শ্রমিকের শ্রম তার শরীরের ঘাম শুকানোর পূর্বেই পরিশোধ করো। অর্থাৎ ‘বিশ্ব শ্রমিক দিবস’ বা মে দিবস। সারা বিশ্বেই মালিক কর্তৃক শ্রমিকগণ প্রতারিত বা নির্যাতিত হন। আজকের খুতবায় ইসলামে শ্রমিকদের সাথে মালিকদের কেমন আচরণ করতে বলা হয়েছে এবং শ্রমিকগণ কিভাবে কাজ করবেন তা এই অল্প পরিসরে তুলে ধরা হবে ইনশা আল্লাহ।
বছর ঘুরে আবার আসছে মে মাস। শ্রমিকের অধিকার আদায় আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত এ মাসের ১ তারিখ সারা বিশ্বে পালিত হয় ‘বিশ্ব শ্রমিক দিবস’ (International Workers Day) হিসাবে। এ দিবসটি আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার এবং মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক, দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা।
মে দিবসের ইতিহাস: ১৮৮৬ সালের ১লা মে আমেরিকার মেহনতী শ্রমিকশ্রেণী দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবীসহ আরো কয়েকটি ন্যায্য দাবী ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জীবন বিসর্জন দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা করেছিল। ১লা মে’র ঐ ধর্মঘট দিবসের আগে যুক্তরাষ্ট্র বা বিশ্বের কোথাও শ্রম আইন ছিল না। শ্রমিকদের মানবিক ও অর্থনৈতিক অধিকার বলতেও কিছু ছিল না। তারা ছিল মালিকদের দাস মাত্র। তাদের কাজের কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা ছিল না। ছিল না সাপ্তাহিক কোন ছুটি। ছিল না চাকুরীর স্থায়িত্ব ও ন্যায়সঙ্গত মজুরীর নিশ্চয়তা। মালিকরা তাদের ইচ্ছামত শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিত। এমনকি দৈনিক ১৮-২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতেও বাধ্য করত শ্রমিকদের। এ অন্যায়, বঞ্চনা ও যুলুমের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা পর্যায়ক্রমে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এ আন্দোলনের অংশ হিসাবে ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার’-এর ১৮৮৫ সালের সম্মেলনের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবীতে ১৮৮৬ সালের ১লা মে আমেরিকা ও কানাডার প্রায় তিন লক্ষাধিক শ্রমিক শিকাগোর ‘হে মার্কেটে’ ঢালাই শ্রমিক, তরুণ নেতা এইচ সিলভিসের নেতৃত্বে এক বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে সর্বপ্রথম সর্বাত্মক শ্রমিক ধর্মঘট পালন করে। শ্রমিকদের সমাবেশ চলাকালে মালিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী পুলিশ ও কতিপয় ভাড়াটিয়া গুণ্ডা সম্পূর্ণ বিনা উস্কানিতে অতর্কিতভাবে গুলী চালিয়ে ৬ জন শ্রমিককে নৃশংসভাবে হত্যা ও শতাধিক শ্রমিককে আহত করে। কিন্তু এতেও শ্রমিকরা দমে যায়নি। শ্রমিকদের ইস্পাতকঠিন ঐ সফল ধর্মঘটের কারণে কোন কোন মালিক ৮ ঘণ্টা কর্ম সময়ের দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয়। ফলে শ্রমিকরা আরো উৎসাহী ও আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠে এবং সর্বস্তরে ৮ ঘণ্টা কর্ম সময়ের দাবী প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২রা মে রবিবারের সাপ্তাহিক বন্ধের দিনের পর ৩ তারিখেও ধর্মঘট অব্যাহত রাখে। ঐ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আয়োজিত ৪ঠা মে শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেটের বিশাল শ্রমিক সমাবেশে আবারো মালিকগোষ্ঠীর গুণ্ডা ও পুলিশ বাহিনী বেপরোয়াভাবে গুলী বর্ষণ করে। এতে ৪ জন শ্রমিক নিহত ও বিপুল সংখ্যক আহত হয়। রক্তে রঞ্জিত হয় ‘হে’ মার্কেট চত্বর। গ্রেফতার করা হয় শ্রমিক নেতা স্পাইজ ও ফিলডেনকে। