রমযানের শেষ দশকে কিয়ামের নামাযের ফযীলত

রমযানের শেষ দশকে কিয়ামের নামাযের ফযীলত

রমযানের শেষ দশকে কিয়ামের নামাযের ফযীলত

اَلْحَمْدُ للهِ الَّذِيْ خَصَّنَا بِشَهْرِ رَمَضَانَ وَمَيَّزَهُ بِاللَّيَالِيْ الْعَشْرِ الْآوَاخِرِوَ جَعَلَ أَفْضَلَهَا لَيْلَةَ الْقَدْرِ وَ جَعَلَ رَمَضَانَ مَوْسِمًا لِفِعْلِ الْقُرُبَاتِ وَ الصَّالِحَاتِ وَنَيْلِ الدَّرَجَاتِ وَ الْحَسَنَاتِ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

সম্মানিত পাঠক বন্ধুগণ! দেখতে দেখতে আমরা রমযানের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। অল্প কিছু দিনের মধ্যে পবিত্র রমযান আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিবে। যে কয়টি দিন বাকী রয়েছে আমরা যেন এই দিনগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে তার হক আদায় করতে পারি, সেই চেষ্টা করতে হবে।

 সম্মানিত পাঠক বন্ধুগণ! আজকের বিষয়: রমযানের শেষ দশকে কিয়ামের নামাযের ফযীলত

প্রিয় পাঠক বন্ধুগণ! পবিত্র রমযান মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো, শেষ তৃতিয়াংশ তথা শেষ দশ দিন।

হাদীসগ্রন্থগুলোতে রমযানের শেষ দশকের অনেক ফযীলত ও  বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে।

এবার আমরা শেষ দশকের ফযীলত বিষয়ে কিছু কথা আলোচনা করবো:

(১) এ দশ দিনের মাঝে রয়েছে লাইলাতুল কদর নামের একটি রাত। যা হাজার মাস থেকেও শ্রেষ্ঠ। যে এ রাতে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে ইবাদত-বন্দেগী করবে তার অতীতের পাপগুলো ক্ষমা করে দেয়া হবে। (বুখারী ও মুসলিম)

(২) রাসূলে কারীম (সাঃ) এ রাতে ইবাদত-বন্দেগীতে বেশি সময় ও শ্রম দিতেন, যা অন্য কোন রাতে দেখা যেত না। যেমন মুসলিম শরীফে উম্মুল মুমেনীন আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে এসেছে যে, তিনি এ রাতে কুরআন তিলাওয়াত,জিকির,সালাত ও দোয়ার মাধ্যমে জাগ্রত থাকতেন,এরপর সেহরি গ্রহণ করতেন।

(৩) রমযানের শেষ দশক, আসলে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) পরনের লুঙ্গি শক্ত করে নিতেন। রাত্রি জাগরণ করতেন এবং পরিবারের সকলকে জাগিয়ে দিতেন। যেমন বুখারী ও মুসলিমে আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদিসে এসেছে। তিনি এ দশদিনের রাতে মোটেই নিদ্রা যেতেন না। পরিবারের সকলকে তিনি এ রাতে ইবাদত-বন্দেগী করার জন্য জাগিয়ে দিতেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) লুঙ্গি শক্ত করে নিতেন’ কথাটির অর্থ হল তিনি এ দিনগুলোতে স্ত্রীদের থেকে আলাদা হয়ে যেতেন।

রাত্রিজাগরণ রহমানের বান্দাদের বিশেষ গুণ:

আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করছেন:  وَالَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَقِيَامًا এবং যারা রাত কাটায় তাদের রবের উদ্দেশ্যে সেজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে।

রাত্রিজাগরণকারীদের প্রশংসা মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বহু স্থানে করেছেন: মহান আল্লাহ বলছেন:

تَتَجَافَى جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ -16

‘তাদের পার্শ্বদেহ বিছানা থেকে আলাদা থাকে। তারা তাদের প্রভুকে ডাকে ভয়ে ও আশায় এবং আমি তাদেরকে যে রিযক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে।’ (১৬ : সিজদা)

