সমাজ গঠনে নবীর আদর্শ

5

সমাজ ও সংঘবদ্ধ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়ার কারণেই অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষ ভিন্ন প্রকৃতির। সামাজিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে ভূষিত করেছে। এজন্য সামাজিকতা শেখা এবং সে অনুযায়ী চলাও প্রত্যেকের জন্য অপরিহার্য। কারণ সমাজই আমাদের জীবনের প্রথম বিচরণক্ষেত্র। সমাজ সংগঠনের মাধ্যমেই জীবনের প্রকৃত বিকাশ। ব্যক্তির সামাজিক সম্পর্ক ও আচরণ যত উন্নত হবে, সামাজিক মর্যাদাও তত বেশি বিকশিত হবে। এজন্য ইসলাম মানুষকে সমাজবদ্ধ জীবনযাপনে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত শিখিয়েছে।
ইসলামের নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) একজন মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আদর্শের বাতিঘর। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে নিয়ে তার সামাজিকতা ও পারস্পরিক আচরণ কেমন হবে, সবই শিক্ষা দিয়েছেন তিনি। সীরাতুন্নবী (সা.)-এর পরতে পরতে রয়েছে মানুষের চলার পাথেয়। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহর রাসূলের মধ্যেই রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। নবীজির (সা.) গোটা জীবনটাই ছিল উত্তম আদর্শের প্রতীক। সামাজিক সম্পর্ক উন্নততর এবং সমাজজীবনে অপার শান্তি ও কল্যাণ চাইলে তার আদর্শের কাছেই বারবার ফিরে যেতে হবে।
ব্যক্তিগত সংশোধন ও পরিশুদ্ধির প্রতি রাসূল (সা.) সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন। মূলত ব্যক্তিচরিত্রই সমাজকল্যাণের প্রথম সোপান। মানবচরিত্র সুষ্ঠু ও সত্যনিষ্ঠভাবে বিকশিত করতে হলে ব্যক্তিগত পরিশুদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। এজন্য রাসূল (সা.) নিজ হাতে কিছু মানুষ গঠন করেছিলেন। তার হাতে গড়া মানুষেরাই এযাবত্কালের সেরা। রাসূলের হাতেগড়া সাহাবায়ে কেরামের মতো সেরা মানুষ পৃথিবীতে আসেনি, আর কখনও আসবেও না। সংখ্যায় কম হয়েও আদর্শের বলে তারা গোটা বিশ্ব জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাসূল (সা.) তাদের বাস্তব শিক্ষা ও অনুশীলনের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন মনের মতো করে। একজন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের করণীয় এবং তার প্রতিটি মুহূর্ত কীভাবে কাটাবে এর সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল রাসূলের শিক্ষায়। হযরত সালমান ফারসি (রা.) গর্ব করে বলেছেন, ‘আমরা এমন এক নবীর সান্নিধ্য পেয়েছি, যিনি আমাদের হাতে-কলমে সবকিছু শিখিয়েছেন। এমনকি আমরা কীভাবে প্রাকৃতিক প্রয়োজনাদি সম্পন্ন করব সে শিক্ষাও তিনি আমাদের দিয়েছেন।’

মূলত রাসূল (সা.) ছিলেন সামাজিক আন্দোলনের সিপাহসালার। তার বিদ্যা ও বোধশক্তি ছিল একজন শ্রেষ্ঠ সমাজপতির মতো। তিনি মানুষকে, জীবনকে, সমাজ ও দেশকে বদলে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করেছেন। সমাজের মানুষকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা এবং সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার জন্য নিরলসভাবে শ্রম দিয়েছেন। তিনি তার জাতিকে সামাজিক ন্যায়-নীতি, আদর্শ ও নীতিবোধে বলীয়ান করে তুলতে অব্যাহত সংগ্রাম চালিয়েছেন। সমাজে শান্তি ও সুশৃঙ্খল পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে আচার-ব্যবহারে ভদ্রতা, নম্রতা, শিষ্টাচারিতা ও নমনীয়তা দেখানোর শিক্ষা রাসূল (সা.) দিয়েছেন। মানুষের সঙ্গে ভদ্রোচিত আচরণ করা, কারও সঙ্গে অবজ্ঞা বা বিদ্রূপ না করার শিক্ষাও পাই তার আদর্শে। কারও মান-সম্মানের খেয়ানত না করতে তিনি কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। মাপে কম দেয়া, ঠকানো, জালিয়াতি, মিথ্যাচার, কুত্সা,নেতিবাচক এসব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখতে সদাচার, নম্র ব্যবহার, সম্মান প্রদর্শন, পরনিন্দা পরিহার, সালাম, মোসাফাহা, সেবা ও সৎ পরামর্শ এবং পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা, মহানুভবতা ইত্যাদি সৎগুণের প্রতি বারবার উদ্বুদ্ধ করেছেন। মহানবী (সা.) ছিলেন সামাজিক জাগরণের অগ্রপথিক। তার প্রতিটি কথাই ছিল সামাজিক ঐক্য, শৃঙ্খলা, উন্নয়ন এবং অগ্রগতির। এজন্য তিনি অধঃপতনের বেলাভূমে থাকা আরব সমাজকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।

একটি সমাজব্যবস্থার উত্তরণ এবং বিকাশে আদর্শিক যে প্রেরণা দরকার, এর সবই আছে সীরাতুন্নবীতে। নবী জীবনের বাঁকে বাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় অবলম্বনযোগ্য নানা পাথেয়। সমাজবিজ্ঞানীরা এ কথা স্বীকার করেছেন, মহানবী (সা.)-এর মতো সমাজ নির্মাতা ও সমাজের আদর্শ কারিগর পৃথিবীতে দ্বিতীয় কেউ আসেননি। যত জনপ্রিয় নেতা ও আদর্শ মানবই হোন,শতভাগ পরিচ্ছন্নতার ছাপ রাখা সম্ভব হয় না। কিন্তু আদর্শের আলোকবর্তিকা মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তার প্রতিটি কথা ও কাজ অনুসরণযোগ্য,জীবনের প্রতিটি প্রান্তর স্বচ্ছতা ও নিষ্কলুষতার বারিধারায় পরিশুদ্ধ। তাকে যারা আদর্শের মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করেছেন তারা শতভাগ সফল। তার আদর্শের ধারক-বাহকেরাই পৃথিবীবাসীকে দিয়েছেন শ্রেষ্ঠ সমাজব্যবস্থা। নববী আদর্শের আদলে সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠলে আজও অস্থিরতা ও অশান্তির অবসান ঘটবে। দুনিয়া ফিরে পাবে সেই জান্নাতি আবহ,শান্তিময় সমাজের সন্ধান।

Related Post