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে রীতিমত ‘চিরুনী অভিযান’ চালিয়ে শিকাগো শহর ও এর আশপাশের এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী ফিশার, লুইস, জর্জ এঞ্জেল, মাইকেল স্কোয়ার ও নীবেসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ শ্রমিক নেতাকে। পরবর্তীতে শ্রমিকদের এই ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের বিরোধিতাকারী মালিকপক্ষের ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘জুরি’ গঠন করে ১৮৮৬ সালের ২১ জুন শুরু করা হয় বিচারের নামে প্রহসন। একতরফা বিচারের মাধ্যমে ১৮৮৬ সালের ৯ অক্টোবর ঘোষিত হয় বিচারের রায়। রায়ে বিশ্বজনমতকে উপেক্ষা করে শ্রমিক নেতা পার্সন্স, ফিলডেন, স্পাইজ, লুইস, স্কোয়ার, এঞ্জেল ও ফিশারের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ প্রদান করা হয় এবং ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর সে আদেশ কার্যকর করা হয়। শ্রমিক নেতা ও কর্মী হত্যার এ দিবসটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে প্রতিবছর ১লা মে ‘শ্রমিক হত্যা দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস’ হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দৈনিক ৮ ঘণ্টা কার্য সময় ও সপ্তাহে এক দিন সাধারণ ছুটি প্রদানের ব্যবস্থা করে প্রথম শ্রম আইন প্রণীত হয়। অন্যদিকে নারকীয় এ হত্যাযজ্ঞ গোটা বিশ্বের শ্রমিকদের অধিকারে এনে দেয় নতুন গতি। শিকাগো শহরে সৃষ্ট এ আন্দোলন ক্রমশ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। পৃথিবীর সকল শ্রমজীবী মানুষ এ আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয় ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ শ্লোগানটি। সেই সাথে ১৩১ বছর আগে ঘটে যাওয়া সে ঘটনাটির কথা এখন প্রতিবছর বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্মরণ করা হয়ে থাকে ‘বিশ্ব শ্রমিক দিবস’ বা ‘মে দিবস’ হিসাবে।
ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার: শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ধর্ম ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকারের কথা বিধৃত হয়েছে। শ্রমিকদের প্রতি সুবিচারের নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। ইসলাম শ্রমের প্রতি যেমন মানুষকে উৎসাহিত করেছে: মহান আল্লাহ বলছেন;
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِن فَضْلِ اللهِ وَاذْكُرُوا اللهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ﴿١٠﴾
তারপর যখন নামায শেষ হয়ে যায় তখন তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহ্র করুণাভান্ডার থেকে অণ্বেষণ করো, আর আল্লাহ্কে প্রচুরভাবে স্মরণ করো, যাতে তোমাদের সফলতা প্রদান করা হয়। (সূরা জুমু‘আহ ১০) এই আয়াত হতে বুঝা যায় যে, ইসলামে শ্রমের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ নামায শেষ করেই কাজের প্রতি ঝাপিয়ে পড়তে বলা হয়েছে।
