আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করলাম?

আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করলাম?

আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করলাম?

পূর্বে প্রকাশিতের পর:

১১ পর্ব

একটি অবিস্মরণীয় সাক্ষাতকার:

মুসলমানদের মধ্যে এই সব ভেদাভেদ,প্রথা পদ্ধতির নামে ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়া,হিন্দুদের পূজা-পার্বণে অংশগ্রহণ প্রভৃতি আমাকে ভীষণভাবে বেদনাতুর করে তুলেছিল।  মনের এই বেদনা নিয়ে একদিন প্রখ্যাত মওলান মোহাম্মদ আকরাম খাঁ সাহেবের সাথে দেখা করি।

তিনি ধৈর্যসহকারে আমার কথা শুনেন এবং অশ্রু সজল চোখে কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থাকেন।  অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর তাঁর সাথে আমার যে কথোপকথন হয়েছিল,পাঠকবর্গের অবগতির জন্যে তার অংশ বিশেষকে এখানে তুলে ধরছিঃ

মাওলানা সাহেব: আপনার বোধ হয় মনে আছে,ইসলাম গ্রহণের পূর্বে আমি আপনাকে বলেছিলাম যে ইসলাম গ্রহণ খুবই কঠিন কাজ।  অতএব,ভাল করে ভেবে দেখুন।

আমি: জ্বি-হুবহু মনে রয়েছে।

মাওলানা সাহেব: যে সব কারণের জন্যে ইসলাম গ্রহণকে আমি কঠিন কাজ বলেছিলাম,তার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা। এই অবস্থা আপনাকে যে প্রচণ্ড আঘাত দিবে সেটা আমি অনুমান করতে পেরেছিলাম।  কাগজের ইসলাম আর আমাদের ইসলামের মধ্যে এই যে বিরাট ফাঁক,এ জন্যে আমাদের অর্থাৎ আমর যারা ইসলাম নিয়ে কিছুটা চিন্তা-ভাবনা করি তাদের বুকের বেদনাও মোটেই কম নয়।

আমি: এখন প্রশ্ন হলো এই বেদনা লাঘবের কি উপায় আপনারা করছেন?

মাওলানা সাহেব: ইসলাম সম্পর্কে যাদের সামান্য অভিজ্ঞতাও রয়েছে, তাঁরা জানেন যে, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কুরআনের আইন চালু না হওয়া পর্যন্ত কারো পক্ষেই সত্যিকারের ইসলামী জীবন গড়ে তোলা সম্ভব নয়।  দুর্ভাগ্যবশত ভারতীয় মুসলমানেরা দীর্ঘদিন যাবত পরাধীন জীবন যাপন করছে; দেশে চালু রয়েছে ইংরেজদের আইন।  আপনি বোধহয় জানেন যে,একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য করা বা আল্লাহর উদ্দেশ্যে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কেউ সত্যিকারের মুসলমান বলে পরিগণিত হতে পারে না।

অথচ পরাধীন দেশে রাজার আনুগত্য করতে হয় এবং রাজার আইনকে মেনে চলতে হয়।  এর সামান্যতম ব্যতিক্রমও রাষ্ট্রদ্রোহীতা, আর রাষ্ট্রদ্রোহীতার শাস্তি হলো প্রাণদণ্ড।  এমতাবস্থায় রাষ্ট্রীয় বিধান এবং আল্লাহর বিধান, এ দুটো এক সাথে মেনে চলা কোনক্রমেই সম্ভব হতে পারে না।  এক কথায় আমরা এখন ইংরেজের গোলাম-আল্লাহর গোলাম নই।  সরকারের কাছে কোন আবেদন নিবেদন করতে গেলে আমাদের যে “Your most obedient servant”  লিখতে হয়, তা থেকেই আমরা কার গোলামী করছি সেটা সুস্পষ্টরূপেই বুঝতে পারা যায়।

বর্তমানে পরিস্থিতিতে এছাড়া আর কোন উপায় নেই দেখে, আলেম-সমাজ কোনরূপে ইসলামকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন যদি এ চেষ্টাটুকুও তাঁরা না করতেন তবে এতদিনে ইংরেজ এবং তাদের তল্‌পী-বাহকেরা এদেশ থেকে ইসলামের নাম-নিশানাটুকু ও নিঃশেষে মিটিয়ে দিতো।

আমি: বর্তমান পরিস্থিতিতে সত্যিকারের মুসলমান হওয়া যদি সম্ভবই না হয় তবে আমার ইসলাম গ্রহণ তো একটা ব্যর্থ প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়।

