দরদী বন্ধু: শিক্ষণীয় ঘটনা

দরদী বন্ধু  শিক্ষণীয় ঘটনা

দরদী বন্ধু শিক্ষণীয় ঘটনা

পূর্বে প্রকাশিতের পর:

 শেষ পর্ব

খোযায়মার পরীক্ষা তো শেষ হলো। এবার শুরু হলো ইকরামার পরীক্ষা। কী ছিল সেই পরীক্ষা? কেমন ছিল সেই পরীক্ষার ধরন?
ইকরামার পরীক্ষাও কি খোযায়মার পরীক্ষার মতো কঠিন ছিল?
হ্যাঁ, কঠিনই ছিল তাঁর পরীক্ষা। শক্তই ছিল তাঁর ইম্তেহান।
পরীক্ষার প্রথম ধাপ তো এই ছিল যে, খোযায়মাকে যে উপদ্বীপের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হলো, এতদিন সেই উপদ্বীপেরই শাসনকর্তা ছিলেন ইকরামা ফাইয়ায।
যেদিন খোযায়মার হাতে নতুন শাসনকর্তা হওয়ার ‘পরওয়ানা’ তুলে দেওয়া হয়েছিল, ঠিক সেদিনই ইকরামার হাতে পৌঁছে গিয়েছিল তার ‘অব্যহতিপত্র’।
প্রিয় পাঠক! কল্পনা করুন তো!! যে খোযায়মার দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনে রাতের আঁধারে স্বর্ণমুদ্রার থলে নিয়ে তিনি হাজির হয়েছিলেন, সেই খোযায়মাকেই তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হলো! আর তাকে করা হলো, বরখাস্ত!! ওহ! আল্লাহর লীলা কত বিচিত্র!!
অবশ্য খোযায়মার কাছে তখনও উদ্ঘাটিত হয়নি সেই রহস্য!

খোযায়মা এখন নতুন শাসনকর্তা। দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চললেন তিনি। গন্তব্য ‘রাকা’ শহর। যেখানে রয়েছে শাসনকর্তার কার্যালয় ও বাসভবন।
এ খবর জানতে পেরে শহরের জনগণ বাইরে বেরিয়ে এল এবং শহরের নিকটবর্তী হতেই তারা নতুন শাসনকর্তাকে স্বাগত জানাল।
আশ্চর্যের কথা হলো, জনতার সেই ভিড়ে ছদ্মবেশে মিশে ছিলেন সাবেক শাসনকর্তা ইকরামা ফাইয়াযও!
আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, তখন ইকরামার মনে কোনো ক্ষােভ ছিল না! ছিল না পদ হারানোর বেদনা বা বিরক্তির কোনো চিহ্ন!! বরং তাঁর হাসি ছিল আগের মতোই অকৃত্রিম, আগের মতোই দিলখোলা।
আল্লাহু আকবার! কত মহান, কত উদারচিত্তের মানুষ ছিলেন তাঁরা!