তেমনি শ্রমিকের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পূর্ণ প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (সা.) শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষকে অত্যন্ত সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন। কারণ যারা মানুষের সুখের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজেদেরকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেয়, তারাতো মহান আল্লাহর কাছেও মর্যাদার অধিকারী। শ্রমের মর্যাদা বুঝাতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন,
مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ خَيْرًا مِنْ أَنْ يَّأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ وَإِنَّ نَبِىَّ اللهِ دَاؤُوْدَ ॥ كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ-
‘কারো জন্য স্বহস্তের উপার্জন অপেক্ষা উত্তম আহার্য আর নেই। আর আল্লাহর নবী দাঊদ (আঃ) স্বহস্তে জীবিকা নির্বাহ করতেন’। (বুখারী, মিশকাত হা/২৭৫৯)
শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম বদ্ধপরিকর। আর একজন শ্রমিকের সবচেয়ে বড় অধিকার বা দাবী হল, তার শ্রমের যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভ করা। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন,
أَعْطُوا الْأَجِيْرَ أَجْرَهُ قَبْلَ أَنْ يَّجِفَّ عَرَقُه-
‘তোমরা শ্রমিককে তার শরীরের ঘাম শুকানোর পূর্বেই পারিশ্রমিক দিয়ে দাও’। (ইবনু মাজাহ,মিশকাত হা/২৯৮৭)
এই হাদীস থেকে যা জানা গেলো:
১। শ্রমিকের শ্রম আটকে রাখা বৈধ নয়, কেননা এতে শ্রমিক নিজেসহ পরিবারের লোকদের নিয়ে সমস্যায় ভুগতে হয়, তারা খানা-পিনা, পোশাক পরিচ্ছদ বাচ্চাদের লেখা-পড়া চিকিৎসা ইত্যাদি এই শ্রমের উপর নির্ভর করে থাকে। তেমনিভাবে অর্পিত কাজের প্রতি তার আগ্রহ থাকে না। সে ভাবতে থাকে যে, কাজ করে লাভ কি আমি তো পারিশ্রমিক পাবো না।
২। যে ব্যক্তি উত্তম বা সুন্দরভাবে কাজ করে, তাকে এর উত্তম প্রতিদান দেওয়া দুনিয়ার নিয়ম। আর কিয়ামতের দিনও আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তি প্রতিদান পাবে।
৩। শ্রমিকের সাথে ন¤্র বা কোমল আচরণ করুন, তাদেরকে কষ্ট দিবেন না। এবং সাধ্যের বাইরে কাজ দিবেন না, কেননা সাধ্যের বাইরে বহন করতে স্বয়ং আল্লাহ নিষেধ করেছেন। لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا
৪। ইসলাম শ্রমিকদেরকে ন্যায্য অধিকার দিয়েছে, সুতরাং মালিকের উচিৎ নয় তার অধিকারকে খর্ব করা। বরং তার উচিৎ শ্রমিকের শ্রম যথা সময় দিয়ে দেওয়া। এবং বিশ্রামের ও ইবাদতের সুযোগ দেওয়া। এবং পরিবারের খুঁজ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া।
৫। প্রত্যেক ব্যক্তির জানা উচিত যে, কিয়ামতের দিন ছোট বড় সব বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে।
৬। শ্রম, শ্রমিকের অধিকার। মালিকের পক্ষ থেকে কোন করূণা নয়।
৭। মালিকের উচিৎ সকল শ্রমিকদের এক নজরে দেখা। শ্রমিকগণ প্রজার ন্যায়, তারা মালিকদের নিকট আমানত। সুতরাং কিয়ামতের দিন, তাদেরকে এই বিষয় প্রশ্ন করা হবে।