মাওলানা সাহেব: সাধ্যানুযায়ী যতটুকু পারেন ইসলামী জীবন যাপন করে যান।  কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ইসলামী আইন যাতে চালু হয় অত্যন্ত গোপনে হলেও তার জন্যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।  মনে রাখবেন নফল নামায পড়ে এবং দোআ করে আর যা-ই হোক ইসলামী আইন চালু করা যায়না।  এ জন্যে যে চরম মূল্য দিতে হয় বিশ্বনবী (সাঃ) তার জ্বলন্ত প্রমাণ রেখে গিয়েছেন।

আমি: ইসলামী আইন চালু করার প্রচেষ্টা কিভাবে গ্রহণ করবো সে সম্পর্কে কিছু উপদেশ আমাকে দিন।

মাওলানা সাহেব: মুসলিম লীগ পাকিস্তানের আন্দোলন শুরু করেছে।  আজ হোক আর কাল হোক, ইংরেজকে এদেশ ছাড়তে হবে; হিন্দু কংগ্রেস গোটা ভারতবর্ষকে গ্রাস করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।  যদি কংগ্রেস তা করতে পারে তবে এদেশের সংখ্যালঘু মুসলমানেরা আর কোনদিন মুক্তি পাবে না।  সংঘ্যাগরিষ্ঠতার বলে হিন্দুরা চিরকাল ধরে মুসলমানদের উপর কর্তৃত্ব করে যাবে।

ইংরেজদের শাসন থেকে ওদের শাসন হবে নিকৃষ্টতর।  মুসলমানেরা যদি এ সমসয়ে দুর্বার আন্দোলন সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদের জন্যে পৃথক কেটা আবাসভূমি করে নিতে এবং সেখানে ইসলামী আইন চালু করতে না পারে, তবে সেই নিকৃষ্টতর শাসনের নির্মম শিকার তাদের হতে হবে।  কাজেই এই আন্দোলনে শরীক হতে চেষ্টা করুন- এই আমার উপদেশ।

বলাবাহুল্য মাওলানা সাহেবের কথায় আমার মনটা এক অনির্বচনীয় আশা ও আনন্দে ভরে উঠেছিল।  সুযোগ বুঝে একদিন শ্রদ্ধেয় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে দেখা করি।  বেশ কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা হয় মুসলিম প্রধান অঞ্চলসমূহ নিয়ে পাকিস্তান তথা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনা কথা তিনি বুঝিয়ে বলেন।  ইসলামী বিধান প্রবর্তনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের আদর্শ হতে পারে এমন একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলা যে খুবই সম্ভব, বেশ দৃঢ়তার সাথে সোহরাওয়ার্দী সাহেব সে কথাও সেদিন আমাকে বলেছিলেন।

ইসলামী রাষ্ট্র গড়ে উঠবে, ফলে মুসলমানদের পক্ষে সত্যিকারের মুসলমান হয়ে গড়ে উঠা সম্ভব হবে,হিন্দুদের কাছে আমাকে আর লজ্জিত-অপমানিত হতে হবে না, বরং আমিই তাদের কাছে মাথা তুলে বলতে পারবো-‘সত্যিকারের মুসলমান কাকে বলে চেয়ে দেখ, বল, ইসলাম গ্রহণ করে আমি ভাল কাজ করেছি কিনা। ’

আমার বিক্ষুব্ধ-বেদনাহত দেহ-মনের পরতে পরতে এই কথাগুলো এমনই এক আশা ও আনন্দের হিল্লোল সৃষ্টি করেছিল যে ‘পাকিস্তান তথা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজে আমি আমার নগণ্য শক্তিকে পরিপূর্ণবাবে কাজে লাগাবো’ আকুল আগ্রহের সাথে জনাব সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কাছে এই ওয়াদা করে সেদিন আমি বিদায় নিয়েছিলাম।

আজ লিখতে বসে অবাক হতে হয় যে,এই আশার ছলনা একদিন আমাকে আমার স্নেহশীলা জননীর কাছে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।  কলিকাতায় আমার জনৈক ভগ্নিপতির বাড়ীতে তাঁকে একান্তে ডেকে এনে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে এবং আদর্শ বুঝাতে চেষ্টা করেছিলাম এবং বলেছিলাম।  ‘মা’ তুমি আশীর্বাদ কর, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে সেদিন তোমরা ইসলাম ও মুসলমানের সত্যিকারের চেহারা দেখতে পাবে এবং বুঝতে পারবে যে, ইসলাম কত সুন্দর, কত মহান।  আর আমি ভুল করে ইসলাম গ্রহণ করিনি সেকথাও সেদিন তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। ’

