নামাযের প্রস্তুতি

নামাযের প্রস্তুতি

অজু করার দৃশ্য

প্রিয় পাঠক! গত পর্বে আমরা নামাযের গুরুত্ব ও ফযিলত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সংক্ষেপে এতটুকু বলতে হয়, যে

ইসলামে নামাযের গুরুত্ব অপরিসীম। নামায ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ। বিচার দিবসে সর্বপ্রথম নামাযের হিসাব হবে। যদি সালাত বা নামায নামক ইবাদত গৃহীত হয়, তবে সকল ইবাদত গৃহীত হবে, আর নামায গৃহীত না হলে কোন আমলই গৃহীত হবে না। এখন আমরা মূল আলো

চনায় চলে যাচ্ছি: নামাযের প্রস্তুতি নামায পড়ার পূর্বে মন-মানসিকা এমনভাবে তৈরি করতে হবে যে আমি কার দরবারে উপস্থিত হতে যাচ্ছি। আমি উপস্হিত হতে যাচ্ছি বিশ্বজাহানের প্রতিপালক মহান স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সমীপে। তিনি যেমন বড় তাঁর মাহাত্ম্যও তেমন বড়। তাই আমাদেরকে মহান আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর পূর্বে নিজেকে সুন্দর শালীনভাবে তৈরি করতে হবে। আমরা কোন বিশেষ অনুষ্ঠানে যাওয়ার পূর্বে যেভাবে পরিষ্কার ও সুন্দর পোশাক পরিধান করে যাই, ঠিক তেমনিভাবে আল্লাহর দরবারে দাঁড়ানোর পূর্বে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে সুন্দর পোশাক পরিধান করতে হবে। এই মর্মে মহান আল্লাহ ঘোষণা করছেন;

يابنى ءادم خذوا زينتكم عند كل مسجد (الأعراف : ৩১)

হে আদম সন্তান! প্রত্যেক নামাযের পূর্বে তোমরা সৌন্দর্য গ্রহণ করো। (সূরা আ‘রাফ: ৩১) তেমনিভাবে প্রত্যেক নামাযের পূর্বে যারা নিজেদেরকে তৈরি করে রাখেন তাদের সম্পর্কে বুখারী মুসলিমের হাদীসে বলা হয়েছে; যে কিয়ামতের দিন সাত প্রকারের লোককে আরশের ছায়াতলে স্হান দেওয়া হবে যেদিন অন্য কোথাও ছায়া থাকবে না। তন্মধ্যে তৃতীয় নম্বরে ঐব্যক্তি যার অন্তর সর্বদা মসজিদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। অর্থাৎ নামাযের পূর্বেই প্রস্তুতি গ্রহণ করে। সাহাবায়ে কেরামগণ (রা.) সর্বদা নামাযের পূর্বেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। তাঁরা দূর-দূরান্ত হতে মসজিদে হেঁটে হেঁটে আসতেন। রাসূল (সা.)-এর হাদীসে তাদের জন্য সুসংবাদ এসেছে, বলা হয়েছে তাদের প্রত্যেকের জন্য হজ্জ ও ওমরার সাওয়াব রয়েছে। আবু উমামা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন; রাসূল (সা.) বলেছেন; যে ব্যক্তি পবিত্র পরিচ্ছন্ন হয়ে পায়ে হেঁটে মসজিদে গিয়ে জামাতে নামায পড়লো, সে যেন পবিত্র হজ্জের সমান সাওয়াব পেল, আর যে ব্যক্তি নফল নামাযের দিকে অগ্রসর হলো, সে যেন ওমরার সমান সাওয়াব পেল। (আবু দাউদ) সহিহ আল জামে, লিল আলবানী; নামাযের পূর্বপ্রস্তুতির মধ্যে অন্যতম হলো অযু করা। আমরা অযু করার বিধান জানার পূর্বে অযুর ফযীলত সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস শুনবো, ইনশা আল্লাহ;

অযু করার ফযীলত:

১) অযু গুনাহ মাফের কারণ: যে ব্যক্তি উত্তমভাবে অযু করবে, তার শরীর থেকে সমস্ত গুনাহ বের হয়ে যাবে, এমনকি নখের নিচ হতেও। (মুসলিম)

