বান্দা ও বন্দেগী

বান্দা ও বন্দেগী

বান্দা ও বন্দেগী

বান্দা ও বন্দেগী

আল্ হাম্দুলিল্লাহ্ ওয়াস্ সালাতু ওয়াস্ সালামু আলা রাসূলিল্লাহ, আম্মা বাদঃ
আমরা আল্লাহর বান্দা। এটি সবার জানা। কিন্তু বান্দা শব্দটির সম্পর্কে কি আমরা কখনো চিন্তা-ভাবনা করেছি , যে এই শব্দটির মর্মার্থ কি ? এর দ্বারা কি বুঝায় ? বান্দা ফারসী শব্দ যার আরবী হচ্ছে ‘‘আব্দ’’ অর্থাৎ দাস। তাই আমরা সকলে ইবাদুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর বান্দা সকল।
বান্দা বা দাসের কাজ হচ্ছে তার মালিকের দাসত্ব করা, গোলামী করা। মালিকের নিকট সেই দাসই সর্ব্বোৎকৃষ্ট, যে তার মালিকের সত্যিকারার্থে দাসত্ব করে, গোলামী করে। কিন্তু তাঁর অনেক বান্দা এমনও আছে যারা আল্লাহর দাসত্ব করে না, করতেও চায়না । দাসত্ব করা যে বান্দাদের কর্তব্য তা বিশ্বাস করে না। অথচ পৃথিবীতে সেই যখন কোন ধনি মানুষের নিকট কিংবা কোন কম্পনীতে কাজ করে , তখন সে তাকে মালিক মনে করে, তাকে বিশ্বাস করে, তার আদেশ নিষেধ শোনে ও মানে । এর কারণ স্বরূপ সে বলে বা মনে করে যে, তার এই মলিক তাকে দাসত্বের বিনিময়ে বিনিময় বা পয়সা-কড়ি দেয়, তাই সে তার কাজ করে।
মনে রাখা দরকার, এই মালিক তখন বিনিময় দেয় যখন সে তার কাজ করে দেয় কিন্তু  মহান আল্লাহ তো তার সকল বান্দাদের অনেক কিছু এমনি এমনিতেই দিয়ে থাকেন। কেন সারা দিন সূর্যের আলো কে দেয় ? বাতাস কে দেয় ? অক্সিজেন কে দেয় ? রুযী কে দেন ? এ সবের কি তিনি কোন বিনিময় নেন ? কোন শর্তও কি আরোপ করেন ? তা সত্যেও যদি কোন বান্দা মহান আল্লাহর দাসত্ব না করে, তাহলে সে অবশ্যই একজন অহংকারী বান্দা এবং অত্যাচারী বান্দা।
আল্লাহর দাসত্ব স্বীকারঃ
জগতের শ্রেষ্ঠ আব্দ বা বান্দা হলেন শেষ নবী মুহাম্মদ (সাঃ)। তিনি আল্লাহর দাসত্ব স্বীকারে কতখানি খাঁটি ছিলেন এবং নিজেকে আল্লাহর দাস বলতে তাঁকে কত পছন্দ লাগতো, তার স্বীকারোক্তি নিম্মে দেখা যেতে পারে। তিনি (সাঃ) বলেন ঃ

” لا تُطْروني كما أطرتِ النصارى ابنَ مريمَ ، فإنما أنا عبدهُ فقولوا : عبد الله و رسوله ” ( البخاري/৩৪৪৫ )

তোমরা আমার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করো না যেমন খৃষ্টানেরা মারইয়ামের পূত্রের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে। আমি তো কেবল তাঁর আব্দ (দাস) তাই তোমরা আমাকে বলঃ আল্লাহর দাস এবং তাঁর রাসূল। [ বুখারী, অধ্যায়, আম্বীয়া, অনুচ্ছেদ নং ৪৮, হাদীস নং ৩৪৪৫]
অনুরূপ প্রচুর দুআ’তে তিনি (সাঃ) নিজেকে আল্লাহর বান্দা হিসাবে আখ্যায়িত কেেছন। যেমন  অযুর দুআ’য় উল্লেখ হয়েছে।

” أشْهَدُ أنْ لا إله إلا الله وحدَه لا شريك له و أشْهَدُ أنَّ محمداً عبدُهُ وَ رسولهُ “

