জানাযার সালাত বা নামায

জানাযা পড়ার নিয়মাবলি

জানাযা পড়ার নিয়মাবলি

জানাযা পড়ার নিয়মাবলি
জানাযার সালাতে ৪টি তাকবীব দিবে। মনে মনে নিয়ত করে প্রথম তাকবীর দিয়ে হাত বাঁধবে। অতঃপর ’আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজীম’ ও ’বিস্মিল্লাহির রাহমার্নি রাহীম’ পড়ে সূরা ফাতিহা পড়বে। এরপর অন্য একটি সুরা পড়বে। তারপর দ্বিতীয় তাকবীর দিয়ে নামাযে পঠিত দরূদ শরীফটি পড়বে। অতঃপর তৃতীয় তাকবীর দিয়ে নিম্নের যেকোনো একটি অথবা দুটি দু’আই পড়বে। সর্বশেষ চতুর্থ তাকবীর দিয়ে ডানে ও বামে সালাম ফিরিয়ে জানাযার সালাত শেষ করবে।
ক. ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন,
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَرَأَ عَلَى الْجِنَازَةِ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ
’ নবী (সা.) জানাযার সালাতে সূরা ফাতিহা পড়তেন’ (তিরমিযী-১০২৬)
খ. তালহা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আউফ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
قَالَ صَلَّيْتُ خَلْفَ ابْنِ عَبَّاسٍ عَلَى جَنَازَةٍ فَقَرَأَ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ، لِتَعْلَمُوْا أَنَّهَا سُنَّةٌ
’আমি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর পেছনে জানাযার সালাত আদায় করেছি। তাতে তিনি সূরা ফাতিহা পাঠ করলেন এবং জানাযা শেষে বললেন, লোকেরা যেন জেনে নেয় যে, জানাযার নামাযের এটাই পদ্ধতি। (বুখারী: ১৩৩৫, ইফা; ১২৫৪, আধুনিক ১২৪৭) আরবী ইবারতে এখানে ’সুন্নাহ’ শব্দটি মুস্তাহাব অর্থে আসেনি। বরং সূরা ফাতিহা পড়া ছিল রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আমল এ অর্থ বোঝানো হয়েছে। (দেখুন: ওয়েবসাইট িি.িরংষধস-য়ধ.পড়স, উত্তর নং ৭২২২১)
গ. তাছাড়া সাহাবী ইবনে মাসউদ (রা.) ও জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন। (বায়হাকী ৪র্থ খন্ড, পৃ.৬৪-৬৫)
ঘ. হানাফী ও মালেকী ফকীহগণ জানাযায় সূরা ফাতিহা না পড়ার পক্ষে কোনো হাদীস আনেননি। তবে সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) একটি আছর-কে দলীল হিসেবে পেশ করেছেন:
كَانَ لاَ يَقْرَأُ فِى الصَّلاَةِ عَلَى الْجَنَازَةِ
’তিনি জানাযায় (সূরা ফাতিহা) পড়তেন না (মুয়াত্তা মালেক: ৫৪৬, ৭৭৭)।
উল্লেখ্য, আছারের গুরুত্বের উপর হাদীসের গুরুত্ব অনেক বেশি। কাজেই সূরা ফাতিহা পড়া অতীব গুরুত্ববহ। ইমাম ইবনে তাইমিয়া সূরা ফাতিহা পড়াকে মুস্তাহাব বলেছেন। (ফাতাওয়া কুবরা: ২/১২১) ইমাম শাফেয়ী (রা.) ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রা.) জানাযার নামায সূরা ফাতিহা পড়াকে রুকন বলেছেন। শায়খ উসাইমিন (রহ.)ও এটাকে রুকন বলেছেন (শরহুল মুমতি: ৫/৪০১)। আর রুকন হলো এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যা বাদ গেলে জানাযা বাতিল হয়ে যায়। সাউদী গ্রান্ড মুফতী শায়খ বিন বায (রহ.) বলেছেন জানাযায় সূরা ফাতিহা পড়া ওয়াজিব। (ফাতাওয়া বিন বায: ১৩/১৪৩) আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) ও জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠের পক্ষে মত দিয়েছেন। (গুনিয়াতুত্ তালেবীন) উল্লেখ্য কেউ কেউ প্রথম তাকবীরের পর শুধু ছানা (অর্থাৎ সুব্হানাকা আল্লাহুম্মা…..) পড়েন; অথচ এর সপক্ষে কোনো সহীহ হাদীস খুঁজে পাওয়া যায় না। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর মতে, প্রথম তাকবীরের পর আ’উযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ…. এবং পরে সূরা ফাতিহা পড়বে। কিন্তু ছানা পড়বেন না।
জানাযার দোয়া-১
আবূ হোরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন জানাযার সালাত পড়াতেন তখন এই দু’আ পড়তেন।