তখন নিয়ম ছিল নতুন শাসক পুরাতন শাসকের কাছ থেকে কড়ায় গণ্ডায় হিসেব বুঝে নিতেন এবং কোনো রকম অনিয়ম ধরা পড়লে তড়িৎ বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা করতেন। খলীফার পক্ষ থেকে তেমন ক্ষমতাই তাকে দেওয়া হতো।
সেই নিয়ম অনুযায়ী নতুন শাসক খোযায়মা পুরাতন শাসক ইকরামার কাছে হিসেব তলব করলেন।
হিসেব নিতে গিয়ে খোযায়মার মনে হলো, খরচ খাতের একটি জায়গায় অনিয়ম হয়েছে। এদিকে সাবেক শাসনকর্তা ইকরামাও তার সন্তোষজনক কোনো জবাব দিলেন না। লুকিয়ে রাখা ‘আসল কথা’টি লুকিয়েই রাখলেন। ভাবলেন, যে কথা আমি ও আমার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ জানে না, যে কাজের সাক্ষী একমাত্র মহান আল্লাহ পাক, সেই কথা, সেই কাজ গোপনই থাকুক। যদি এজন্য আমার সামনে নতুন কোনো বিপদ আসে, আসুক। তাতে আমার কোনো পরওয়া নেই। কারণ, হাশরের ময়দানে তো আল্লাহর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলতে পারব, হে মাওলায়ে পাক! আঁধার রাতে একমাত্র তোমার সন্তুষ্টির জন্য যে কাজটি আমি করেছিলাম, সেটি আমি অপারগ হয়ে একমাত্র স্ত্রী ছাড়া আজো সবার কাছ থেকে গোপন করে রেখেছি।
ফল যা হবার তাই হলো।
আরেকবার ইকরামার ভাগ্য-বিপর্যয় ঘটল।
জেল গেইট পার হয়ে তাঁকে যেতে হলো আরো অনেক ভিতরে, কারা অভ্যন্তরে!
ওহ! নিজেকে এবং নিজের সৎকর্মকে লুকিয়ে রাখার কী কঠোর সাধনা! আরশের ছায়া প্রাপ্তির আশায় কত ভয়াবহ পরিস্থিতিকে মেনে নিচ্ছেন এক আল্লাহওয়ালা শাসক!!
আহা! যদি এমন মানুষ দ্বারা জগতটা পূর্ণ হতো!! অন্ততঃ অধিকাংশ মানুষ যদি এমন হতো, তাহলে অশান্তি ও বঞ্চনার এই পৃথিবীতে কি শান্তির সুবাতাস বইত না? পরিবার, সমাজ ও দেশ কি আরো সমৃদ্ধশীল হতো না?

কারাগারের অন্ধ কুঠরীতে ইকরামা এখন বন্দী। ফুলের স্নিগ্ধ সুবাস আর রেশম কোমল বিছানায় কেটেছে যার জীবন, তিনি এখন শক্ত রুটি খেয়ে আর চটের বিছানায় শুয়ে দিন কাটান। একসময় যার মজলিশ মানুষের আনাগুনায় মুখরিত থাকত, যার অঙ্গুলি হেলনে উঠ্বস্ করত হাজারো মানুষ, সেই তিনি আজ নির্জন