৮। যে কোন ধরণে বৈধ কাজ উত্তম, মানুষের নিকট ভিক্ষা করা হতে। রাসূল (সা.) বলেছেন:
لو أن أحدكم أخذ حَبْلَه فأتى بحطَبٍ فباعه فأغنى به نفسه، خير له من أن يسأل الناس أعطوه أو منعوه
তোমাদের মধ্য হতে কেউ লাকড়ির বোঝা বহন করে বিক্রি করা উত্তম, কারো নিকট হাত পাতার চেয়ে, হয়ত সে দিতেও পারে আবার না করতে পারে। (বুখারী ও মুসলিম)
৯। কর্মের ভিতর তিনটি রোকন রয়েছে: শ্রমিক, শ্রম, মালিক। ইসলামে কাজের বা শ্রমের মর্যাদা তো সবার নিকট স্পষ্ট। তখনই সেটি মর্যাদা পায়, যখন তা বৈধ হবে। যে ব্যক্তি হারাম ভাবে উপার্জন করে, সে নিজেকে শাস্তির মুখে ঠেলে দিলো। এর সাজা তাকে দুনিয়াতেই অনেক সময় ভোগ করতে হয়।
১০। কাজ আরম্ভ করার পূর্বেই কন্ট্রাক্ট করতে হবে, বেতন কত হবে? ডিউটি কত ঘণ্ট করতে হবে? এটাই নবীদের আদর্শ, এবং ইনসাফের নীতি। যেমন মূসা (আ.) যখন শোয়াইব (আ.)-এর মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন, তখন তিনি বলেছিলেন,
قَالَ إِنِّي أُرِيدُ أَنْ أُنْكِحَكَ إِحْدَى ابْنَتَيَّ هَاتَيْنِ عَلَى أَنْ تَأْجُرَنِي ثَمَانِيَ حِجَجٍ ﴾ القصص: ২৭
যে আমি মহরানা বাবদ আট বছর কাজ করবো।
ইসলামে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক: ইসলামে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক হবে পিতা-সন্তানের ন্যায়। নিজের পরম আত্মীয়ের মতোই শ্রমিকের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ করা, পরিবারের সদস্যদের মতই তাদের আপ্যায়ন করা, শ্রমিকের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার প্রতিটি মুহূর্তের প্রতি মালিকের খেয়াল রাখা এবং তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করা মালিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। শ্রমিককে তার প্রাপ্য পূর্ণভাবে যথাসময়ে প্রদান করাও মালিকের একটি প্রধান দায়িত্ব। অনেক সময় শ্রমিকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মালিকগণ উপযুক্ত মজুরী না দিয়ে যৎ সামান্য মজুরী দিয়ে শ্রমিকদের অধিকার বঞ্চিত করে। এ ধরনের মালিকদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘মহান আল্লাহ বলেন, ক্বিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হবে। তাদের মধ্যে একজন হল
وَ رَجُلٌ أسْتَأْجَرَ أَجِيْرًا فَاسْتَوْفَى مِنْهُ وَلَمْ يُعْطِهِ أَجْرَهُ
‘যে শ্রমিকের নিকট থেকে পূর্ণ শ্রম গ্রহণ করে অথচ তার পূর্ণ মজুরী প্রদান করে না’। (বুখারী, মিশকাত হা/২৯৮৪)
অপরদিকে একজন শ্রমিকের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হল- চুক্তি মোতাবেক মালিকের প্রদত্ত কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে সম্পাদন করা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
إِنَّ اللهَ تَعَالَى يُحِبُّ مِنَ الْعَامِلِ إِذَا عَمِلَ أَنْ يُّحْسِنَ
‘আল্লাহ ঐ শ্রমিককে ভালবাসেন যে সুন্দরভাবে কার্য সমাধা করে’। (ছহীহুল জামে‘ হা/১৮৯১, হাদীছ হাসান)
কিন্তু কোন কোন শ্রমিক মালিকের কাজে ফাঁকি দিয়ে নিয়মিত হাযিরা খাতায় স্বাক্ষর করে বেতন উত্তোলন করে থাকে, যা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এজন্য তাকে ক্বিয়ামতের মাঠে অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। ‘তিন শ্রেণীর লোকের দ্বিগুণ পুরস্কারের কথা ঘোষণা করে বলেন,
