Originally posted 2013-05-30 07:39:30.
আল্লাহ তা’আলা অনুগ্রহ করে তাঁর বান্দাদের জন্যে বছরের মধ্যে কোন কোন মাসকে সম্মানিত ও মর্যাদাবান করেছেন। আল্লাহ তা’আলার কাছে বারটি মাসের মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত ও মর্যাদাশীল। সেই মর্যাদাশীল মাসসমূহে বান্দা নেক আমল করলে তাঁর মর্যাদা ও সম্মান আল্লাহ তা’আলার নিকট আরো বৃদ্ধি পায়। আর শা’বান মাসও মর্যাদাপূর্ণ একটি মাস। শা’বান হিজরী সালের অষ্টম মাসের নাম। শাবান শব্দটি আরবী, অর্থ হচ্ছে শাখা-প্রশাখা বের হওয়া। যেহেতু এ মাস প্রচুর কল্যাণ ও নেকির মাস সেহেতু এর নামকরণ হয়েছে শাবান। এই নামকরণের কতিপয় কারণ পাওয়া যায়। যথা-
(১) এ মাসে আরবরা দলবদ্ধ হয়ে পানির অনুসন্ধানে ছড়িয়ে পড়ত।
(২) যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য দলবদ্ধ হত। শাবান মাস মূলত; মাহে রমযানের প্রস্তুতির মাস। যাকে বলা হয়, মাহে রমযানের আগমনীবার্তা। কেননা শাবান মাস মুসলমানদের কাছে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মহিমান্বিত রমযান মাসের সওগাত নিয়ে আসে।
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত,তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা’বান মাসে এতো বেশি পরিমাণে রোযা পালন করতেন যে,আমাদের মনে হত, তিনি আর রোযা ত্যাগ করবেন না। আবার যখন রোযা ত্যাগ করতেন, আমাদের মনে হত, এবার আর রোযা পালন করবেন না। এবং আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমযান মাস ছাড়া অন্য কোন মাসে পরিপূর্ণ রোযা পালন করতে দেখিনি; এবং শা‘বান মাসের মত এতো বেশি পরিমাণে রোযা অন্য কোন মাসে পালন করতে দেখিনি। (বুখারী ও মুসলিম)
শা‘বান মাসে রোযা পালন (আসহুরুল হুরুম) নিষিদ্ধ পবিত্র মাস চেয়েও শ্রেষ্ঠ এবং উত্তম নফল হল রমযান মাসের নিকটবর্তী দিবসের রোযা। আগে হোক কিংবা পরে। ফরয রোযার তুলনায় এ সকল রোযার স্থান ফরজ নামাযের আগে-পরে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহর অনুরূপ। এগুলো ফরযসমূহের অসম্পূর্ণতাকে পরিপূর্ণতা দান করে। রমযানের আগে-পরে নফল রোযার কাজও তাই। সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ যেমন অন্যান্য সাধারণ নফল হতে শ্রেষ্ঠ তেমনিভাবে রমযান মাসের আগে-পরের রোযা অন্য সময়ের নফল রোযা হতে শ্রেষ্ঠ। এ মাসের ফযীলতকে মানুষ উপেক্ষা করে, মাসটি রজব ও রমযানের মধ্যবর্তী মাস হওয়ার ফলে এর মাধ্যমে মূলত বুঝানো হচ্ছে, শাবান মাসকে যেহেতু দুটি সম্মানিত মাস বেষ্টন করেছে, সে জন্য মানুষ ঐ দুই মাসের আমলে ব্যস্ত হয়ে শাবান মাসকে অবহেলা করে। পক্ষান্তরে, অনেক মানুষ মনে করে, শাবান মাসের রোযার তুলনায় রজব মাসের রোযার মর্যাদা অধিক। কারণ, রজব হচ্ছে নিষিদ্ধমাস। প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি এমন নয়।
হযরত উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) হতে বর্ণিত,তিনি বলেন: আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম,হে আল্লাহর রাসূল! শা’বান মাসে আপনি অধিকহারে রোযা পালন করেন;অন্য কোন মাসে তো এরূপ দেখিনি! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন: শা’বান, রজব ও রমযানের মধ্যবর্তী মাস,এ মাসের ফযীলতকে মানুষ উপেক্ষা করে। এই মাসে বিশ্ব প্রতিপালকের কাছে আমল পেশ করা হয়। আর আমি পছন্দ করি যে, রোযা পালনাবস্থায় আমার আমল পেশ করা হোক। (নাসায়ী ও আহমদ)
