আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করলাম?

আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করলাম?

আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করলাম?

১৮তম পর্ব এখানে

১৯তম পর্ব

প্রভুর সন্ধানে
সংক্ষিপ্ত পরিচয় :
ফরিদপুর জেলার গোঁসাইর হাই থানাধীন দাসের জঙ্গল গ্রামের এক ভট্টাচার্য পরিবারে আমার জন্ম। পিতার নাম ছিল বাবু শশীকান্ত ভট্টাচার্য। জন্মের লগ্ন ও তিথি-নক্ষত্রাদি বিচার করে আমার নাম রাখা হয়েছিল ‘সুদর্শন’।
বাপ দাদারা খুবই নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ছিলেন বিধায় বাড়ীর প্রতিট ছেলে-মেয়ে যাতে নিষ্ঠাবান হয়ে গড়ে উঠে সেদিকে তাঁদের প্রখর দৃষ্টি ছিল। কাজেই শৈশব আমাকে যে ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যেই কাটাতে হয়েছিল, সে কথা খুলে বলার অপেক্ষা রাখে না।
এখানে বলে রাখা আবশ্যক যে, আমার মনে প্রভু-সন্ধান-স্পৃহা জেগে উঠার পশ্চাতে প্রভু সম্পর্কে অজ্ঞতা বা প্রভুর অবিদ্যমানতার প্রশ্ন ছিল না কেননা, শৈশব থেকে প্রত্যহ বাস্তুদেবতা- রূপী শালগ্রাম শিলার পূজা হতে দেখেছি। বাড়ীতে বিদ্যমান পুরুষ মানুষদের নিত্যনৈমিত্তিক কর্তব্য হিসাবে আহিৃকতর্পণ এবং বাণলিঙ্গের (শিবলিঙ্গ) পূজা করতে দেখেছি।
তাছাড়া, নিষ্ঠাপরায়ণতার সাথে বেশ কিছুটা আর্থিক স্বাচ্ছল্য থাকার কারণে নিজেদের বাড়ীতে বার মাসে তের পার্বনের অনুষ্ঠান হতে দেখেছি। কাজেই বলছিলাম যে, প্রভু সম্পর্কে অজ্ঞতা বা প্রভুর অবিদ্যমানতার প্রশ্ন আমার ছিল না
উল্লেখ্য যে, শুধু চোখে দেখাই নয়, কানে শুনার মাধ্যমে প্রভু বা প্রভুদের পরিচয় লাভের যথেষ্ট সুযোগও সেই শৈশবকাল থেকেই আমার হয়েছিল। এ সম্পর্কে একটি মাত্র ঘটনার কথা তুলে ধরাই যথেষ্ট বলে মনে করি।
ভোরে শয্যা ত্যাগের পূর্বে বাবা, মা এবং অন্যান্যদের মুখে প্রত্যহই “প্রাতঃশ্লোক” পাঠ করতে শুনেছি। সাধারণত ঠাকুরমা বা পিতামহীর সাথে আমি এবং আমার ছোট কাকা গঙ্গাজীবন ঘুমাতাম। ভোরে ঘুম থেকে জেগেই ঠাকুরমা মুখে মুখে শ্লোকটি পাঠ করতেন এবং আমাদেরকেও পাঠ করতে বলতেন। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই শ্লোকটি আমাদের উভয়ের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে অন্যান্যদের মত ভোরে শয্যা-ত্যাগের পূর্বে নিজে নিয়মিতভাবে শ্লোকটি পাঠ করতাম; আর এত শ্রদ্ধা এবং নিবিষ্টতার সাথে পাঠ করতাম যে, আজ প্রায় ৫০ বছর পরেও শ্লোকটি হুবহু স্মৃতিতে গাঁথা রয়েছে এবং পাঠকবর্গের অবগতির জন্য স্মৃতি হতে চয়ন করেই এখানে তা তুলে ধরছি ঃ
প্রভাতে যঃ স্বরেন্নিত্যং দুর্গা-দুর্গাক্ষরদ্বয়ম,
আপদস্তস্য নশ্যন্তি তমঃ সূর্যোদয়ে যথা।
ব্রক্ষ, মুরারী, ত্রিপুরান্তকারী, ভানু, শশী,
ভূমি, সূত, বুধশ্চ, গুরুশ্চ, শুক্র, শনি, রাহু,
