আনুগত্যঃ ইসলামের জীবন ব্যবস্থার মূল ভিত্তিই হল আনুগত্য। সূরা সূরা আন নেসার (৫৯-৭০) আয়াতে ইসলামের সমগ্র ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের আনুগত্যের মূলনীতিসমূহ বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে এ বিষয়ে কিঞ্চিত আলোচনার চেষ্টা করা হল। আল্লাহ বলেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ أَطِيعُواْ اللهَ وَأَطِيعُواْ الرَّسُولَ وَأُوْلِي الأَمْرِ مِنكُمْ فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً * أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُواْ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنزِلَ مِن قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَن يَتَحَاكَمُواْ إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُواْ أَن يَكْفُرُواْ بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُضِلَّهُمْ ضَلاَلاً بَعِيدًا * وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْاْ إِلَى مَا أَنزَلَ اللهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنكَ صُدُودًا * فَكَيْفَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ ثُمَّ جَآؤُوكَ يَحْلِفُونَ بِاللهِ إِنْ أَرَدْنَا إِلاَّ إِحْسَانًا وَتَوْفِيقًا * أُولَـئِكَ الَّذِينَ يَعْلَمُ اللهُ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ وَعِظْهُمْ وَقُل لَّهُمْ فِي أَنفُسِهِمْ قَوْلاً بَلِيغًا * وَمَا أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلاَّ لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللهِ وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذ ظَّلَمُواْ أَنفُسَهُمْ جَآؤُوكَ فَاسْتَغْفَرُواْ اللهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُواْ اللهَ تَوَّابًا رَّحِيمًا
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম। আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবী করে যে, যা আপনার প্রতি অবর্তীর্ণ হয়েছে আমরা সে বিষয়ের উপর ঈমান এনেছি এবং আপনার পূর্বে যা অবর্তীণ হয়েছে। তারা বিরোধীয় বিষয়কে শয়তানের দিকে নিয়ে যেতে চায়, অথচ তাদের প্রতি নির্দেশ হয়েছে, যাতে তারা ওকে মান্য না করে। পক্ষান্তরে শয়তান তাদেরকে প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করে ফেলতে চায়। আর যখন আপনি তাদেরকে বলবেন, আল্লাহর নির্দেশের দিকে এসো যা তিনি রাসূলের প্রতি নাযিল করেছেন, তখন আপনি মুনাফেকদিগকে দেখবেন, ওরা আপনার কাছ থেকে সম্পূর্ণ ভাবে সরে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় যদি তাদের কৃতকর্মের দরুন বিপদ আরোপিত হয়, তবে তাতে কি হল! অতঃপর তারা আপনার কাছে আল্লাহর নামে কসম খেয়ে খেয়ে ফিরে আসবে যে, মঙ্গল ও সম্প্রীতি ছাড়া আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না। এরা হলো সে সমস্ত লোক, যাদের মনের গোপন বিষয় সম্পর্কেও আল্লাহ তা’আলা অবগত। অতএব, আপনি ওদেরকে উপেক্ষা করুন এবং ওদেরকে সদুপদেশ দিয়ে এমন কোন কথা বলুন যা তাদের জন্য কল্যাণকর। বস্তুতঃ আমি একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তাঁদের আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়। আর সেসব লোক যখন নিজেদের অনিষ্ট সাধন করেছিল, তখন যদি আপনার কাছে আসত অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রাসূলও যদি তাদেরকে ক্ষমা করিয়ে দিতেন। অবশ্যই তারা আল্লাহকে ক্ষমাকারী, মেহেরবানরূপে পেত।
সূরা আন নেসার (৫৯-৭০) আয়াত ইসলামের সমগ্র ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের বুনিয়াদ। এটি একটি ইসলামী রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রের প্রথম নম্বর ধারা। এখানে নিম্নলিখিত মূলনীতিগুলো স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়া হয়েছে।