অর্থঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোন মাবূদ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল। [ মুসলিম, অধ্যায়, পবিত্রতা অর্জন, অনুচ্ছেদ, অযু শেষে মুস্তাহাব যিক্র।]
প্রতি নামাযের তাশাহ্ হুদেও তাই বলা হয়েছে, ‘… আশ্ হাদু আল্লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশ্হাদু আন্না মুহাম্মাদান্ আবদুহু ওয়া রাসূলুহু’। অর্থ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই এবং এও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। [বুখারী, নং৮৩১]
বর্ণিত হাদীস সমূহে যেমন নবী (সাঃ) নিজেকে আল্লাহর দাস হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন, তেমন সেই বিশ্বাসেরও অপনদন হয়েছে যারা মনে করে যে, নবী (সাঃ) এর শানে আল্লাহর দাস বলা বেআদবী কিংবা যারা মনে করে যে, নবী (সাঃ) আল্লাহর দাস তো নয়ই বরং তিনি ছিলেন আল্লাহর নূর দ্বারা সৃষ্টি।
আল্লাহর দাসত্বের স্বাদঃ
অন্য দিকে তিনি (সাঃ) আল্লাহর দাসত্ব তথা বন্দেগী কত নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন এবং তা পালন করতে তাঁকে কত মজা লাগতো, তা নিম্মের হাদীস দ্বারা উপলব্ধি করা যেতে পারে।
عن عائشة رضي الله عنها ” أنَّ نبي اللهِ صلى الله عليه و سلم كان يقوم من الليل حتى تتفطر قدماه ، فقالت عائشة: لِمَ تصنع هذا يا رسول الله و قد غفر الله لك ما تقدم من ذنبك و ما تأخر ؟ قال: أفلا أحبُّ أنْ أكونَ عبداً شكوراً. فلما كثُر لحمه صلى جالساً ، فإذا أراد أن يركع قام فقرأ ثم ركعَ ” ( رواه البخاري/৪৮৩৭

আয়েশা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, নবী (সাঃ) রাতে কিয়াম করতেন (দীর্ঘক্ষণ ধরে নামায পড়তেন) যার কারণে তাঁর দুই পা ফুলে যেত। আয়েশা (রাযিঃ) নবীজীকে বললেনঃ এরূপ কেন করছেন আল্লাহর রাসূল; অথচ আল্লাহ আপনার আগের ও পরের গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন? নবী (সাঃ) উত্তরে বললেনঃ আমি  তাঁর কৃতজ্ঞ প্রকাশকারী বান্দা হতে পছন্দ করবো না কি? [ বুখারী, অধ্যায়, তফসীর, নং৪৮৩৭]
আল্লাহর দাস হওয়া বিরাট মর্যদার বিষয়ঃ
মহান আল্লাহ সারা জগতের সৃষ্টিকর্তা। সৃষ্টিকুলের মধ্যে ফেরেশ্তাগণ তাঁর সম্মানীয় সৃষ্টি। তিনি তাদের জ্যেতি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের ‘আব্দ’ বা দাস বলেছেন। আল্লাহ বলেন ঃ ( তারা তো তাঁর সম্মানিত বান্দা, তারা আল্লাহর আগে বেড়ে কথা বলে না; তারা তো তাঁর আদেশ অনুসারেই কাজ করে থাকে।) [ আন্বিয়া/২৬-২৭]
মহান আল্লাহ যাদের স্বয়ং প্রশংসা করেন, যাদের সম্মানিত বান্দা বলেন, যারা সরাসরি আল্লাহর আদেশ পান, আর তাদের যদি আল্লাহ তাআ’লা বান্দা বলে সম্বোধন করেন, তাহলে মানবকুলের জন্য সেই সম্বোধন বা সেই উপাধি সম্মানের পাত্র নয় কি?
আল্লাহর ‘আব্দ’ আখ্যা পাওয়া যে কত মর্যাদার বিষয় আমরা তা তাঁর শ্রেষ্ঠ ও শেষ নবীর সেই ঘটনার মাধ্যমে অবগত হতে পারি। যেই ঘটনাটি ছিল নবীজী (সাঃ) এর জন্য বিরাট সম্মানের ঘটনা। যেখানে আল্লাহ স্বয়ং তাঁর প্রিয় নবীকে নিজের কাছে ডেকে নেন। জান্নাত ও জাহান্নাম দেখান। পাঁচ ওয়াক্ত নামায প্রদান করেন ইত্যাদি। সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তে আল্লাহ তাআ’লা তাঁকে আব্দ বা বান্দা বলে সম্বোধন করেন। আল্লাহ তাআ’লা বলেন ঃ
(سُبْحانَ الذيْ أسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِنَ المَسْجِدِ الحَرامِ إلى المَسْجِدِ الأقْصَا الذي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ أيَاتِنَا إنه هو السميعُ البَصِيْر )

