অন্যের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করা

অন্যের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করা

অন্যের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করা

প্রিয় মুসলিম ভাই ও বন্ধুগণ! আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সুন্দর নামসমূহের মধ্যে দুটো নাম হল- আর রহমান ও আর রহীম। এর অর্থ হল, পরম দয়াময় ও অতি দয়ালু।

‘আর রাহমান’ বা পরম দয়াময় বলতে ব্যাপক দয়া ও করুণাকে বুঝানো হয়। যে দয়া-করুণায় ইহজগতে কাফির, মুশরিক ও মুমিন সকলেই এবং পরজগতে কেবল মুমিনরা অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে ‘আর রহীম’ বলতে এমন দয়া ও করুণাকে বুঝায়, যা শুধু পরকালে মুমিনদের জন্য নির্দিষ্ট থাকবে। অধিকাংশ আলেম-উলামার মত এটাই।

আমরা আল্লাহ তাআলার রহমত দ্বারা পরিবেষ্টিত। আল্লাহর অগণিত রহমত ও করুণা আমাদের গোটা অস্তিত্বকে ছেয়ে আছে। আর আল্লাহর এ রহমতকে প্রতিরোধ করার কেউ নেই। সাথে সাথে আল্লাহর রহমত রুদ্ধ হয়ে গেলে তা বিমুক্ত করারও কেউ নেই। একমাত্র আল্লাহ তাআলাই সকল রহমত ও করুণার অধিপতি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :

مَا يَفْتَحِ اللَّهُ لِلنَّاسِ مِنْ رَحْمَةٍ فَلَا مُمْسِكَ لَهَا وَمَا يُمْسِكْ فَلَا مُرْسِلَ لَهُ مِنْ بَعْدِهِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

‘আল্লাহ মানুষের জন্য যে রহমত উন্মুক্ত করে দেন, তা আটকে রাখার কেউ নেই। আর তিনি যা আটকে রাখেন, তারপর তা ছাড়াবার কেউ নেই। আর তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (সূরা আল ফাতির : ২)।

ইমাম শানকীতি রহ. বলেন, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ আয়াতে রহমত বলতে তার ব্যাপক ও বিশাল রহমত বুঝিয়েছেন, যা দুনিয়া ও আখিরাতকে অন্তর্ভুক্ত করে আর দুনিয়ার সকল সৃষ্টিকে শামিল করে’। আর এ অবারিত রহমতের একটি নিদর্শন হল বৃষ্টি। আল্লাহ তাআলা বলেন :

فَانْظُرْ إِلَى آَثَارِ رَحْمَةِ اللَّهِ كَيْفَ يُحْيِي الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِها

‘অতএব তুমি আল্লাহর রহমতের চি‎হ্নসমূহের প্রতি দৃষ্টি দাও। কিভাবে তিনি যমীনের মৃত্যুর পর তা জীবিত করেন’। (সূরা আর রূম: ৫০)

এমনিভাবে আল্লাহ তাআলা আল কুরআনের অসংখ্য স্থানে বৃষ্টিকে তাঁর রহমত বলে উল্লেখ করেছেন, যা মানুষ, পশু-পাখী, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী সকলেরই সমানভাবে উপকার করে।

আল্লাহ তাআলা তাঁর রহমতের ব্যাপকতা সম্পর্কে বলেন:

وَرَحْمَتِي وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ فَسَأَكْتُبُهَا لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَالَّذِينَ هُمْ بِآيَاتِنَا يُؤْمِنُونَ

‘আর আমার রহমত সব বস্তুকে পরিব্যাপ্ত করেছে। সুতরাং আমি তা লিখে দেব তাদের জন্য যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যাকাত প্রদান করে। আর যারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি ঈমান আনে’ (সূরা আল আরাফ: ১৫৬)।

অতএব দুনিয়ার কোনো কিছুই আল্লাহ তাআলার রহমত থেকে বঞ্চিত নয়। সব কিছু তাঁর রমহত-দয়া-করুণা-অনুগ্রহের সমুদ্রে ডুবে আছে।

কিন্তু আখিরাত বা পরকালে এমন হবে না। সেখানে শুধু আল্লাহভীরু-মুত্তাকীগণ রহমত লাভে সক্ষম হবে। এ কথাটাই তিনি উক্ত আয়াতে এভাবে বলেছেন:

فَسَأَكْتُبُهَا لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ

‘সুতরাং আমি তা লিখে দেব তাদের জন্য যারা তাকওয়া অবলম্বন করে’।

উপস্থিত ঈমানদার ভাইয়েরা! আমরা পরম দয়াময় অতি দয়ালু আল্লাহর বান্দা। তিনি চান আমরা যেন একে অপরের প্রতি রহম করি। সকল সৃষ্টির প্রতি দয়া-মায়া-করুণা-অনুকম্পা প্রদর্শন করি।

ইমাম আহমাদ ও তাবারানী রহ. বর্ণিত বিশুদ্ধ সনদে ও নির্ভরযোগ্য সুত্রে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা মিম্বরে দাঁড়ানো অবস্থায় বলেন :