اللهم اغْفِرْ لِحَيِّنَا وَمَيِّتِنَا ، وشَاهِدِنَا وَغائِبِنَا، وَصَغيرِنَا وَكَبِيْرِنَا، وَذَكَرِنَا وَأُنْثَانَا، اللَّهُمَّ منْ أَحْيَيْتَهُ مِنَّا فأَحْيِهِ عَلَى الْإسْلَامِ ، وَمَنْ توَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلَى الْإِيْمَانِ ، اللهم لَا تَحْرِمْنَا أَجْرَهُ ، وَلَا تَفْتِنَّا بَعْدَهُ
’হে আল্লাহ! আমাদের জীবিত ও মৃত এবং (এই জানাযায় ) উপস্থিত ও অনুপস্থিত, আর আমাদের ছোট ও বড় এবং আমাদের নর ও নারী সবাইকে ক্ষমা করো। হে আল্লাহ! আমাদের মধ্য থেকে তুমি যাকে বাঁচিয়ে রাখবে তাকে তুমি ইসলামের উপরে বাঁচিয়ে রাখো এবং যাকে তুমি মারতে চাও তাকে তুমি ঈমানের অবস্থায় মৃত্যু দাও। আর আল্লাহ এই লাশের প্রতিদান থেকে তুমি আমাদের বঞ্চিত করো না এবং পরে আমাদেরকে ফিতনায়ও ফেলো না।’ (আবূ দাউদ ৩২০১, তিরমিযী ১০২৪)
জানাযার দোয়া-২
اللهم اغْفِرْ لَهُ وَارْحَمْهُ، وَعَافِهِ وَاعْفُ عَنْهُ ، وَأَكْرِمْ نُزُلَهُ ، وَوَسِّعْ مُدْخَلَهُ ، وَاغْسِلْهُ بِالْمَاءِ وَالثَّلْجِ وَالْبَرَدِ ، وَنَقِّهِ مِنَ الْخَطَايَا كَمَا يُنَقَّى الثَّوْبُ الأَبْيَضُ مِنَ الدَّنَسِ ، وَأَدْخِلْهُ دَارًا خَيْرًا مِنْ دَارِهِ ، وَأَهْلًا خَيْرًا مِنْ أَهْلِهِ ، وَزَوْجًا خَيْرًا مِنْ زَوْجِهِ ، وَأَدْخِلْهُ الْجَنَّةَ ، وَأَعِذْهُ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ ، وَمِنْ عَذَابِ النَّارِ
’হে আল্লাহ! তুমি তাকে ক্ষমা করো, তার উপর রহম করো, তাকে পূর্ণ নিরাপত্তায় রাখো, তাকে মাফ করো, মার্যদার সাথে তার আতিথিয়েতা করো। তার বাসস্থানটা প্রশস্ত করে দাও, তুমি তাকে ধৌত করে দাও- পানি, বরফ ও শিশির দিয়ে। তুমি তাকে গুনাহ হতে এমন ভাবে পরিস্কার করো যেমন সাদা কাপড়কে ময়লা থেকে পরিস্কার করা হয়। আর তার পার্থিব ঘরের বদলে তুমি তাকে একটি উত্তম ঘর দান করো এবং তার পরিবারের বদলে এক উত্তম পরিবার এবং জুড়ির বদলে এক উত্তম জুড়ি দান করো। আর তাকে তুমি জান্নাতে দাখিল করো এবং কবরের আযাব ও জাহান্নামের আগুনের শাস্তি থেকে তাকে মুক্তি দাও।
জানাযার বিষয়ে কয়েকটি মাসআলা
১. জানাযার সালাত ফরযে কেফায়াহ।
২. ওযূ করে সতর ঢেকে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়াবে।
৩. দিবা-রজনীর যেকোনো সময় জানাযা পড়া যায়, এমনকি নিষিদ্ধ সময়েও।
৪. মাইয়্যেতের মাথা উত্তর দিকে রাখবে।
৫. চতুর্থ তাকবীরের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) একটু থামতেন, অতঃপর সালাম ফিরাতেন।
৬. দুদিকে সালাম ফিরানোর যেমন নিয়ম রয়েছে তেমনই একদিকে শুধু ডান পাশে সালাম ফিরানোও জায়েয। এর পক্ষেও সহীহ দলীল রয়েছে।
৭. প্রতি তাকবীরের পর দু’হাত কাঁধ বা কান বরাবর উঠানো জায়েয। তবে এটার সপক্ষের হাদীসকে কেউ কেউ দুর্বল বলেছেন। আবার অনেকে বিশুদ্ধও বলেছেন।
৮. শিশুদের জানাযা হলে দু’আর শেষে এটুকু বাড়িয়ে পড়বে-
اللهم اجْعَلْهُ لَـنَا فَرَطَاً، وَسَلَفاً، وَأَجْراً
“হে আল্লাহ! তুমি এ শিশুকে আমাদের জন্য পূর্ববর্তী ও অগ্রগামী এবং পরকালের ধনভান্ডার ও পুরস্কার বানিয়ে দাও।”
৯. পর্দার সাথে মেয়েরাও পুরুষদের পেছনে জানাযার সালাত পড়তে পারে। মক্কা ও মদীনায় এখনো এ রীতি চালু আছে।
১০. জানাযা পুরো না পেলে যতটুকু পায় ততটুকু পড়ে ইমামের সাথে সালাম ফিরাবে।
১১. জানাযায় ইমাম যা যা পড়বেন, পেছনে মুক্তাদিরাও তা-ই পড়বেন। অর্থাৎ মুক্তাদিরাও তাকবীর বলবেন এবং দু’আগুলো পড়বেন।
১২. নিজের সন্তান বা আত্মীয়-স্বজনের পক্ষ থেকে কেউ জানাযার ইমামতি করা ফকীহগণ উত্তম বলে মনে করেন। তবে এর পক্ষে সরাসরি কোনো হাদীস পাওয়া যায় না।
১৩. জানাযার পর মাইয়্যেতের মুখ দেখতে হাদীসে কোনো নিষেধাজ্ঞা আসেনি।
১৪. একই ব্যক্তির একাধিক জানাজা যেমন বৈধ, তেমনি একাধিক মাইয়্যেতের জানাযা একসঙ্গে দেওয়াও জায়েয।
১৫. গায়েবানা জানাযা জায়েয আছে।