অর্থ ঃ ( পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে [রাসূল (সাঃ) কে] রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসায়, (বায়তুল্ মাক্ দিস) যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্যে; তিনিই সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।) [ ইস্ রা/১]
এই মর্যাদাপূর্ণ ঘটনাতেই -যা ইস্রা এবং মিরাজ নামে প্রসিদ্ধ- উল্লেখ হয়েছে, যখন নবী (সাঃ) সপ্ত আকাশ পেরিয়ে ‘সিদ্রাতুল্ মুন্ তাহায়’ পৌঁছালেন, তখন তিনি (সাঃ) আল্লাহর খুবই কাছাকাছি হলেন এবং তাকে অহী করা হল। সেই সৌভাগ্যপূর্ণ মুহুর্তেও আল্লাহ তাআ’লা নবী (সাঃ) কে ‘আব্দ’ বলে সম্বোধন করেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআ’লার বাণী এইরূপঃ
( ثُمَّ دَنَا فَتَدلّى ، فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أوْ أدْنَى ، فَأوْحَى إلى عَبْدِهِ مَآ أوْحَى ) النجم/৮-১০
অর্থঃ ( অতঃপর সে তার (রাসূল [সাঃ]) এর নিকটবর্তী হলো, অতি নিকটবর্তী। ফলে তাদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইলো অথবা ওরও কম। তখন আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি যা অহী করার তা অহী কললেন। ) [ নাজম/ ৮-১০]
অন্যস্থানে মহান আল্লাহ সমস্ত নবীগণকেই (আলায়হিমুস্ সালাম) আব্দ বলে সম্বোধন করেন। যেমন তিনি বলেনঃ

( وَ لقدْ سَبَقَتْ كَلِمَتُنَا لِعِبَادِنَا المرْسَلِيْنَ ، إنهم لَهُمُ المَنْصورُونَ ) الصافات/১৭১-১৭২

অর্থঃ ( আমার প্রেরিত বান্দাদের সম্পর্কে আমার এই বাক্য পূর্বেই স্থির হয়েছে যে, অবশ্যই তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। ) [ সাফ্ফাত/১৭১-১৭২]
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নবী (সাঃ) বলেনঃ

” أحبُّ أسمائكم إلى اللهِ عبد الله و عبد الرحمان ” رواه مسلم
‘‘ আল্লাহর নিকট তোমাদের নাম সমূহের মধ্যে অধিকতর পছন্দনীয় নাম হচ্ছে, আব্দুল্লাহ এবং আব্দুর রাহ্মান’’। [ মুসলিম, নং২১৩২ ]
বেশি পছন্দনীয়তার ব্যাখ্যায় ইসলামি পন্ডিতগণ বলেছেনঃ কারণ এই নামদ্বয়ে আল্লাহর দিকে বান্দার দাসত্বের সম্বন্ধ রয়েছে এবং বান্দার মানানসই বিশেষণের স্বীকৃতি রয়েছে। [ ফাত্হুল বারী,১০/৬৯৯]
আসলে আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক হচ্ছে, খাঁটি দাসত্বের সম্পর্ক। আর মহান আল্লাহর সম্পর্ক বান্দাদের সাথে হচ্ছে, পূর্ণ আশীষ ও অনুগ্রহের সম্পর্ক। কারণ বান্দা তাঁর দয়ায় অস্তিত্ব লাভ করেছে, তাঁর অনুকম্পায় ধরাধামে জীবনযাপন করছে এবং তাঁর রহমতেই আখেরাতে নাজাত পাবে।
একটি সংশয়ের নিরসনঃ
এর পরেও অনেকের মনে হয়তঃ একটি প্রশ্ন থাকতে পারে যে, দাস বা দাসত্ব কিভাবে সম্মানীয় হতে পারে? এর উত্তরে আশা করি একটি জাগতিক উদাহরণ পেশ করা সঙ্গত হবে। পৃথিবীতে যদি মানুষ কোন রাজা বা উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিত্বের সেবা করা অসম্মান মনে না করে; বরং সম্মান ও গর্ব মনে করে, তাহলে পূর্ণ রাজত্বের অধিকারী রাজাধিরাজ, মহা শক্তিশালী, মহা প্রতাপশালী, সৃষ্টিকুলের পর্যবেক্ষক ও রক্ষক, অতি দয়ালু ও দয়াবান মহান আল্লাহর দাসত্ব করা, সম্মানীয় হবে না কেন? গৌরবের বিষয় হবে না কেন?
মহান রাব্বুল্ আলামীনের নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের তাঁর সৎ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করেন, খাঁটি ভাবে তাঁর দাসত্ব করার তাওফীক দেন। কারণ তিনি এই মহা উদ্দেশ্যেই আমাদের সৃষ্টি করেছেন। ( আমি জ্বিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করিনি কিন্তু এই উদ্দেশ্যে যে তারা সকলে কেবল আমার ইবাদত করবে। আমি তাদের নিকট হতে জীবিকা চাই না এবং এও চাই না যে তারা আমার আহার্য যোগাবে।) [যারিয়াত/৫৬-৫৭]

Related Post