কামরায় অনুমান করে দিন রাতের পার্থক্য করেন! অদ্ভুত! বড় অদ্ভুত মানুষের জীবন!! কিন্তু এই কঠিন অবস্থার মধ্যেও ইকরামা স্থির- প্রশান্ত। একেবারেই ভাবলেশহীন তিনি। এরূপ ভয়ানক পরিস্থিতিতে নিপতিত হওয়া সত্ত্বেও এমন অপূর্ব ও নিরুদ্বিগ্ন সুন্দর মুখচ্ছবি খুব একটা দেখা যায় না।
কিন্তু ইকরামার স্ত্রী?
প্রাণের স্বামী বন্দী হওয়ার পর তার মাথায় যেন বিপদ-মুসীবতের পাহাড় ভেঙ্গে পড়ল। আসলে কোনো সম্ভ্রান্ত মানুষ যখন বন্দী হন, তখন তার যতো না কষ্ট হয়, তার চেয়ে বহুগুণে বেশি কষ্ট হয় ‘গৃহ-কারাগারে’ আবদ্ধ তাঁর পরিবার পরিজনের। কেননা এ সময় তারা প্রিয়জনের বিচ্ছেদ-যন্ত্রণার পাশাপাশি মন্দ প্রতিবেশীদের বিদ্রুপ-যন্ত্রণায়ও ভোগেন। ইকরামার স্ত্রীও এমনই যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে চললেন।
প্রতিবেশীদের মধ্যে যারা ভালো তারা অবশ্য তাকে যন্ত্রণা দেয় না বরং উল্টো সুন্দর সুন্দর পরামর্শ দেয়। কেউ কেউ বলে, আপনি নতুন শাসনকর্তা খোযায়মার কাছে যান। কেননা তিনি দয়ালু মানুষ। অবলা নারীর অসহায়ত্ব অবশ্যই তাঁর হৃদয়কে নাড়া দিবে। ফলে আপনার স্বামীর মুক্তির ব্যাপারটি নতুন করে বিবেচনায় নিবেন তিনি।
ইকরামার স্ত্রী এসব পরামর্শ শোনেন আর ভাবেন, তার কাছে তো স্বামী-মুক্তির আরেকটি মজবুত উপায়ও রয়েছে। যা অবলম্বন করলে শুধু স্বামী-মুক্তিই নয়, দুঃখের জীবন শেষ হয়ে তাদের জীবনে পুনরায় উদ্ভাসিত হতে পারে শান্তি-সুখের রঙিন আলো! নতুন শাসককে তিনি যদি শুধু বলেন, ‘হে অকৃতজ্ঞ আমীর! মুখোশধারী ঘোড়সওয়ারকে স্মরণ করো। স্মরণ করো, আঁধার রাতের দরদী বন্ধুকে’ তাহলেই তো সব বিপদ দূর হয়ে যেতে পারে। আসান হয়ে যেতে পারে যাবতীয় সমস্যা।
কিন্তু বলতে যে মানা!
তিনি যে ওয়াদাবদ্ধ!!
স্বামী যে বলেছেন, আমার এই গোপন অভিযানের খবর আল্লাহ ছাড়া আর কেউ যেন না জানে!
স্বামীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির অমর্যাদা, কী করে করতে পারেন তিনি?
হোক না তা স্বামীর জীবন রাক্ষর জন্যেই!
‘জীবন’ বড় না ‘ওয়াদা’ বড়?