২।  অযু কিয়ামতের দিন পরিচয়ের ওসিলা হবে: নুয়াইম মুজমির (রা.) বলেন, আমি আবু হুরায়রা (রা.)-এর সঙ্গে মসজিদের ছাদে আরোহন করলাম। তখন আবু হুরায়রা (রা.) অযু করলেন, অতঃপর বললেন; আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি; যে কিয়ামতের দিন আমার উম্মতকে অযুর উজ্জ্বলতা দেখে দেখে ডাকা হবে, সুতরাং তোমরা তোমাদের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করো। (বুখারী ও মুসলিম)

৩। অযুর পরে দোয়া পড়ার ফযীলত: যে ব্যক্তি উত্তমরূপে অযু করার পর এই দোয়াটি পাঠ করবে; আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকালাহু ওয়াআশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়ারাসূলুহ। (মুসলিম) তিরমিযী শরীফে উপরের দোয়াটির সঙ্গে নিম্নের দোয়াটি বর্ণিত হয়েছে: আল্লাহুম্মায আলনি মিনাত্তাওয়াবীনা ওয়াযআলনী মিনাল মুতাতাহহিরীন। তার জন্য জান্নাতের সকল দরজা খোলে দেওয়া হবে, যে দরজা দিয়ে চাইবে সেই দরজা দিয়েই প্রবেশ করতে পারবে। পবিত্রতা হলো নামাযের পূর্ব শর্ত, আর এটি দু‘ভাবে অর্জন করতে হয়। প্রথমত: অযু দ্বিতীয়ত: তায়াম্মুম আসুন এবার আমরা নামাযের পূর্ব প্রস্তুতির গুরুত্বপূর্ণ আমল অযু করার নিয়ম সম্পর্কে আলোচনা শুনি। নামাযের পূর্বে পরিপূর্ণরূপে অযু করাঃ “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম-আমি নামাযের জন্য পবিত্রতা লাভের ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে ওযু করছি ” মনে মনে এই নিয়ত করে ওজু শুরু করতে হবে। প্রথমে দু‘হাত কব্জি পর্যন্ত তিনবার ধৌত করার পর, মুখে ও নাকে তিনবার পানি দিয়ে কুলি করবে ও নাক ঝাড়বে, অতঃপর মুখমণ্ডল  ধৌত করবে। মুখের পরিধি হলো: (কপালের উপর চুল গজানোর স্হান থেকে নিয়ে দাড়ির নিম্নভাগ, এবং এক কান থেকে নিয়ে অপর কান পর্যন্ত), এরপর দু’হাতের আঙ্গুলের শুরু থেকে কনুই পর্যন্ত তিন বার ধৌত করবে। প্রথমে ডান হাত অতঃপর বাম হাত। আবার নতুন করে দু’হাত পানি দিয়ে ভিজিয়ে তা দ্বারা মাথা মাসেহ্‌ করবে। দু‘হাত মাথার অগ্রভাগ থেকে নিয়ে পিছন দিকে ফিরাবে অতঃপর অগ্রভাগে নিয়ে এসে শেষ করবে। তারপর দু‘কান মাসেহ্‌ করবে। দু‘হাতের দুই তর্জনী কানের ভিতরের অংশ এবং দু‘বৃদ্ধাঙ্গলী দিয়ে বাহিরের অংশ মাসেহ্‌ করবে। এর জন্য নতুনভাবে পানি নেয়ার দরকার নেই। উল্লেখ্য অনেকে হাতের পিঠ দিয়ে ঘাড় বা গর্দান মাসেহ করে থাকেন। এই বিষয়ে হাদীসে কোন বক্তব্য পাওয়া যায় না। বরং গর্দান মাসেহকে বিদআত বলা হয়েছে। অতঃপর দু‘পা টাখনুসহ তিনবার ধৌত করবে। প্রথমে ডান পা, তারপর বাম পা। ওজু শেষে আকাশের দিকে তাকিয়ে কালিমা শাহাদতসহ দোয়া পড়লে জান্নাতের সকল দরজাই খোলা থাকবে। এই বিষয়ে আমরা ইতোপূর্বে অযুর ফযীলত বিষয়ক হাদীসে আলোচনা করেছি।