কেতু কুর্বন্তি সর্বেমম প্রভাত।
অহল্যা দ্র্রুপদী কুন্তি তারা মন্দোদরী তথা
পঞ্চ-কন্যা স্মরেন্নিত্যং মহাপাতক নাশন,
ইত্যাদি।
অর্থাৎ- সূর্যোদয়ের সাথে যেমনভাবে অন্ধকার দূরীভূত হয় ঠিক তেমনই যে ব্যক্তি প্রভাতকালে ‘দূর্গা’ এ দু’টি অক্ষর স্মরণ করে, তার সকল বিপদাপদ নাশ হয়ে থাকে। ব্রহ্ম, বিষ্ণু, মহাদেব, সূর্য,চন্দ্র, ভূমি, সূত, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, মনি, রাহু এবং কেতু এরা সকলে আমার প্রভাতকে সুপ্রভাতে পরিণত করুক।’
‘যে ব্যক্তি প্রত্যহ অহল্যা, দ্রুপদী, কুন্তি, তারা এবং মন্দোদরী এই পঞ্চ কন্যাকে স্মরণ করে, তার মহাপাপও নাশ হয়ে থাকে।’ মহাপাপ-নাশিনী এই পঞ্চ কন্যার মোটামুটি পরিচয় নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ
(ক) অহল্যা ঃ গৌতম মুনির স্ত্রী। সদ্যস্নাতা এবং আর্দ্র বস্ত্র পরিহিতা অবস্থায় আশ্রমে প্রত্যাবর্তনকালে পথিমধ্যে গৌতম-শিষ্য- দেবরাজ ইন্দ্রের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে।
আর্দ্র বস্ত্রের মিথ্যা আবরণকে ভেদ করে উৎগত যৌবনা অহল্যার রূপলাবণ্য বিশেষ আকর্ষণীয় হয়ে ফুঠে উঠায় ইন্দ্রদেবের পক্ষে ধৈর্যধারণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে; তিনি গুরুপতœী অহল্যার সতীত্ব হরণ করেন।
ত্রিকালজ্ঞ গৌতম মুনির কাছে একথা অজ্ঞাত থাকে না; তাঁর অভিশাপে অহল্যা প্রস্তরে পরিণতা হন-আর ইন্দ্রদবের দেহে ‘সহ¯্র যোনির উদ্ভব ঘটে। এটা দ্বাপর যুগের ঘটনা। সুদীর্ঘকাল পরে ত্রেতাযুগে ঈশ্বরের অবতাররূপে শ্রীরামচন্দ্র আবির্ভূত হন-পদস্পর্শে অহল্যার পাষাণত্ব অপনোদিত হয়।
পদ্ম পুরাণ-৬ষ্ঠ খন্ড-৬৯০ পৃ:
(খ) দ্রুপদীঃ বিখ্যাত পঞ্চ-পান্ডব অর্থাৎ যুধিষ্ঠিত অর্জুন প্রভৃতি পাঁচ ভ্রাতার পতœী।
(গ) কুন্তিঃ পাণ্ডুর স্ত্রী; বিবাহের পূর্বে সূর্যের ঔরসে কর্ণ নামক পুত্রের জন্ম বিবাহিতা অবস্থায় ধর্মের (যমরাজ) ঔরসে যুধিষ্ঠির, বায়ুদবেরে ঔরসে ভীম এবং দেবরাজ ইন্দ্রের ঔরসে অর্জুনের জন্ম হয়।
-অগ্নিপুরাণ ১৩অঃ ৮-১২ শ্লোক এবং মহাভারত
(ঘ) তারাঃ বালী নামক বানরের স্ত্রী। বালীর সাথে ছোট বাই সুগ্রীবের বিরোধ ছিল; সুগ্রীবকে হাতে পাওয়ার উদ্দেশ্যে শ্রীরামচন্দ্র বালীকে নিহত করেন, পরে বালীর স্ত্রী দেবুর সুগ্রীবের হস্তগত এবং স্ত্রীরূপে ব্যবহৃত হয়।
-অগ্নিপুরাণ ৯অঃ ১-৩শ্লোক
(ঙ) মন্দোদরী: রাক্ষস-রাজ রাবণের স্ত্রী।
অতএব একথা বুঝতে পারা সহজ যে, অন্যান্য অনেকের মত আমাকেও জীবনের প্রাতঃকাল থেকে প্রাঃশ্লোকের মাধ্যমে প্রত্যহ এই দশটি গ্রহ-উপগ্রহ, তিনজন পুরুষ এবং ছয়জন নারী – একুনে উনিশটি প্রভু বা উপাস্যের পবিত্র নাম সভক্তি স্মরণ করতে হয়েছে।