কিন্তু এভাবে আর কতদিন? কতদিন স্বামীকে জেলে রেখে স্ত্রী আরামে থাকতে পারে? কতদিন তাঁর বিরহ-যন্ত্রণা ভোগ করতে পারে?
এক এক করে তো আজ ত্রিশটি দিন গত হলো। পূর্ণ একটি মাস যন্ত্রণার আগুনে দগ্ধ হলো ইকরামার স্ত্রী। এবার কী হবে? হ্যাঁ, যা হবার তাই হবে। যা হবার তাই হলো। স্বামীর প্রতি নারীর চিরন্তন মমতা ভেঙ্গে দিল– প্রতিশ্রুতির প্রাচীর! ভাসিয়ে নিল ধৈর্যের বাঁধ!!
ইকরামা ফাইয়াযের স্ত্রী তার খাস দাসীকে ডেকে সবকিছু বুঝিয়ে দিলেন। তারপর তাকে পাঠিয়ে দিলেন নতুন শাসনকর্তা খোযায়মা’র মহলে।
বুদ্ধিমতি দাসী খোযায়মার সামনে হাজির হয়ে চোখে চোখ রেখে বলল, মুহতারাম আমীর! সেই মুখোশধারী ঘোড়সওয়ারকে স্মরণ করুন।
দাসীর কথায় চমকে উঠলেন খোযায়মা। কণ্ঠ তাঁর অস্থির হয়ে ওঠল। জিজ্ঞেস করলেন, কে তিনি? কোথায় তিনি? আজ অনেকদিন যাবত তাঁকে আমি খুঁজে ফিরছি। তাঁকে যে আমার বড্ড প্রয়োজন!!
দাসী বলল, তিনি তো আপনার আদেশে আপনার কারাগারেই বন্দী আছেন!
কী বললে আমার আদেশে আমার কারাগারে বন্দী?
হ্যাঁ।
তাঁর নাম বলো তাড়াতাড়ি।
ইকরামা। ইকরামা ফাইয়ায।
ইকরামা!!
‘ইকরামা’ নামটি শুনতেই গোটা জগত যেনো খোযায়মা’র সামনে দুলে ওঠল। তাঁর মনে পড়ে গেল, কোষাগারে রক্ষতি চার হাজার দিনার সংক্রান্ত ‘অসীয়ত নামা’র কথা। যার কোনো সদুত্তর তিনি ইকরামার কাছে পাননি। এখন সবকিছু যেনো তাঁর সামনে দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার হয়ে গেল।
খোযায়মার আর দেরী সহ্য হলো না। তিনি ছুটলেন কারাগারের দিকে। উপস্থিত লোকজনও হতভম্ব হয়ে অনুসরণ করল আমীরকে।
অবশেষে ইকরামাকে কারামুক্ত করে তার সামনে যখন খোযায়মা দাঁড়ালেন, তখন লজ্জায় আর অনুশোচনায় মাথা উঠাতে পারছিলেন না তিনি। শুধু অবনতমস্তকে বলতে পেরেছিলেন, আমার ভুল ক্ষমা করো বন্ধু!
ইকরামা কোনো উত্তর দিলেন না। তাঁর মুখমণ্ডলে মুক্তির আনন্দও দেখা গেল না। তিনি শুধু আফসোস করে বললেন, বুদ্ধিমতি স্ত্রী একি করল!
এরপর কী হলো?
এরপর খোযায়মা কালবিলম্ব না করে ইকরামাকে নিয়ে খলীফার দরবারে হাজির হলেন। সালাম ও আদব নিবেদনের পর বললেন, আমীরুল মুমেনীন! সেই মুখোশধারী ঘোড়সওয়ারের পরিচয় আমি পেয়েছি। তিনি আর কেউ নন তিনি হলেন, সাবেক শাসনকর্তা, ইকরামা ফাইয়ায!
ইকরামা ফাইয়ায!!
খলীফার কণ্ঠে সীমাহীন বিস্ময়।
সামান্য সময় পর ইকরামা হাজির হলেন খলীফার দরবারে। তাঁকে দেখেই খলীফা উচ্ছসিত কণ্ঠে বললেন, ইকরামা! তোমার মহত্ত্ব আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করেছে। বলো, কী পুরস্কার চাও তুমি।
আমীরুল মুমেনীন! আমি আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া আর কোনো পুরস্কার চাই না।
ইকরামার এ কথায় খলীফা আরেক দফা মুগ্ধ হলেন।
কয়েক মুহূর্ত মাথা নিচু করে কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, কিন্তু আমি তোমাকে পুরস্কৃত করতে চাই। তোমার মতো মহৎপ্রাণ ব্যক্তিরা পুরস্কৃত না হলে আমার হৃদয়ে কখনোই প্রশান্তি আসবে না।
এরপর খলীফা ইকরামা ফাইয়াযকে আরমেনিয়া ও আজার-বাইজানসহ আরব উপ-দ্বীপের শাসনকর্তা নিযুক্ত করলেন। আর বললেন, খোযায়মার ভাগ্য এখন তোমার হাতে। তাকে বরখাস্ত করা কিংবা সহকারীরূপে স্বীয় পদে বহাল রাখা, এ দুয়ের যে কোনো একটি গ্রহণ করতে পারো তুমি।
খলীফার কথা শুনে ইকরামা ফাইয়ায আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন এবং খোযায়মার হাত ধরে বললেন, তোমার চেয়ে ভালো মানুষ কোথায় পাবো আমি? এ বলে তিনি তাকে বুকে টেনে নিলেন।
খলীফা সোলায়মানের মৃত্যু পর্যন্ত ইকরামা ও খোযায়মা স্ব স্ব পদে বহাল ছিলেন।
আর তাঁদের বন্ধুত্ব?
সে কি আর বলতে হয়?
এমন দু’টি পবিত্র হৃদয়ের মাঝে যে বন্ধুত্বের বন্ধন, তা কি কখনো ছিন্ন হতে পারে?

Related Post