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: শা’বান মাসে রোযা রাখা এবং রমযানের সাথে মিলিয়ে নেয়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। (আবু দাউদ ও আহমদ)
আর শা’বানের পরই রমযান মাসের আগমন, রমযান হলো তাক্বওয়া অর্জনের মাস, কুরআন নাযিলের মাস, এই মাসেই মুসলমানদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন ইরশাদ করেন:- হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে,যেরূপ ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার। (সূরা বাকারাহ-১৮৩)
শা’বান মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিক পরিমাণ রোযা পালনের কারণ সম্পর্কে বিদ্বানদের বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়।
(১) সফর ও অন্যান্য ব্যস্ততায় প্রতি মাসের তিনটি নফল রোযা পালনে বিঘ্নসৃষ্টি হত। তাই ঐ সব রোযা শা’বান মাসে কাযা করতেন। নবী কারীম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন নফল শুরু করলে তা পূর্ণ করতেন। কোন কারণে ছুটে গেলে পরে কাযা করতেন।
(২) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ রমযানের রোযা শা’বানে কাযা করতেন। এ জন্য তিনিও তাদের সাথে নফল রোযা পালন করতেন। এরূপ একটি বর্ণনা আয়েশা (রাঃ) থেকে পাওয়া যায়, তিনি বলেন : তিনি রমযানের রোযার কাযা শা’বান মাস পর্যন্ত বিলম্ব করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকায় অন্য সময় তা সম্ভব হয়ে উঠত না।
(৩) সাধারণত মানুষ এ মাসের ফযীলত সম্পর্কে উদাসীন থাকে,তাই তাদের শিক্ষাদানের নিমিত্তে রোযা পালন করতেন। এ মতকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কারণ,এ মতের পক্ষে উসামা বিন যায়েদের পূর্বে উল্লেখিত হাদীসের সমর্থন পাওয়া যায়,যাতে বলা হয়েছে; এটা ঐ মাস যা সম্পর্কে মানুষ উদাসীন থাকে,রজব ও রমযানের মধ্যবর্তী মাস। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন শাবান মাস আসত তখন থেকে যাওয়া নফল রোযাগুলো আদায় করতেন, যাতে রমযান মাস আসার পূর্বেই নফল রোযাগুলো পরিপূর্ণ হয়। যেমনটি তিনি নফল নামায ও কিয়ামুল লাইল কারণ বশতঃ ছুটে গেলে কাযা করতেন। আয়েশা (রাঃ)-এ সুযোগ ব্যবহার করে ঋতুস্রাবের কারণে রমযান মাসের যে সব রোযা বাদ যেত তা কাযা করতেন। অন্য সময় রাসূলের সাথে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকতেন বলে সম্ভব হতো না। অতএব,যাদের উপর অতীত রমযান মাসের রোযা বাকী আছে তার কাযা আদায়ের ব্যাপারে সতর্ক করা,সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এমনিভাবে,শাবানে রোযা রাখা দ্বারা অন্য উপকারও আছে। তাহল, শা‘বানে রোযা পালনের মাধ্যমে রমযান মাসের রোযা পালনের অনুশীলন হয়। এতে রমযান মাসে রোযা পালনে কষ্ট অনুভব হয় না। বরং এর মাধ্যমে রোযা রাখার অনুশীলন ও অভ্যাস সৃষ্টি হয়। ফলে রমযান মাসে রোযা পালনে উৎসাহ ও আনন্দ বৃদ্ধি পায়। শা’বান যেহেতু রমযানের ভূমিকা, তাই রমযানের কতিপয় কাজ এ মাসেও করা যায়; যেমন, রোযা পালন, কুরআন তিলাওয়াত, দান-ছদকা ইত্যাদি।
আসন্ন মাহে রমযানের মূল সিয়াম শুরু করার আগে শাবান মাসে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কিছু নফল রোজা রাখা দরকার। যাতে করে মাহে রমযানের রোজা পালন সহজ হয় এবং লক্ষ্যও ঠিকমতো অর্জিত হয়। তবে শাবান মাসের অর্ধেক পার হয়ে গেলে বেশি রোজা আর না রাখাই ভালো। যাঁরা এ মাসে নফল রোজা রাখতে চান, তাঁদের মধ্যভাগেই শেষ করে ফেলা উচিত। মাহে রমযানের প্রস্তুতিকল্পে শাবান মাসকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : আর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ও সানন্দে কিছু বেশি সৎকাজ করে, তা তার জন্য ভালো। তবে যদি তোমরা সঠিক বিষয় অনুধাবন করে থাকো। তাহলে তোমাদের জন্য রোযা রাখাই ভালো। (সূরা বাকারা-১৮৪)
হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় সাহাবীরা শাবানের চাঁদ দেখে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করতেন। মুসলমানরা তাদের মালের যাকাত বের করে দিতেন যাতে করে গরীব-মিসকিনরা এর দ্বারা রোজা রাখার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেন। বিচারকরা জেলখানা থেকে কয়েদিদের বের করে এনে তাদের মধ্যে যারা দোষী তাদের সাজা দিয়ে অন্যদের ছেড়ে দিতেন। ব্যবসায়ীরা এ মাসে তাদের ঋণ পরিশোধ করে দিতেন এবং অন্যদের কাছে যা পাওনা তা আদায় করে নিতেন। রমযান মাসের চাঁদ দেখা গেলে মানুষ গোসল করে ইতেকাফে বসে যেতেন। মোট কথা, এ মাস থেকেই প্রতিটি মু’মিন-মুসলমানের একান্ত কর্তব্য রমযানের প্রস্তুতি নেয়া। বিশেষ কারণে শাবান মাসের আলাদা মর্যাদা রয়েছে। তাই বলা হয়, রজব মাসে শস্য বপন করা হয়, শাবান মাসে খেতে পানি সিঞ্চন করা হয় এবং রমযান মাসে ফসল কর্তন করা হয়।
শাবান মাসের ফজীলত সম্পর্কে নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন:রজব আল্লাহর মাস,শাবান আমার মাস এবং রমযান আমার উম্মতের মাস। শাবান মাসকে রমযান মাসের প্রস্তুতি ও সোপান মনে করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বিশেষ দোয়া করতেন এবং অন্যদের তা শিক্ষা দিতেন। নবীজির কাছে শাবান মাসের মর্যাদা এতই বেশি যে যখন তিনি এ মাসে উপনীত হতেন, তখন রমযানকে স্বাগত জানানোর উদ্দেশ্যে আল্লাহর কাছে অধিক হারে এই বলে প্রার্থনা করতেন,হে আল্লাহ! আপনি আমাদের রজব ও শাবান মাসের বিশেষ বরকত দান করুন এবং আমাদের রমযান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন। (মুসনাদে আহমাদ) মহানবী (সা.)-এর এ দোয়ার মাধ্যমে সবার কাছে রমযানের প্রস্তুতি ও শাবান মাসের ফজীলত প্রতীয়মান হয়।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন:- তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। তোমরা নিজেদের জন্যে যা কিছু অগ্রে পাঠাবে, তা আল্লাহর কাছে উত্তম আকারে এবং পুরস্কার হিসেবে বর্ধিতরূপে পাবে। তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাশীল, দয়ালূ। (সূরা মুয্যাম্মিল-২০)
পরম করুণাময় আল্লাহর অশেষ দয়া ও ক্ষমার দৃষ্টি লাভের আকাঙ্খায় শা’বান মাসব্যাপী অন্যান্য মাসের তুলনায় অধিক পরিমাণে ইবাদত-বন্দেগী ও তাওবা-ইস্তেগফার করে অতীতের সব গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর আনুগত্য ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুমহান আদর্শ অনুসরণে নিজেদের জীবন পরিচালনার দৃঢ় প্রত্যয় ও শপথ গ্রহণ করা উচিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শানুযায়ী সম্পাদিত আ’মলই সর্বোত্তম আ’মল। নতুন উদ্ভাবিত আমলই সবচেয়ে নিন্দিত। আল্লাহ তা’আলার নিকট প্রার্থনা করি, তিনি আমাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শকে আঁকড়ে ধরে তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার তাওফীক দান করুন। তাওফীক দান করুন তাঁর আদর্শের বিপরীত সব কিছু হতে নিরাপদ থাকার। আমীন ….