আমার স্নেহশীলা জননী এই বলে সেদিন আমার কথার উত্তর দিয়েছিলেনঃ ‘দেখ বাবা! তুই মুসলমান হওয়ার কারণে বুকটা আমার ভেঙ্গে গিয়েছে।  বুকে পাথর চাপা দিয়ে কোন মতে বেঁচে আছি।  কিন্তু তোর মুসলমান হওয়ার কারণে সমাজের পক্ষ থেকে আমাদের বিশেষ করে আমার উপর যে লাঞ্ছনা, অপমান ও ঠাট্টা বিদ্রুপের শর নিক্ষিপ্ত হয়ে চলেছে বহু চেষ্টা করেও তা আমি সহ্য করতে পারছি না। ’

এইটুকু বলেই হঠাৎ আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ছিলেন এবং আমার কানের কাছে মুখ রেখে অনুচ্চ স্বরে বলেছিলেন, ‘তোকে আর বলবো কি বাবা! বাড়ীর কাছে কোন মুসলমান ছিল না, কামলা এবং মুসলমান প্রজারা কেউ যদি কোদিন বাড়ীতে এসেছে, বাইরে থেকেই বিদায় নিয়েছে।  বাড়ীর ভিতরে প্রবেশের অধিকারই কারো ছিল না।  কেবলমাত্র তোর মামাবাড়ী যাওয়ার সময়ে বছরে একবার মুসলমান মাঝির নৌকায় চড়ে গিয়েছি, তখন তোর বাবা বা অন্য কেউ সঙ্গে থেকেছেন।  এ ছাড়া কোনদিন কোন মুসলমানের চেহারাও চোখে দেখিনি।  অথচ আজ একথাও আমার কানে পড়ছে যে তুই নাকি মুসলমানের ছেলে।  অর্থাৎ মুসলমানের ঔরসে জন্ম হয়েছে বলেই তুই নাকি মুসলমান হয়েছিস। বলরে তা! কোন সতী নারীর পক্ষে এর চেয়ে জঘন্য কথা আর কি হতে পারে?’

আমাকে বাহুবন্ধন থেকে ছেড়ে দিয়ে তিনি বসে পড়েছিলেন এবং লজ্জা এবং দুঃখে কিছুক্ষণ তিনি কোন কথাই বলতে পেরেছিলেন না।  অঝোরে শুধু কেঁদেই চলেছিলেন।

উল্লেখ্য যে, আমার স্নেহশীলা মাতার দেহের বর্ণ ছিল দুধে অলতা মিশানো রং- এর মতো।  গুরুজনেরা ডাকতেন ‘রাঙ্গা বউ’ বলে।  আর ছোটরা কেউ রাঙ্গা দিদি, কেউ রাঙ্গা পিসি প্রভৃতি বলে ডাকতো।  সেই রাঙ্গামা আমার যখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন তখন তার মুখ-মণ্ডল লাল টুকটুকে হয়ে উঠেছিল।  আর তাঁর সেই রাঙ্গা চেহারা দেখে দুঃখ বেদনায় আমার মনটা নিকষ কালো আঁধারে ছেয়েগিয়েছিল।

আশ্চর্যের বিষয় এহেন মর্মান্তিক অবস্থার মধ্যেও পাকিস্তানরূপ ইসলামী রাষ্ট্রর কল্পিত ছবি আমার মনের মাঝে ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল।

তাই আমার রোরুদ্যমানা জননী পা-এ হাত রেখে আমি এই বলে সেদিন বিদায় নিয়েছিলাম যে, -মা! তুমি আশীর্বাদ কর, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হোক, তা হলেই সকলের ভুল ভেঙ্গে যাবে, তোমাকে বা অন্য কাউকে আর আমার ইসলাম গ্রহণের জন্যে লাঞ্ছনা অপমান ভোগ করতে হবে না।

পথে যেতে যেতে এই প্রার্থনা করছিলাম, হে দয়াময় প্রভূ! তুমি ইসলামী রাষ্ট্র দাও এবং তার মাধ্যমে আমাদেরকে সত্যিকারের মুসলমানরূপে গড়ে তোল।  আমার স্বজন-পরিজন বিশেষ করে আমার স্নেহশীলা জননীকে লজ্জা ও অপমানের হাত থেকে রক্ষা করতে এছাড়া আর অন্য কোন পথই দৃষ্টি গোচর হচ্ছে না।  অন্তত আমার স্নেহশীলা জননীর মুখের দিকে চেয়ে তুমি আমার এই প্রার্থনা কবুল কর। (চলবে)

১ম পর্ব    ২য় পর্ব য় পর্ব  ৪র্থ পর্ব ৫ম পর্ব ৬ষ্ঠ পর্ব ৭ম পর্ব   ৮ম পর্ব  ৯ম পর্ব ১০ম পর্ব

Related Post