মহান আল্লাহ আরো বলছেন

أَمْ مَنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَقَائِمًا يَحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ (سورة الزمر : 9)

‘যে ব্যক্তি রাতের বেলা সিজদার মাধ্যমে অথবা দাঁড়িয়ে ইবাদত করে, পরকালকে ভয় করে এবং তার রবের রহমত প্রত্যাশা করে (সে কি তার সমান যে এরূপ করে না)।’ (৯: যুমার)

রত্রিজাগরণ বিষয়ে হাদীস হতে বর্ণনা:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিত রাত্রে জাগতেন ও নামায আদায় করতেন। এ প্রসঙ্গে আয়শা রা. বলেছেন :

كان النبي صلى الله عليه و سلم يقوم من الليل حتى تتفطر قدماه، فقلت له لم تصنع هذا يا رسول الله؟ وقد غفرلك ما تقدم من ذنبك وما تأخر، قال: أفلا أكون عبدا شكورا. (متفق عليه)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের বেলায় নামাযে (এত দীর্ঘ সময়) দাঁড়িয়ে থাকতেন যে, তার পা দু`টো  যেন ফেটে যেত। আমি তাকে বললাম,হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এমনটি করছেন কেন? অথচ আপনার পূর্ব ও পরের সব গুনাহ মাফ হয়ে গিয়েছে। রাসূল (সা.) বললেন,`আমি কি (আল্লাহর) কৃতজ্ঞ বান্দাহ হব না?’ (বুখারী ও মুসলিম)

রাতের নামাযের তথা কিয়ামুল লাইলের ফযীলত সম্পর্কে অনেক হাদীস আছে। এখানে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হলো :

ফরয নামাযের পর রাতের নামাযই উত্তম:

عن أبى هريرة رضي الله عنه  قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم:  أفضل الصيام بعد رمضان شهر الله المحرم، وأفضل الصلاة بعد الفريضة صلاة الليل. (رواه مسلم)

আবু হোরাইরা রা. থেকে বর্ণিত,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘রমযানের পর সর্বোত্তম রোযা আল্লাহর মাস মহররমে রোযা ও ফরজ নামাযের পর সর্বোত্তম নামায রাতের নামায।’ (মুসলিম)

রাতের নামায জান্নাতে প্রবেশের কারণ হবে:

عن عبد الله بن سلام  رضي الله عنه  أن النبي صلى الله عليه و سلم قال : أَفْشُوا السَّلَامَ ،  وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ،  وَصِلُوا الأَرْحَامَ ، وَصَلُّوا بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ ، تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ بِسَلامٍ. (رواه الترمذي)

আবদুল্লাহ ইবন সালাম থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘হে লোকসকল! তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও, গরীব দুঃখীদের খাবারের ব্যবস্থা করো। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা কর এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামায পড়। (এগুলো করে) তোমরা নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ কর।’ (তিরমিযী)

রাতের নামায আদায়কারী স্বামী-স্ত্রীর উপর আল্লাহ রহম করেন:

عن أبى هريرة  رضي الله عنه  قال: قال رسول الله صلى الله عليه و سلم: رَحِمَ اللهُ رَجُلاً قَامَ مِنَ اللَّيْلِ فَصَلَّى ثُمَّ أَيْقَظَ امْرَأَتَهُ فَصَلَّتْ فَإِنْ أَبَتْ نَضَحَ فِي وَجْهِهَا الْمَاءَ وَرَحِمَ اللهُ امْرَأَةً قَامَتْ مِنَ اللَّيْلِ فَصَلَّتْ ثُمَّ أَيْقَظَتْ زَوْجَهَا فَصَلَّى فَإِنْ أَبَى نَضَحَتْ فِي وَجْهِهِ الْمَاءَ (رواه أبوداود)