একঃ ইসলামের জীবন ব্যবস্থায় আসল আনুগত্য লাভের অধিকারী হচ্ছেন আল্লাহ। একজন মুসলমানের সর্বপ্রথম পরিচয় হচ্ছে সে আল্লাহর বান্দা। এরপর সে অন্য কিছু। মুসলমানের ব্যক্তিগত জীবন এবং মুসলমানদের সমাজ ব্যবস্থা উভয়ের কেন্দ্র ও লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য করা ও বিশ্বস্ততার সাথে তাঁর নির্দেশ মেনে চলা। অন্যান্য আনুগত্য ও অনুসৃতি কেবল মাত্র তখনই গৃহীত হবে যখন তা আল্লাহর আনুগত্য অনুসৃতির বিপরীত হবে না। বরং তার অধীন ও অনুকূল হবে। অন্যথায় এই আসল ও মৌলিক আনুগত্য বিরোধী প্রতিটি আনুগত্য শৃঙ্খলাকে ভেঙ্গে দূরে নিক্ষেপ করা হবে। একথাটিকেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নি¤েœাক্ত বক্তব্যে পেশ করেছেন:
لَا طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ فِي مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ: الدارقطني – مشكاة المصابيح
অর্থঃ স্রষ্টার নাফরমানি করে কোন সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না। (দারাকুতনী- মিশকাতুল মাসাবীহ)
দুইঃ ইসলামী জীবন ব্যবস্থার দ্বিতীয় ভিত্তি হচ্ছে, রাসূলের আনুগত্য। এটি কোন স্বতন্ত্র ও স্বয়ং সম্পূর্ণ আনুগত্য নয়। বরং আল্লাহর আনুগত্যের এটিই একমাত্র বাস্তব ও কার্যকর পদ্ধতি। রাসূলের আনুগত্য এ জন্য করতে হবে যে, আল্লাহর বিধান ও নির্দেশ আমাদের কাছে পৌঁছার তিনিই একমাত্র বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। আমরা কেবলমাত্র রাসূলের আনুগত্য করার পথেই আল্লাহর আনুগত্য করতে পারি। রাসূলের সনদ ও প্রমাণপত্র ছাড়া আল্লাহর কোন আনুগত্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আর রাসূলের আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নামান্তর। নিম্নোক্ত হাদীসে এই বক্তব্যটিই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছেঃ
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضي الله عنه أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ: مَنْ أَطَاعَنِي فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ عَصَى اللهَ وَمَنْ عَصَى أَمِيرِي فَقَدْ عَصَانِي مسند الامام أحمد
অর্থঃ যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করলো সে আসলে আল্লাহর আনুগত্য করলো এবং যে ব্যক্তি আমার নাফরমানি করলো সে আসলে আল্লাহর নাফরমানি করলো। যে ব্যক্তি আমীরের আনুগত্য করলো সে আসলে আমার আনুগত্য করলো এবং যে ব্যক্তি আমীরের নাফরমানি করলো সে আসলে আমার নাফরমানি করলো। (মুসনাদে আহমদ)
তিনঃ উপরোল্লিখিত দুটি আনুগত্যের পর তাদের অধীনে তৃতীয় আর একটি আনুগত্য ইসলামী জীবন ব্যবস্থার আওতাধীনে মুসলমানদের ওপর ওয়াজিব। সেটি হচ্ছে মুসলমানদের মধ্যে থেকে ‘উলিল আমর’ তথা দায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারীদের আনুগত্য। মুসলমানদের সামাজিক ও সামষ্টিক কার্যকালাপের ক্ষেত্রে দায়িত্ব সম্পন্ন ও নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি মাত্রই ‘ উলিল আমর ‘-এর অন্তর্ভুক্ত। তারা মুসলমানদের মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিন্তাগত ক্ষেত্রে নেতৃত্বদানকারী উলামায়ে কেরাম বা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ হতে পারেন, আবার দেশের শাসনকার্য পরিচালনাকারী প্রশাসকবৃন্দ হতে পারেন, অথবা আদালতে বিচারের রায় প্রদানকারী শেখ সরদার প্রধানও হতে পারেন। মোটকথা যে ব্যক্তি যে কোন পর্যায়েই মুসলমানদের নেতৃত্বদানকারী হবেন তিনি অবশ্যি আনুগত্য লাভের অধিকারী হবেন। তার সাথে বিরোধ সৃষ্টি করে মুসলমানদের সামাজিক জীবনে বাধা-বিপত্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যাবে না। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, তাকে মুসলিম দলভুক্ত হতে হবে এবং আল্লাহ ও রাসূলের অনুগত হতে হবে। এই আনুগত্যের জন্য এই শর্ত দুটি হচ্ছে অপরিহার্য ও বাধ্যতামূলক। কেবলমাত্র উল্লেখিত আয়াতটির মধ্যভাগে এ সুস্পষ্ট শর্তটি সংশ্লিষ্ট হয়নি বরং হাদীসেও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিপূর্ণ ব্যাপকতার সাথে দ্ব্যর্থহীনভাবে এটি বর্ণনা করেছেন। যেমন নিম্নোক্ত হাদীসগুলো দেখা যেতে পারেঃ
السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ عَلَى الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ فِيمَا أَحَبَّ وَكَرِهَ، مَا لَمْ يُؤْمَرْ بِمَعْصِيَةٍ، فَإِذَا أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَة
অর্থঃ নিজের নেতৃবৃন্দের কথা শোনা ও মেনে চলা মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য, তা তার পছন্দ হোক বা না হোক, যে পর্যন্ত না তাকে নাফরমানি হুকুম দেয়া হয়। আর যখন তাকে নাফরমানির হুকুম দেয়া হয় তখন তার কিছু শোনা ও আনুগত্য করা উচিত নয়। (বুখারী ও মুসলিম)
১. আনুগত্য-ফরজ – আল কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ থেকে তা স্পষ্টভাবে বুঝা যাবে ।
قُلْ أَطِيعُواْ اللهَ وَالرَّسُولَ فإِنْ تَوَلَّوْاْ فَإِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْكَافِرِينَ
অর্থঃ তাদেরকে বলোঃ আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করো। তারপর যদি তারা তোমাদের এ দাওয়াত গ্রহণ না করে, তাহলে নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ এমন লোকদের ভালোবাসবেন না, যারা তাঁর ও তাঁর রাসূলদের আনুগত্য করতে অস্বীকার করে। (সূরা আলে ইমরান-৩২)
وَأَطِيعُواْ اللهَ وَأَطِيعُواْ الرَّسُولَ وَاحْذَرُواْ فَإِن تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُواْ أَنَّمَا عَلَى رَسُولِنَا الْبَلاَغُ الْمُبِينُ
অর্থঃ তোমরা আল্লাহর অনুগত হও, রাসূলের অনুগত হও এবং আত্মরক্ষা কর। কিন্তু যদি তোমরা বিমুখ হও, তবে জেনে রাখ, নিঃসন্দেহ আমাদের রসূলের উপরে হচ্ছে মাত্র স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেয়া। (সূরা মায়েদা-৯২)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ أَطِيعُواْ اللهَ وَرَسُولَهُ وَلاَ تَوَلَّوْا عَنْهُ وَأَنتُمْ تَسْمَعُونَ – وَلاَ تَكُونُواْ كَالَّذِينَ قَالُوا سَمِعْنَا وَهُمْ لاَ يَسْمَعُونَ – إِنَّ شَرَّ الدَّوَابَّ عِندَ اللهِ الصُّمُّ الْبُكْمُ الَّذِينَ لاَ يَعْقِلُونَ
হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ মান্য কর এবং শোনার পর তা থেকে বিমুখ হয়ো না। আর তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যারা বলে যে, আমরা শুনেছি, অথচ তারা শোনেনা। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’আলার নিকট সমস্ত প্রাণীর তুলনায় তারাই মূক (বোবা) ও বধির, যারা উপলদ্ধি করে না। (সূরা আনফাল-২০-২২)
وَأَطِيعُواْ اللهَ وَرَسُولَهُ وَلاَ تَنَازَعُواْ فَتَفْشَلُواْ وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ وَاصْبِرُواْ إِنَّ اللهَ مَعَ الصَّابِرِينَ
অর্থঃ আর আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ মান্য কর এবং তাঁর রাসূলের। তাছাড়া তোমরা পরস্পরে বিবাদে লিপ্ত হইও না। যদি তা কর, তবে তোমরা কাপুরুষ হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব চলে যাবে। আর তোমরা ধৈর্যধারণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা রয়েছেন ধৈর্যশীলদের সাথে। (সূরা আনফাল-৪৬)
فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطِيعُونِ
অর্থঃ অতএব, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। (সূরা আশ শুয়ারা – ৯ বার)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَلَا تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ
অর্থঃ হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, রাসূলের আনুগত্য করো এবং নিজেদের আমল ধ্বংস করো না। (সূরা মুহাম্মদ-৩৩)
وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ فَإِن تَوَلَّيْتُمْ فَإِنَّمَا عَلَى رَسُولِنَا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ
অর্থঃ আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রাসূলের আনুগত্য করো। কিন্তু তোমরা যদি আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে সত্যকে স্পষ্টভাবে পৌঁছিয়ে দেয়া ছাড়া আমার রাসূলের আর কোন দায়িত্ব নেই। (সূরা তাগাবুন-১২)
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَإِذَا كَانُوا مَعَهُ عَلَى أَمْرٍ جَامِعٍ لَمْ يَذْهَبُوا حَتَّى يَسْتَأْذِنُوهُ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَأْذِنُونَكَ أُوْلَئِكَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ
অর্থঃ মু’মিন তো আসলে তারাই যারা অন্তর থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মানে এবং যখন কোন সামষ্টিক কাজে রাসূলের সাথে থাকে তখন তার অনুমতি ছাড়া চলে যায় না। যারা তোমার কাছে অনুমতি চায় তারাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে বিশ্বাসী। (সূরা নূর-৬২)
২. আনুগত্য হবে এক নেতার: أُولِي الْأَمْرِ একাধিক নেতার আনুগত্য কারোই আনুগত্য নয়
ইসলামের দৃষ্টিতে সমগ্র দেশ একটি মসজিদ তুল্য, এখানে নেতা ( ইমাম থাকবেন ১ জন )
مَنْ يُطِعِ اللهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ رَشَدَ، وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُولَهُ فَإِنَّهُ لَا يَضُرُّ إِلَّا نَفْسَه
অর্থঃ যে ব্যক্তি আল্লাহ রাসুলের ( সঃ) আনুগত্য করল সে সৎপথ প্রপ্ত হল আর যে ব্যক্তি আল্লাহ রাসুলের ( সঃ) অবাধ্য হল সে প্রকৃতপক্ষে নিজেরই ধ্বংস ডেকে আনল।
৩ আনুগত্য বাধ্যতামূলক, মন চাক আর না চাক-
السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ عَلَى الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ فِيمَا أَحَبَّ وَكَرِهَ، مَا لَمْ يُؤْمَرْ بِمَعْصِيَةٍ، فَإِذَا أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَة
অর্থঃ নিজের নেতৃবৃন্দের কথা শোনা ও মেনে চলা মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য, তা তার পছন্দ হোক বা না হোক, যে পর্যন্ত না তাকে নাফরমানি হুকুম দেয়া হয়। আর যখন তাকে নাফরমানির হুকুম দেয়া হয় তখন তার কিছু শোনা ও আনুগত্য করা উচিত নয়। (বুখারী ও মুসলিম)
৪. ইসলাম অবশ্য কখনো অন্ধ আনুগত্যের দাবী করেনি: বরং সে কেবল সৎকর্মের ক্ষেত্রে আনুগত্য চেয়েছে। ‘সৎকর্মেও’ সীমার বাইরে তার নির্দেশ হচ্ছেঃ
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَىٰ ۖ وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ
অর্থঃ “গুনাহ ও আল্লাহর নির্ধারিত সীমালঙ্ঘনমূলক কাজে পরস্পরের সহযোগী হয়ো না।”-সূরা মায়েদা, আয়াতঃ ২
৫. আনুগত্য নেতৃত্বের, ব্যক্তির নয়: ইসলামী আন্দোলন ব্যক্তিত্বের চর্তুদিকে আবর্তিত হয় না। ব্যক্তির পরিবর্তনে আনুগত্যের পরিবর্তন হয়না ।
وَمَا مُحَمَّدٌ إِلاَّ رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِن مَّاتَ أَوْ قُتِلَ انقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ وَمَن يَنقَلِبْ عَلَىَ عَقِبَيْهِ فَلَن يَضُرَّ اللّهَ شَيْئًا وَسَيَجْزِي اللهُ الشَّاكِرِينَ
