সময় মুশরিকদের ঔদ্ধত্য চরম আকার ধারণ করল। তারা নবীজীকে নিয়ে রাতে পরামর্শে বসল। কেউ বলল, নবীজীকে বন্দী করতে আর কেউ বলল, তাঁকে চিরতরে দেশান্তর করতে। পরে সম্মত হয়ে তারা পরিকল্পনা আঁটল, আগামীকাল সকালেই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যার। নাউযুবিল্লাহ। কিন্তু তাদের সব পরিকল্পনা আল্লাহ নস্যাত করে দিলেন। রাতেই আল্লাহ তাআলা ওহীর মাধ্যমে এই চক্রান্তের কথা তার রাসূলকে জানিয়ে দিলেন। আল্লাহ বলেন,

وَإِذْ يَمْكُرُ‌ بِكَ الَّذِينَ كَفَرُ‌وا لِيُثْبِتُوكَ أَوْ يَقْتُلُوكَ أَوْ يُخْرِ‌جُوكَ ۚ وَيَمْكُرُ‌ونَ وَيَمْكُرُ‌ اللَّـهُ ۖ وَاللَّـهُ خَيْرُ‌ الْمَاكِرِ‌ينَ ٣٠

‘(হে নবী!) আপনি ঐ সময়টি স্মরণ করুন, যখন কাফিররা চক্রান্ত আঁটছিল যে, তারা আপনাকে বন্দী করবে, অথবা হত্যা করবে কিংবা করবে দেশান্তর। তারা তাদের ষড়যন্ত্র করছিল আর আল্লাহ আপন কৌশল করছিলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বোত্তম কৌশলী।-সূরা আনফাল : ৩০

আল্লাহ নবীজীকে নির্দেশ দিলেন, রাতে স্বীয় গৃহে শয়ন না করে তাঁর স্থানে হযরত আলী রা.কে রাখতে। এভাবে নবীজীর অপেক্ষার প্রহর শেষ হল, জিবরীল আ. হিজরতের নির্দেশ সম্বলিত আসমানী বার্তা নিয়ে এলেন। আয়াত নাযিল হল,

وَقُل رَّ‌بِّ أَدْخِلْنِي مُدْخَلَ صِدْقٍ وَأَخْرِ‌جْنِي مُخْرَ‌جَ صِدْقٍ وَاجْعَل لِّي مِن لَّدُنكَ سُلْطَانًا نَّصِيرً‌ا ٨٠

‘আর (হে নবী) আপনি বলুন, হে আমার রব! আমাকে প্রবেশ করান কল্যাণের সাথে এবং আমাকে বের করান কল্যাণের সাথে। আর আমাকে আপনার পক্ষ হতে দান করুন সাহায্যকারী শক্তি।’-সূরা বনী ইসরাইল : ৮০

হিজরতের নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে নিজ বাড়িতে আপন চাচাতো ভাই হযরত আলী রা.কে রেখে নবীজী বের হলেন। হযরত আবু বকর রা.কে সাথে নিয়ে পরদিন বের হলেন মদীনার পথে। রওয়ানা হওয়ার মুহূর্তে বাইতুল্লাহর দিকে করুণ দৃষ্টি ফেলে নবীজী বললেন,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ:قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لِمَكَّةَ مَا أَطْيَبَكِ مِنْ بَلَدٍ وَأَحَبَّكِ إِلَىَّ وَلَوْلاَ أَنَّ قَوْمِى أَخْرَجُونِى مِنْكِ مَا سَكَنْتُ غَيْرَكِ.أخرجه الترمذي (3926

‘হে মক্কা! আল্লাহর কসম, তুমি আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় শহর, আমার মাওলার কাছেও বেশি পছন্দের শহর তুমি। যদি তোমার অধিবাসীরা আমাকে বের করে না দিতো, আমি কখনোও বের হতাম না।-তিরমিযী, হাদীস : ৩৯২৬