ثَلاَثَةٌ لَهُمْ أَجْرَانِ: رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الكِتَابِ، آمَنَ بِنَبِيِّهِ وَآمَنَ بِمُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَالعَبْدُ المَمْلُوكُ إِذَا أَدَّى حَقَّ اللَّهِ وَحَقَّ مَوَالِيهِ، وَرَجُلٌ كَانَتْ عِنْدَهُ أَمَةٌ فَأَدَّبَهَا فَأَحْسَنَ تَأْدِيبَهَا، وَعَلَّمَهَا فَأَحْسَنَ تَعْلِيمَهَا، ثُمَّ أَعْتَقَهَا فَتَزَوَّجَهَا فَلَهُ أَجْرَانِ “،
তাদের মধ্যে এক শ্রেণী হল – وَالْعَبْدُ الْمَمْلُوْكُ إِذَا أَدَّى حَقَّ اللهِ وَ حَقَّ مَوَالِيْهِ ‘ঐ শ্রমিক যে নিজের মালিকের হক্ব আদায় করে এবং আল্লাহর হক্বও আদায় করে’। (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/১১, ‘ঈমান’ অধ্যায়)
রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন, لِلْعَبْدِ الْمَمْلُوْكِ الصَّالِحِ أَجْرَانِ-‘ সৎ শ্রমিকের জন্য দু’টি প্রতিদান রয়েছে’।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন,
وَالَّذِىْ نَفْسُ أَبِيْ هُرَيْرَةَ بِيَدِهِ لَوْلاَ الْجِهَادُ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ وَالْحَجُّ وَبِرُّ أُمِّىْ لَأَحْبَبْتُ أَنْ أَمُوْتَ وَأَنَا مَمْلُوْكٌ
‘যেই সত্তার হাতে আবূ হুরায়রার প্রাণ তার কসম যদি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ, হজ্জ ও আমার মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহারের ব্যাপারগুলো না থাকত, তাহলে আমি শ্রমিক হিসাবে মৃত্যুবরণ করতে পসন্দ করতাম’। (বুখারী হা/২৫৮৪; মুসলিম হা/৪৪১০)
শ্রমিকদের যে বিষয়টি মনে রাখা যরূরী তা হল- বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতা রয়েছে। সুতরাং মে দিবসে যেকোন ব্যক্তির যানবাহন চালানোর বা শিল্প প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট খোলা রাখারও অধিকার আছে। তাতে বাধাদানের অধিকার কারো নেই। কিন্তু আমাদের দেশে মে দিবসে যদি কেউ যানবাহন চালায় বা দোকানপাট খোলা রাখে তাহলে উচ্ছৃংখল কিছু শ্রমিককে গাড়ি ভাংচুর করতে এবং দোকানপাট জোর করে বন্ধ করে দিতে দেখা যায়। যা আদৌ সমর্থনযোগ্য নয়। অনুরূপভাবে জান মালের ক্ষতি করে হরতাল-ধর্মঘটও বর্জন করা আবশ্যক।
পরিশেষে বলা যায়, এ সুন্দর পৃথিবীর রূপ-লাবণ্যতায় শ্রমিকদের কৃতিত্বই অগ্রগণ্য। কিন্তু শত আক্ষেপ সভ্যতার কারিগর এ শ্রেণীটি সর্বদাই উপেক্ষিত, অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত। উদয়াস্ত উষ্ণ ঘামের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ নিয়ে খেটে যে শ্রমিক তার মালিকের অর্থযন্ত্রটি সচল রাখে, সেই মালিকেরই অবিচারে শ্রমিকদের অচল জীবনটি আরো দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এটাকে সেই মৌমাছির সাথে তুলনা করা যায়, যারা দীর্ঘ পরিশ্রমের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করে চাকে সঞ্চয় করে, কিন্তু তার ভাগ্যে একফোঁটা মধুও জোটে না। সুতরাং সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় মালিক-শ্রমিকের বৈরিতাপূর্ণ সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা ও শ্রমনীতি বাস্তবায়ন করে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। আর এজন্য সর্বাগ্রে উচিত ইসলাম প্রদর্শিত মালিক-শ্রমিক নীতিমালার পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ ও বাস্তবায়ন। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন ॥