মোটকথা, সেই শৈশবকাল থেকেই দেখা এবং শুনার মাধ্যমে বহুসংখ্যক প্রভু বা উপাস্যের পরিচয় লাভের সুযোগ আমার হয়েছিল। তাই বলছিলাম যে, প্রভু বা উপাস্যের অভাব বা অদর্শন আমার মনে প্রভু-সন্ধান স্পৃহা জাগিয়ে তুলেছিল না, কিভাবে এই স্পৃহা জেগে উঠেছিল অতঃপর সে কথাই বলছি।
ঘটনার সূত্রপাত
রায়ের বাড়ীর (জমিদার গোলকচন্দ্র রায়) পাঠশালায় পড়তে যেতাম। ডাকঘরও ছিল ঐ বাড়ীতেই পঠশালার পথে। বাবা, ঠাকুরদাদা প্রভৃতির নামে বহু জায়গা থেকে পত্র আসতো। ব্যবস্থানুযায়ী বাড়ী ফেরার পথে ডাকঘর থেকে আমাদের ঠিকানায় লিখিত পত্রগুলো আমাকে গ্রহণ করতে হতো।
কৌতুহলবশে পথে চলতে চলতে পোষ্টকার্ডে লেখা পত্রগুলো পড়তে চেষ্টা করতাম। প্রথমদিকে খুবই কষ্ট হতো। বানান করে করে কোন মতে পাঠোদ্ধার করতাম। প্রতিটি পত্রের শীর্ষে লিখিত দেব-দেবীর নাম থেকেই শুরু করতাম। প্রায়ই ভিন্ন ভিন্ন পত্রে ভিন্ন ভিন্ন দেব-দেবীর নাম লিখিত থাকতো। আজও স্মৃতিতে গাঁথা রয়েছে এমন কতগুলো নাম নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ
শ্রী শ্রী কালী শরণম, শ্রী শ্রী দূর্গা সহায়, নারায়ণ শরফ, গনেশয় নমঃ প্রজাপতি শরণম, বাগদেবী শরণং, হরি সহায়, লক্ষèীমাতা শরণং, জয়মা সিদ্ধেশরী, জয়মা জগদম্ব, হুংফট, ওঁ, ওম, শ্রীশঃ, শ্রীং হং, রিং ক্লিং ইত্যাদি।
কিজানি কেন হঠাৎ একদিন মনে প্রশ্ন জেগে বসলো- আমি বড় হয়ে যখন পত্র লিখবো তখন কোন নামটি ব্যবহার করবো। অর্থাৎ এতসব দেব-দেবীর মধ্যে কে বড় এবং সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য?
কৌতুহলী মন নিয়ে একদিন ঠাকুরমাকে প্রশ্ন করলাম, তিনি বললেন- ‘‘এঁদের কেউই ছোট নয়, সকলেই বড় এবং সকলেই গ্রহণযোগ্য।” মনের খটকা মিটলা না। তাই আবার প্রশ্ন করলাম- সবাই যদি বড় এবং গ্রহণযোগ্য হয় তবে আমিতো সবগুলোকে বাদ দিয়ে একটি নামই লিখবো, এমতাবস্থায় বাদ পড়া দেব-দেবীরা রাগ করবে না? “উত্তরে ঠাকুরমা বলেছিলেন- “ছেলে মানুষের এত কথা ভাল নয়, মন দিয়ে লেখা-পড়া কর, বড় হয়ে যখন শাস্ত্র পড়বি তখন সবই জানতে পারবি।” অতঃপর ধমক খাওযার ভয়ে ঠাকুরমা বা বাড়ীর অন্য কাউকে আর এ সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করিনি- মনের খটকা মনে চেপে রেখে ঠাকুরমার কথামত পড়াশুনায় মন দিয়েছি।
পাঠশালার দু’জন পন্ডিত। প্রধান কফিলউদ্দীন ঢালী, সহকারী অবনমোহন দাশ। একজন মুসলমান; অন্যজন নমশূদ্র বা চাঁড়াল।
ছোট কাকা গঙ্গাজীবন বয়সে আমার চেয়ে ছ’ মাসের ছোট। একসাথেই পাঠশালায় ভর্তি হয়েছি। আমরা অবুঝ হলেও অভিবাকেরাতো আর অবুঝ ছিলেন না? তাই ভর্তির দিনই বাবা পন্ডিতদ্বয়কে লক্ষ্য করে সুস্পষ্ট ভাষয় বলে দিয়েছিলেন- ‘দেখ হে বাপু! আমাদের ছেলেদের গায় হাত তুলে জাত মারবে না, অপরাধ করে আমাদের কাছে বলবে; শাস্তি দিতে হয় আমরাই দিব।’