নবীজীকে দেশান্তরে বাধ্য করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পর একমাত্র আল্লাহর হুকুমে আদিষ্ট হয়েই তিনি মদীনার পথে হিজরত করেন। আর হিজরতের এই ঐশী হুকুম ও মহান ইবাদত পালনের মধ্য দিয়ে পদে পদে নেমে আসে আল্লাহর গায়েবী মদদ।

إِلاَّ تَنْصُرُوهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللَّهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِينَ كَفَرُوا ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لاَ تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا فَأَنْزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُ بِجُنُودٍ لَمْ تَرَوْهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِينَ كَفَرُوا السُّفْلَى وَكَلِمَةُ اللَّهِ هِيَ الْعُلْيَا وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

‘আর যদি তোমরা তাঁকে সাহায্য না কর, তবে আল্লাহ তো তাঁকে সাহায্য করেছিলেন, যখন কাফিররা তাঁকে দেশান্তর করেছিল। তিনি ছিলেন দুজনের দ্বিতীয়জন। যে সময় তাঁরা দু’জন ছিলেন গুহায়। যখন তিনি তাঁর স্বীয় সঙ্গীকে বলছিলেন, তুমি বিষণ্ন হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথেই আছেন। অতঃপর তাঁর উপর স্বীয় সাকীনা নাযিল করলেন এবং শক্তিশালী করলেন এমন সেনাদল দ্বারা, যাদের তোমরা দেখতে পাওনি। আল্লাহ কাফিরদের কালামকে নিচু করে দিলেন আর আল্লাহর কালেমাই হল সমুচ্চ। আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।-সূরা তাওবা : ৪০

হিজরতের এই ঐতিহাসিক তাৎপর্যের ফলেই হযরত ওমর রা. এর শাসনামলে যখন মুসলমানদের জন্য পৃথক ও স্বতন্ত্র পঞ্জিকা প্রণয়নের কথা উঠে আসে তখন তাঁরা সর্বসম্মতভবে হিজরত থেকেই এই পঞ্জিকার গণনা শুরু করেন। যার ফলে চান্দ্রমাসের এই পঞ্জিকাকে বলা হয় ‘হিজরী সন’। (ফাতহুল বারী ৭/৩১৪-৩১৬)

হিজরী সনের ইতিহাস :

হিজরী সন হল মুসলিমদের সন। ৬২২ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই সেপ্টেম্বর আল্লাহর নির্দেশে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করেন। মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ৬২২ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ বা ১৫ জুলাইয়ের সূর্যাস্তের সময়কে হিজরী সন শুরুর সময় হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। হিজরী সন ১৭ হিজরী সাল (৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দ) হতে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের শাসক হযরত ওমর (রাঃ) – এর শাসন আমলে হিজরী সন গণনা শুরু হয়। হযরত ওমর (রাঃ) এর কাছে ইরাক ও কুফার প্রশাসক আবু মুসা আশআরী (রাঃ) এক চিঠিতে লেখেন, “বিশ্বাসীদের নেতা আপনার পক্ষ হতে আসা শাসন কার্যের সাথে সংশ্লিষ্ট উপদেশ, পরামর্শ এবং নির্দেশ সম্বলিত বিভিন্ন চিঠিপত্র ও দলিলে কোন সন-তারিখ না থাকায় আমরা তার সময় ও কাল নির্ধারণে যথেষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হই। অধিকাংশ সময় এসব নির্দেশনার সাথে পার্থক্য করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে বলে আপনার নির্দেশ ও উপদেশ পালন করতে যেয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে।” এ গুরুত্বপূর্ণ পত্র পাওয়ার পর হযরত ওমর (রাঃ) মুসলিম বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে এক পরামর্শ সভার আয়োজন করেন। পরামর্শ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর মদীনায় হিজরত করার ঐতিহাসিক দিন থেকে নতুন একটি সন তৈরী করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

Related Post