শ্রমিকের পাওনা আদায় করা দো‘আ কবূলের কারণ:
এই বিষয়ের উপর বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীস
আবূল ইয়ামান (রহঃ) … আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে তিন ব্যক্তি সফরে বের হয়ে তারা রাত কাটাবার জন্য একটি গুহায় আশ্রয় নেয়। হঠাৎ পাহাড় থেকে এক খণ্ড পাথর পড়ে গুহার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। তখন তারা নিজেদের মধ্যে বলতে লাগল তোমাদের সৎ কার্যাবলীর ওসীলা নিয়ে আল্লাহর কাছে দু’আ করা ছাড়া আর কোন কিছুই এ পাথর থেকে তোমাদেরকে মুক্ত করতে পারে না।
তখন তাদের মধ্যে একজন বলতে লাগল, হে আল্লাহ, আমার পিতা-মাতা খুব বৃদ্ধ ছিলেন। আমি কখনো তাদের আগে আমার পরিবার-পরিজনকে কিংবা দাস-দাসীকে দুধ পান করাতাম না। একদিন কোন একটি জিনিসের তালাশে আমাকে অনেক দূরে চলে যেতে হয়; কাজেই আমি তাঁদের ঘুমিয়ে পড়ার পূর্বে ফিরতে পারলাম না। আমি তাঁদের জন্য দুধ দোহায়ে নিয়ে এলাম। কিন্তু তাঁদেরকে ঘুমন্ত পেলাম। তাঁদের আগে আমার পরিবার-পরিজনকে ও দাস-দাসীকে দুধ পান করতে দেয়াটাও আমি পছন্দ করি নি। তাই আমি তাঁদের জেগে উঠার অপেক্ষায় পেয়ালাটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। এভাবে ভোরের আলো ফুটে উঠল। তারপর তাঁরা জাগলেন এবং দুধ পান করলেন। হে আল্লাহ! যদি আমি তোমার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এ কাজ করে থাকি, তবে এ পাথরের কারণে আমরা যে বিপদে পড়েছি, তা আমাদের হতে দূর করে দাও। ফলে পাথর সামান্য সরে গেল, কিন্তু তাতে তারা বের হতে পারল না।
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তারপর দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! আমার এক চাচাতো বোন ছিল। সে আমার খুব প্রিয় ছিল। আমি তার সাথে সঙ্গত হতে চাইলাম। কিন্তু সে বাধা দিল। তারপর এক বছর ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সে আমার কাছে (সাহায্যের জন্য) এল। আমি তাকে একশ’ বিশ দ্বীনার এ শর্তে দিলাম যে, সে আমার সাথে একান্তে মিলিত হবে, তাতে সে রাযী হল। আমি যখন সম্পূর্ণ সুযোগ লাভ করলাম, তখন সে বলল, আমি তোমাকে অবৈধভাবে মোহর ভাঙ্গার অনুমতি দিতে পারি না। ফলে সে আমার সর্বাধিক প্রিয় হওয়া সত্ত্বেও আমি তার সাথে সঙ্গত হওয়া পাপ মনে করে তার কাছ থেকে ফিরে আসলাম এবং আমি তাকে যে স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছিলাম, তাও ছেড়ে দিলাম। হে আল্লাহ! আমি যদি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য করে থাকি, তবে আমরা যে বিপদে পড়ে আছি তা দূর কর। তখন সেই পাথরটি (আরো একটু) সরে পড়ল। কিন্তু তাতে তারা বের হতে পারছিল না।