আবু হোরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘আল্লাহ করুণা করুন ঐ ব্যক্তির উপর, যে রাতে উঠে নামায পড়ে এবং তার স্ত্রীকে জাগিয়ে দেয়। স্ত্রী যদি উঠতে না চায় তাহলে তার মুখমণ্ডলে পানি ছিটিয়ে দেয়। আল্লাহ করুণা করুন ঐ নারীর প্রতি, যে রাতে উঠে নামায পড়ে এবং তার স্বামীকে জাগিয়ে দেয়। স্বামী যদি উঠতে না চায় তাহলে তার মুখমণ্ডলে পানি ছিটিয়ে দেয়।’ (আবু দাউদ)

কদর রজনীতের ইবাদত করলে বিগত জীবনের গুনাহ মাফ করা হয়:

রাসূলে কারীম (সাঃ) বলেছেন :

مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ

যে লাইলাতুল কদরে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে সালাত আদায় ও ইবাদত-বন্দেগী করবে তার অতীতের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। ( বুখারি ও মুসলিম)

লাইলাতুল কদর কখন ?

আল-কুরআনে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি লাইলাতুল কদর কোন রাতে। তবে কুরআনের ভাষ্য হল লাইলাতুল কদর রমযান মাসে। কিয়ামত পর্যন্ত রমযান মাসে লাইলাতুল কদর অব্যাহত থাকবে। এবং এ রজনি রমযানের শেষ দশকে হবে বলে সহীহ হাদীসে এসেছে। আর তা রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে হাদিসে এসেছে-

عن عائشةَ رضِيَ اللهُ عنها أنَّ رسولَ الله صلَّى الله عليه وسلَّمَ قال: تَحرُّوا لَيلةَ القَدْرِ في الوَتْر من العَشرِ الأواخِرِ من رمضانَ  رواه البخاريُّ (2017)

‘তোমরা রমযানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ কর।’(বর্ণনায়: বুখারী)

এবং রমযানের শেষ সাত দিনে লাইলাতুল কদর থাকার সম্ভাবনা অধিকতর। যেমন হাদিসে এসেছে-

((الْتَمِسوها في السَبع الأواخِرِ)) رواه البخاريُّ (6991) واللَّفظ له، ومسلم (1165

‘যে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করতে চায় সে যেন শেষ সাত দিনে অন্বেষণ করে। (বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)

অধিকতর সম্ভাবনার দিক দিয়ে

প্রথম হল: রমযান মাসের সাতাশ তারিখ।

দ্বিতীয় হল: পঁচিশ তারিখ।

তৃতীয় হল: ঊন ত্রিশ তারিখ।

চতুর্থ হল: একুশ তারিখ।

পঞ্চম হল: তেইশ তারিখ।

এ রাতকে গোপন রাখার কারণ

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ রাতকে গোপন রেখেছেন আমাদের উপর রহম করে। তিনি দেখতে চান এর বরকত ও ফযীলত লাভের জন্য কে কত প্রচেষ্টা চালাতে পারে।

কদর রজনীতের আমরা কি করবো?

  • এ রাতে বেশি বেশি করে দোয়া করা: আয়েশা (রাঃ) নবী করিম (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, লাইলাতুল কদরে আমি কি দোয়া করতে পারি? তিনি বললেন, বলবে—

 اللهم إنك عفو تحب العفو فاعف عني

‘হে আল্লাহ ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালোবাসেন, অতএব আমাকে ক্ষমা করুন। (বর্ণনায় : তিরমিজি)

শেষ দশকের রাতগুলোর জাগার উদ্দেশ্য লাইতুল কদরের সন্ধান করা। আর আল্লাহ তা’আলার অশেষ অনুগ্রহ যে তিনি লাইতুল কদরকে রমযানের শেষ দশকে লুকিয়ে রেখেছেন। যদি সারা বছরের যে কোনো রাতে তা সুপ্ত রাখা হত তাহলে এর সন্ধান পাওয়া অনেক দুষ্কর হত এবং অধিকাংশের ভাগ্যেই লাইলাতুল কদর জুটত না।

মহান আল্লাহর কাছে এই প্রত্যাশা রেখে আজকের আলোচনা শেষ করছি, আল্লাহ যেন আমাদের সকলকে এই মহিমান্বিত রাতের ফযীলত লাভে ধন্য করেন। আমীন।

Related Post