অর্থঃ মুহাম্মাদ একজন রাসূল বৈ তো আর কিছুই নয়। তার আগে আরো অনেক রাসূলও চলে গেছেন। যদি তিনি মারা যান বা নিহত হন, তাহলে কি পেছনের দিকে ফিরে যাবে? মনে রেখো, যে পেছনের দিকে ফিরে যাবে সে আল্লাহর কোন ক্ষতি করবে না, তবে যারা আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হয়ে থাকবে তাদেরকে তিনি পুরস্কৃত করবেন। সূরা আলে ইমরান: ১৪৪
৬. আনুগত্যের বেলায় নেতার কেমন তা দেখা যাবেনা-
اسْمَعُوا وَأَطِيعُوا، وَإِنْ أُمِّرَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌحَبَشِيٌّ كَأَنَّ رَأْسَهُ زَبِيبَة
অর্থঃ (রাসূল সা. বিদায় হজ্বের ভাষনে বলেছিলেন) যদি কোন হাবসী ক্রীতদাসকেও তোমাদের নেতা বানিয়ে দেয়া হয় যার মাথা কিসমিসের মত, তা হলেও তোমরা তার আনুগত্য কর । (বুখারী)
وَلَوِ اسْتُعْمِلَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌيَقُودُكُمْ بِكِتَابِ اللهِ، اسْمَعُوا لَهُ وَأَطِيعُوا
অর্থঃ যদি কোন ক্রীতদাসকেও তোমাদের নেতা বানিয়ে দেয়া হয় আর সে যদি আল্লাহর কিতাব আনুসারে তোমাদের পারচালনা করে তা হলেও তোমরা তার কথা শোন ও আনুগত্য কর । (বুখারী)
৭. আনুগত্য হবে পরিপূর্ণ, আংশিক নয়, আংশিক আনুগত্য কোন আনুগত্য নয়
৮. মূলতঃ আনুগত্যই ইসলাম, ইসলাম অর্থই আনুগত্যই
إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ
অর্থঃ (হযরত ইবরাহীম (আঃ) কে) যখন তার রব তাকে বললো, “মুসলিম হয়ে যাও। ” তখনই সে বলে উঠলো, “আমি বিশ্ব-জাহানের প্রভুর ‘মুসলিম’ হয়ে গেলাম। ” ( সূরা বাকারা ১৩১)
৯.পরিপূর্ণ আনুগত্যকারীই পরিপূর্ণ মুসলমান-
১০. পরিপূর্ণ আনুগত্য করার জন্য সংগঠনের নেতার কাছে আনুগত্যের শপথের প্রয়োজন-
১১. আনুগত্য হবে ঘোষিত, অঘোষিত আনুগত্য কোন আনুগত্য নয়
১২. আনুগত্য পরিহারকারী ইসলাম পরিত্যাগকারীর সমতুল্য ।
আনুগত্যের উদাহরণঃ
(১) হযরত আবুবকরের আনুগত্যঃ
মহানবীকে (সা.) আল্লাহ তায়ালার মদীনায় হিজরত করার নির্দেশ দানের পরই তিনি হযরত আবু বকরকে (রা.) বলেছিলেন, ‘হে আবুবকর মক্কার কাফেলারা বড়ই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। কবে কখন হয়ত মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করতে হতে পারে’। হিজরতের রাতে মহানবী (সা.) নিজ বিছানায় হযরত আলী (রা.) কে শায়িত রেখে মদীনার পথে রওনা দিলেন। সাথী হিসেবে বন্ধু আবু বকর (রা.) কে সঙ্গে নেয়ার জন্য তাঁর বাড়ীর সামনে গিয়ে, আবু বকর! বলে একবার ডাক দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আবু বকর (রা.) বেরিয়ে এলেন। এত তাড়াতাড়ি কিভাবে এলে? জিজ্ঞাসা করলেন হযরত (সা.)। আবু বকর (রা.)বললেন যেদিন আপনি মদীনায় হিজরত করার কথা বলেছিলেন সেদিন হতে একটি রাতের জন্যও আমি বালিশে মাথা রেখে ঘুমাই নাই, সারা রাত দরজার সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। কারণ আমি আরাম করে ঘুমিয়ে থাকবো আর কাফেরেরা আপনাকে ধাওয়া করবে আপনি আমাকে ডেকে ডেকে পাবেন না। কাফেরেরা আপনাকে আঘাত করবে, যখম করবে। আমি আবু বকর এটা সইতে পারবো না।
(২) হযরত খালিদ ইবনে অলীদের আনুগত্যঃ
৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা.) হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদ (রা.)-এর নেতৃত্বে সাত হাজার মুজাহিদসহ সিরিয়া অভিযানে প্রেরণ করেন। ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৩ আগস্ট মুতাবিক ১৩ হিজরীর ২২ জমাদিউসসানী ৬১ বছর বয়সে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা.) ইন্তিকাল করেন। হযরত ‘উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) যখন খিলাফতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন তখন মুসলিম বাহিনী ও সিরীয় বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছিল। খিলাফতের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেই যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় হযরত ‘উমর (রা.) হযরত আবূ ‘উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা.)-কে হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদ(রা.)-এর স্থলে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেন। হযরত খালিদ (রা.) সঙ্গে সঙ্গে আবু ‘উবায়দা (রা.)-এর নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন।