‏عن عمر بن الخطاب رضي اله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم من توضأ فأحسن الوضوء ثم رفع نظره إلى السماء فقال أشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له وأشهد أن محمدا عبده ورسوله فتحت له ثمانية أبواب الجنة يدخل من أيها شاء‏ (رواه أحمد)

অজুর শেষে এই দোয়াটি পাঠ করবেন: ‘আশহাদুআল-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা-শারীকালাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রাসূলুহু। ” এই নিয়মেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অযু করতেন। আলোচনার বাকী অংশ (৬ মিনিট) এবার আসুন পবিত্রতার অর্জনের দ্বিতীয় পদ্ধতি তায়াম্মুম সম্পর্কে আলোচনা শুনি; সম্মানিত দর্শক-শ্রোতা আল্লাহর প্রশংসা করতঃ বলছি, যে, আমাদের জীবন বিধান হলো সহজ ও সরল। এবং এই বিধান প্রত্যেকটি মুসলিমকে সাহায্য সহযোগিতা করে। আর এই দ্বীনের ভিত্তি হলো নামায, যা আদায় করতে প্রয়োজন হয় অযু বা পবিত্রতার। সুতরাং যদি কেউ শরীয়ত সমর্থিত ওজরের কারণে পানি ব্যবহার করতে অপারগ হয় কিংবা পানি না পায়, তখন অযুর বিকল্প হিসেবে তাকে তায়াম্মুমের সাহায্যে পবিত্রতা অর্জন করতে হয়। আর এই তায়াম্মুমের জন্য আল্লাহ দয়াপরবশ হয়ে আমাদের জন্য মাটি ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন। পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করতে হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: মাটি আমার জন্য পবিত্র করা হয়েছে। (হাদীসটি ইমাম আহমদ ও বায়হাকী হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন) এই মর্মে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন; সুতরাং তোমরা পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করো, (আর তা হলো) প্রথমত মুখ মাসেহ অতঃপর হাত মাসেহ করা। (সূরা মায়েদা: ৬) আর যদি মাটিও না পাওয়া যায়, তাহলে মাটি জাতিয় বস্তু যেমন পাথর, বালু, জলাভূমি বা পাথর জাতিয় বস্তু দ্বারা তায়াম্মুমের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। মহান আল্লাহ বলছেন; আল্লাহ কারো উপর সাধ্যে বাইরে কোন বোঝা চাপিয়ে দেন না। (সূরা বাকারা: ২৮৬) এবার আমরা তায়াম্মুম করার পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করবো ইনশা আল্লাহ তায়াম্মুম করার পদ্ধতি: প্রথমত: নিয়ত করতে হবে, মুখে উচ্চারণ করার প্রয়োজন নাই, শুধু মনে মনে সংকল্প করবে যে, আমি ছোট অথবা বড় নাপাকী থেকে পবিত্রতা অর্জনের জন্য তায়াম্মুম করছি। দ্বিতীয়ত: দুই হাত মাটিতে মেরে হালকাভাবে ঝেড়ে পুরো মুখ একবার মাসেহ করতে হবে। তৃতীয়ত: পুনরায় দুই হাত মাটিতে মেরে দুনো হাতের কব্জিসহ মাসেহ করতে হবে। উল্লেখ্য অনেকেই দুনো হাতের কনুই পর্যন্ত মাসেহ করার কথা বলেন বা করেন, যা কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। পবিত্র কুরআনে ও হাদীসে হাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর শুধু হাত উল্লেখ করলে কব্জি পর্যন্ত বুঝায়। যেমন কোন পুরুষ কিংবা মহিলা যদি চুরি করে, তাদের শাস্তির স্বরূপ কুরআনে হাত কাটার কথা উল্লেখ হয়েছে। আর সমস্ত উলামায়ে কেরাম একমত যে, চোরের শাস্তি হলো কব্জি পর্যন্ত হাত কাটা।

 

 

 

Related Post