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তারপর তৃতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! আমি কয়েকজন মজদুর নিয়োগ করেছিলাম এবং আমি তাদেরকে তাদের মজুরীও দিয়েছিলাম, কিন্তু একজন লোক তার প্রাপ্য না নিয়ে চলে গেল। আমি তার মজুরীর টাকা কাজে খাটিয়ে তা বাড়াতে লাগলাম। তাতে প্রচুর ধন-সম্পদ অর্জিত হল। কিন্তু কিছুকাল পর সে আমার নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! আমাকে আমার মজুরী দিয়ে দাও। আমি তাকে বললাম, এসব উট, গরু-ছাগল ও গোলাম যা তুমি দেখতে পাচ্ছ, তা সবই তোমার মজুরী। সে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! তুমি আমার সাথে বিদ্রুপ করো না। তখন আমি বললাম, আমি তোমার সাথে মোটেই বিদ্রুপ করছি না। তখন সে সবই গ্রহণ করল এবং নিয়ে চলে গেল। তা থেকে একটাও ছেড়ে গেল না। হে আল্লাহ, আমি যদি তোমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য এ কাজ করে থাকি, তবে আমরা যে বিপদে পড়েছি, তা দূর কর। তখন সেই পাথরটি সম্পূর্ণ সরে পড়ল। তারপর তারা বেরিয়ে এসে পথ চলতে লাগল। (বুখারী ও মুসলিম)
হাদীসের শেষাংশ হতে যা বুঝা গেলো:
১। এই হাদীসের আলোচ্য বিষয় হতে জানা গেলো যে, ভাড়ায় কিংবা বেতন নির্দিষ্ট করে লোক নিয়োগ বৈধ।
২। শ্রমিকের শ্রম পরিশোধ করা আবশ্যক, টালমাটাল বৈধ নয়।
৩। কোন কারণে শ্রমিক চলে গেলে তার পাওনা সংরক্ষণ করবে এবং পরিবারের নিকট পৌঁছে দিতে হবে।
৪। শ্রমিক তার শ্রম গ্রহণ না করলে, এটা প্রমাণ হয় না যে, সে ফী সাবীলিল্লাহ কাজ করেছে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে স্পষ্ট করে না বলে।
৫। যে মালিক সঠিক ইনসাফের ভিত্তিতে শ্রমিকদের হক আদায় করে, তবুও তার কোন শ্রমিক যদি তার কিছু পাওনা রেখে চলে যায় কিংবা পলায়ন করে, সেক্ষেত্রে তাকে দোষারোপ না করা।
৬। একজন প্রকৃত মুত্তাকি তিনি, যিনি মানুষের হক যথাযথ ভাবে আদায় করে থাকেন। কোন প্রকারের খেয়ানত করেন না।
৭। ঈমানী ভ্রাতৃত্বে দাবী হলো, ব্যক্তি নিজের জন্য যা পছন্দ করবে, অন্যের জন্যও তাই পছন্দ করবে। হাদীসে বর্ণিত তৃতীয় জন, তাই করেছেন, নিজের সম্পদের সাথে শ্রমিকের শ্রমকেও বিনিয়োগ করে বৃদ্ধি করেছেন।
৮। কোন ব্যক্তি যখন ভালো কাজ করে, তার উচিত দুনিয়ার কারো থেকে বাহবা বা মারহাবা পাওয়ার আশা না করা বরং আল্লাহর নিকট হতে প্রতিদানের আশা করা। হাদীসে বর্ণিত মালিক তিনি অনেক যত্ন করে শ্রমিকের সম্পদ বৃদ্ধি করেছেন, যখন শ্রমিক এসে তার পাওনা চাইলো, তখন সবই তাকে বুঝিয়ে দিলো, সে কিছুই রেখে গেলো না, এমনকি ধন্যবাদও দিলো না।
৯। অন্যের সম্পদে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ বৈধ নয়, তবে মালিকের স্বার্থে করা যাবে। যেমনটি হাদীসে বর্ণিত ঘটনায় এসেছে।
১০। বৈধভাবে ব্যবসায় সত্যিই অনেক লাভ, যেভাবে হাদীসে বর্ণিত ব্যক্তি সামান্য শ্রম বিনিয়োগ করে, উট-গরু-ছাগলসহ আরো অনেক সম্পদের মালিক হয়েছিলেন।
১১। আমানতের মালে বৃদ্ধি হলে, মূল মালিকের অধিনে চলে যাবে। এই জন্যই রেহানের জমিনের আয় মূল মালিকের প্রাপ্য, কেননা জামিনটির তার নিকট আমানত রাখা হয়েছে।
১২। এখান থেকে বুঝা গেলো যে, আমলে সালেহ স্বরণ করে অর্থাৎ ওয়াসীলা বানিয়ে দোয়া করা যাবে।
১৩। এই ঘটনা হতে রাসূলের নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণিত হয়, কেননা এটি রাসূলের যুগের অনেক পূর্বের ঘটনা, যা আল্লাহ তায়ালা অহীর মাধ্যমে জানিয়েছেন।