(৩) হযরত আবু জান্দালের আনুগত্যঃ
হুদায়বিয়া সন্ধিপত্র যখন লিখিত হচ্ছিলো, ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটনাচক্রে সুহাইলের পুত্র হযরত আবু জান্দাল (রা.) মক্কা থেকে পালিয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি শৃংখলিত অবস্থায় মুসলমানদের সামনে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন এবং সবাইকে নিজের দুর্গতির কথা শোনালেন। তাঁকে ইসলাম গ্রহণের অপরাধে কি কি ধরণের শাস্তি দেয়া হয়েছে, তা-ও সবিস্তারে খুলে বললেন। অবশেষে তিনি হযরত (সা.)-এর কাছে আবেদন জানালেন : ‘হুযুর আমাকে কাফিরদের কবল থেকেকে মুক্ত করে আপনার সঙ্গে নিয়ে চলুন ।’ একথা শুনে সুহাইল বলে উঠলো : ‘দেখুন, সন্ধির শর্ত অনুযায়ী নিয়ে যেতে পারেন না।’ কারণ সন্ধির একটি শর্ত ছিল “কাফির বা মুসলমানদের মধ্য থেকে কেউ মদীনায় গেলে তাকে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু কোনো মুসলমান মক্কায় গেলে তাকে ফেরত দেয়া হবে না”। এটা ছিলো বাস্তবিকই এক নাজুক সময়। কারণ, আবু জান্দাল ইসলাম গ্রহণ করে নির্যাতন ভোগ করছিলেন এবং বারবার ফরিয়াদ জানাচ্ছিলেন : ‘হে মুসলিম ভাইগণ! তোমরা কি আমাকে আবার কাফিরদের হাতে তুলে দিতে চাও?’ সমস্ত মুসলমান এই পরিস্তিতিতে অত্যন্ত অস্থির হয়ে উঠলো। হযরত উমর (রা.) তো রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে এ পর্যন্ত বললেন যে, ‘আপনি যখন আল্লাহর সত্য নবী, তখন আর আমরা এ অপমান কেন সইব? হযরত (সা.) তাকে বললেন : ‘আমি আল্লাহর পয়গাম্বর, তাঁর হুকুমের নাফরমানী আমি করতে পারিন না। আল্লাহ-ই আমায় সাহায্য করবেন।’
আনুগত্যহীনতার কারণঃ
(১) আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দেয়া
(২) আনুগত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে অজ্ঞতাঃ
(৩) গর্ব ও অহংকার
(৪) হিংসা ও বিদ্বেষ
(৫) সিনিয়রিটি জুনিয়রিটি মনোভাব ( বয়স, লেখাপড়া, সংগঠনে অন্তর্ভুক্তি ইত্যাদি)
(৬) মেজাজের ভারসাম্যহীনতা
(৭) পদের প্রতি মোহ
(৮) দায়িত্বশীল পছন্দ না হওয়া
(৯) মানোন্নয়নে বিলম্ব হওয়া
(১০) দায়িত্বশীলের সাথে তিক্ত সম্পর্ক
(১১) দায়িত্বশীলের ব্যাপারে সন্দেহ প্রবণতা
(১২) মতামতের কুরবানী করতে না পারা
(১৩) হৃদয়ের বক্রতা
(১৪) মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্ন করার প্রবণতা
(১৫) নিজেকে অন্যের চেয়ে যোগ্য মনে করা
(১৬) সুযোগ সন্ধানী/ জাগতিক লাভের মনোভাব
(১৭) দায়িত্ব থেকে অব্যহিত বা লঘু দায়িত্ব অর্পণ
আনুগত্যহীনতার পরিনাম
আনুগত্য পরিহারকারী দুনিয়া ও আখেরাতে শাস্তির হকদার।
فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَن تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ ٦٣
অর্থঃ রাসূলের হুকুমের বিরুদ্ধাচারণকারীদের ভয় করা উচিত যেন তারা কোন বিপর্যয়ের শিকার না হয় অথবা তাদের ওপর যন্ত্রণাদায়ক আযাব না এসে পড়ে । (সূরা নূর-৬৩)
উপরিউক্ত কুরআনের আয়াত ও হাদীস থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ইসলামে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ স্বয়ং আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করারই সমতুল্য। পক্ষান্তরে আল্লাহর ও রাসূলের অনুসারী থাকা সত্ত্বেও নেতাকে অমান্য করা স্বয়ং আল্লাহ ও রাসূলকে অমান্য করার সমতুল্য। বস্তুত নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যবিহীন জীবন সত্যিকার ইসলামী জীবন নয়। সে জীবনে সফলতাও অসম্ভব।