গ. জানাযার ফরজসমূহ
১. চারটি তাকবীর দেওয়া।
২. সূরা ফাতিহা পাঠ করা।
৩. দরূদ পড়া।
৪. মাইয়্যেতের জন্য খালেস দিলে দু’আ করা। (অর্থাৎ তৃতীয় তাকবীরের পর সালাম ফিরানোর আগে যে দু’আটি পড়া হয় সেটি)
৫. সালাম ফিরানো।

ঘ. জানাযার সুন্নাতসমূহ
১. জামা’আতসহকারে সালাত আদায়।
২. তিন কাতার হওয়া (অর্থাৎ এর কম না হওয়া)। তবে কাতারগুলো বেজোড়সংখ্যক হতে হবে এ ধরনের কোনো কথা হাদীসে পাওয়া যায় না।
৩. ইমাম দাঁড়াবে লাশ পুরুষ হলে মাথা ও মহিলা হলে লাশের কোমর বরাবর।
৪. হাদীসে বর্ণিত দু’আ করা (অর্থাৎ তৃতীয় তাকবীরের পর যে দু’আগুলো করা হয়)
৫. সালাত শেষে জানাযা উঠানো পর্যন্ত দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা। উল্লেখ্য, জানাযার নামাযের পর সম্মিলিত কোনো মোনাজাত নেই। তবে লাশ দাফনের পর তার পক্ষ থেকে দু’আ করা যেতে পারে। মাইয়্যেতের জন্য তখন তাওবা-ইসতিগফার করা সুন্নাত।

Related Post