বলা আবশ্যক যে, শৈশব থেকেই নানাভাবে একথা জেনে আসছিলাম যে, মুসলমানরা স্লেচ্ছা এবং ছোট লোক, ওদের আচার-বিচার নেই, ধর্ম-কর্ম নেই, অখাদ্য ভক্ষণ আর মাথা ফাটা-ফাটি, মামলা-মোকদ্দমা, মিথ্যা-সাক্ষ্যদান, চুরি-ডাকাতি প্রভৃতি হলো ওদের কাজ। মুসলমান বাড়ী অনেক দূরে, তাই মুসলমান দেখার সুযোগ ইতিপূর্বে আমার হয়েছিল না। অর্থাৎ হেড পন্ডিত সাহেবই ছিলেন আমার দেখা প্রথম মুসলমান।
প্রথম দিকে খুব ভয়ে ভয়ে থাকতাম। হেড পন্ডিত সাহেবকে কোন ছেলের উপর রাগ করতে দেখলেই ভয়ে জড় সড় হয়ে কাঁদতে শুরু করতাম। মনে হতো- এখনই বোধ হয় মাথা পাঠাতে শুরু করবেন।
আমার এই করুণ অবস্থার প্রতি একদিন প-িত সাহেবের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়, তিনি কাছে ডেকে আদর করতে থাকেন এবং কান্নার কারণ জানতে চান।
আমিও মুসলমান সম্পর্কে এতদিন যা শুনেছি সরলভাবে সেকথা তাঁকে জানাই এবং মাথা ফাটানোর ভয়ই যে আমার কান্নার কারণ সেকথাও বলে ফেলি। তিনি অত্যন্ত স্নেহের সাথে আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বলেন – দূর বোকা! যারা ওসব করে তারা কি মুসলমান? তোমরা যেমন হিন্দু হয়েও হিন্দু চোর-ডাকাত প্রভৃতিকে ঘৃণা কর, আমরাও ঠিক তেমনই মুসলমান হয়েও তোমাদেরই মতো মুসলমান নামধারী চোর-ডাকাত প্রভৃতিকে ঘৃণা করি। মনে রাখবে, যারা খাঁটি মুসলমান তারা কোন অন্যায়ই করতে পারে না। কাজেই আজ থেকে কখনো মাথা ফাটানোর ভয় করবে না। দেখবে কেউ যদি তোমাদের মাথা ফাটাতে আসে আমি নিজের জীবন দিয়ে হলেও তোমদেরকে রক্ষা করবো। সেদিন থেকে শুধু মাথা ফাটানোর ভয়ই কেটে গিয়েছিল না-পন্ডিত সাহেবের প্রতি শ্রদ্ধা এবং মমতায় মন ভরে উঠেছিল।
ছোট কাকা ছিলেন হিংসুটে প্রকৃতির। তাই পন্ডিত সাহেব কর্তৃক আমাকে আদর করতে দেখে তার মনে হিংসার উদ্রেক হয়েছিল এবং বাড়ীতে ছুটে গিয়েই ঠাকুরমার কাছে ইনিয়ে-বিনিয়ে সব কথা তিনি বলে দিয়েছিলেন। এমন কি মাষ্টার সাহেব যে আমাকে ছুয়ে দিয়েছেন অর্থাৎ কাছে টেনে নিয়ে আদর করেছেন সেকথা বলতেও ত্রুটি করেননি।
মুসলমান পন্ডিত আমাকে ছুঁয়েছেন একথা জানতে পেরে ঠাকুরমা আমাকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘হারে গেলাম! শিগগির যা, ঐ কাপড় চোপড় নিয়েই ডুব দিয়ে আয়। আর খবরদার! কখনো মুসলমানকে ছুবি না ওরা যদি ছুঁয়ে ফেলে তাহলে স্নান না করে ঘুরে ঢুকবি না।” ঠাকুরমার কথায় স্নান অবশ্যই করেছিলাম; কিন্তু কেন স্নান করতে হলো সেটা বুঝে উঠতে পেরেছিলাম না
জানি না, কেন পন্ডিত সাহেব অন্য ছেলেদের তুলনায় আমাকে একটু বেশি স্নেহ করতেন। লক্ষ্য করতাম আমার দিকে নযর পড়তেই তাঁর চোখে মুখে কেমন একটা স্নেহের ভাব ফুটে উঠতো। অতএব, বাইরে ছোঁয়া-ছোঁয়ির ভয় থাকলেও আমার ভিতরের মনটা আমার অজ্ঞাতেই তাঁর ধরা ছোাঁয়ার সীমানায় চলে গিয়েছিল। (চলবে…)

Related Post