اِرْحَمُوْا تُرْحَمُوْا وَاغْفِرُوا يُغْفَرُ لَكُمْ

‘তোমরা দয়া করো, দয়া পাবে। ক্ষমা করো, ক্ষমা পাবে’ (আহমদ)।

সকল মানুষের প্রতি, সকল প্রাণীর প্রতি দয়া মায়া ও রহম করার জন্য ইসলামের নবী আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। সৃষ্টির প্রতি রহম বা দয়া করলে স্রষ্টার দয়া-করুণা-রহম লাভ করা যায়। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,রাসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

الرَّاحِمُوْنَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمَنُ تَبَارَكَ وَتَعَالَىْ : اِرْحَمُوْا مَنْ فِيْ الْأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِيْ السَّمَاءِ

রহমকারীদের প্রতি মহান দয়াময় আল্লাহ রহম ও দয়া করেন। দুনিয়াতে যারা আছে তাদের প্রতি তোমরা দয়া করো,তাহলে আসমানে যিনি আছেন,তিনি তোমাদের রহম করবেন’ (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী ও হাকেম)।

জারীর ইবনে আবদুল্লাহ রাযি. থেকে বর্ণিত,সহীহ মুসলিমে এসেছে,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

مَنْ لَا يَرْحَمِ النَّاسَ لَا يَرْحَمْهُ اللهُ عَزَّ وَجلَّ

‘যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি রহম করে না আল্লাহ তাআলা তার প্রতি রহম করেন না’ (মুসলিম)।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে সৃষ্টি করেছেন উত্তম আকৃতিতে। তিনি তাকে অন্যান্য সমস্ত সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে :

لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ

‘নিশ্চয় আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি উত্তম গঠনে’ (সূরা আত তীন:৪)।

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে :

وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى كَثِيرٍ مِمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا

‘আর আমি তো আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি এবং আমি তাদেরকে স্থলে ও সমুদ্রে বাহন দিয়েছি এবং তাদেরকে দিয়েছি উত্তম রিযক। আর আমি যা সৃষ্টি করেছি তাদের থেকে অনেকের ওপর আমি তাদেরকে অনেক মর্যাদা দিয়েছি’ (সূরা আল ইসরা:৭০)।

মানুষ ছাড়া পৃথিবীতে আর যা কিছু আছে সবই মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা বলেন :

هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا

তিনিই পৃথিবীতে যা আছে সব তোমাদের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করেছেন।(সূরা আল বাকারা: ২৯)

কাজেই গোটা পৃথিবীটাই তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষের জন্য রহমত-দয়া-করুণা ও অনুগ্রহ হিসেবে।

এমনকি দিন রাতের আবর্তনও মানুষের জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে একটি রহমত। তিনি বলেন :

وَمِنْ رَحْمَتِهِ جَعَلَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ لِتَسْكُنُوا فِيهِ وَلِتَبْتَغُوا مِنْ فَضْلِهِ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ

‘আর তাঁর রহমতে তিনি তোমাদের জন্য রাত ও দিন সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা বিশ্রাম নিতে পার এবং তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যেন তোমরা শোকর আদায় করতে পার’ (সূরা আল কাসাস: ৭৩)।

এভাবে তিনি মানুষের প্রতি রহম করেছেন আর তার রাসূলকে তিনি মানুষের প্রতি দয়া করতে আদেশ করেছেন। আল্লাহ তাআলা তার রাসূলকে বলেন :

فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ

‘অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতের কারণে তুমি তাদের জন্য নম্র হয়েছিলে। আর যদি তুমি কঠোর স্বভাবের, কঠিন হৃদয়সম্পন্ন হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে পড়ত (সূরা আলে ইমরান : ১৫৯)।

শুধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথাই নয়। আল্লাহ তাআলা রাসূলের সাহাবীদেরও প্রশংসা করেছেন পরস্পরে রহম বা দয়া চর্চাকারী বলে। ইরশাদ হয়েছে :

مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ

‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং তার সাথে যারা আছে তারা কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর কিন্তু পরস্পরের প্রতি সদয়’ (সূরা আল ফাতহ : ২৯)।

সম্মানিত ভাই ও বন্ধুগণ! আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় রাসূলের মাধ্যমে আমাদের জন্য যে ইসলাম পাঠিয়েছেন তার পুরোটাই হলো বিশ্ববাসীর জন্য রহমত ও অনুগ্রহ। তিনি বলেন:

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ

আর আমি তো তোমাকে সৃষ্টিকুলের জন্য রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি (সূরা আল আম্বিয়া: ১০৭)।

প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে শুধু মুসলমানদের জন্য রহমতস্বরূপ ছিলেন তা নয় রবং তিনি বিশ্ববাসীর সকলের জন্যই রহমত। সকলের জন্য সুসংবাদ বহন করে এনেছেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন :

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

‘আর আমি তো কেবল তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না’ (সূরা সাবা: ২৮)।

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও বলেছেন,তাকে সমগ্র মানুষের কল্যাণের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। সহীহ বুখারীতে জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রাযি. থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে :

وَكَانَ النَّبِىُّ يُبْعَثُ إِلَىَ قَوْمِهِ خَاصَّةً، وَبُعِثْتُ إِلَى النَّاسِ عَامَّةً

‘অন্যান্য নবীদের একটি নির্দিষ্ট জাতির কাছে প্রেরণ করা হত কিন্তু আমাকে সমগ্র মানব জাতির জন্য পাঠানো হয়েছে’ (বুখারী)।

সহীহ মুসলিমে আবূ মূসা আল আশআরী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ لَا يَسْمَعُ بِيْ رَجُلٌ مِنْ هَذِهِ الْأُمَّةِ يَهُوْدِيٌّ وَلَا نَصْرَانِيٌّ ثُمَّ لَا يُؤْمِنُ بِيْ إِلَّا دَخَلَ النَّارَ

‘যার হাতে আমার প্রাণ তার কসম, এ মানব জাতির যে কেউ ইহূদী হোক বা খ্রিস্টান, আমার আগমনের কথা শুনবে কিন্তু আমার প্রতি ঈমান আনবে না সে অবশ্যই জাহান্নামে যাবে’ (মুসলিম)।

আল্লাহ তাআলা তার দ্বীনকে পরিপূর্ণ করার মাধ্যমে আমাদের ওপর দয়া ও অনুগ্রহ করেছেন। তিনি দীনকে অনুসরণ করা আমাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন, কঠিন করেননি। এটাও আমাদের প্রতি তার একটি বিশাল রহমত। তিনি বলেছেন :

وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ

দ্বীনের ব্যাপারে তিনি তোমাদের ওপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেননি’ (সূরা আল হজ : ৭৮)।

এভাবেই তিনি তাঁর বান্দাদের প্রতি রহম, করম, দয়া, মায়া, অনুগ্রহ করেছেন। তাই আমাদেরও উচিত এই রহমতের গুণে নিজদেরকে গুণান্বিত করে তোলা। সহীহ বুখারীতে আনাস ইবনে মালেক রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :

يَسِّرُوْا وَلَا تُعَسِّرُوْا، وَبَشِّرُوا وَلَا تُنَفِّرُوا

‘তোমরা সহজ করো, কঠিন করো না। তোমরা সুসংবাদ দাও, ঘৃণা সৃষ্টি করো না’ (বুখারী)।

এক গ্রাম্য বেদুইন যখন মসজিদে পেশাব করেছিল, তখন তাকে ক্ষমা করে দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন :

إِنَّمَا بُعِثْتُمْ مُيَسِّرِيْنَ

সহজ ও দয়া-অনুগ্রহ করার জন্যই তোমাদেরকে পাঠানো হয়েছে

সুপ্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তাআলার রহমত, দয়া-অনুগ্রহ হল ব্যাপক ও বিস্তৃত। সকল মানুষই তাঁর দয়া- অনুগ্রহ ভোগ করে। ঈমানদারগণ দুনিয়ায়ও তার রহমত প্রাপ্ত হয়ে থাকে এবং আখেরাতেও প্রাপ্ত হবে আর কাফিররা শুধু দুনিয়াতে তার রহমত ও অনুগ্রহের ভাগী হয়। আখেরাতে তারা কোনো রহমত প্রাপ্ত হবে না। এ কথাই আল্লাহ তাআলা বলেছেন :

وَرَحْمَتِي وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ فَسَأَكْتُبُهَا لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَالَّذِينَ هُمْ بِآيَاتِنَا يُؤْمِنُونَ

‘আর আমার রহমত সব বস্তুকে পরিব্যাপ্ত করেছে। সুতরাং আমি তা লিখে দেব তাদের জন্য যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যাকাত প্রদান করে। আর যারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি ঈমান আনে’ (সূরা আল আরাফ: ১৫৬)। এ আয়াতে, ‘লিখে দেব’ বলতে আখিরাত বা পরকালকে বুঝানো হয়েছে।

সম্মানিত উপস্থিতি! আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেমন তাঁর বান্দাদের প্রতি দয়াময়, পরম দয়ালু, তেমনি তাঁর রাসূলকে মুমিনদের প্রতি দয়ার্দ্র করে পাঠিয়েছেন। নিজদের তিনি বলেন :

لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ

‘নিশ্চয় তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের নিকট একজন রাসূল এসেছেন, যা তোমাদেরকে পীড়া দেয়, তা তার জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, পরম দয়ালু’। (সূরা আত-তাওবা: ১২৮)

তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার এ বাণীর বাস্তবায়ন আমরা দেখতে পাই বহুভাবে তাঁর সীরাত বা জীবন চরিতে। তিনি যখন তায়েফবাসীকে ইসলামের দাওয়াত দানের জন্য সেখানে গিয়েছিলেন, তখন তায়েফের লোকেরা তাঁকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করেছিল। অতঃপর পাহাড়ের দায়িত্বশীল ফেরেশ্তারা এসে তাদের শাস্তি দিতে অনুমতি চাইলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তাদের প্রতি দয়া পরবশ হলেন। তিনি তাদেরকে শাস্তি দিতে অনুমতি দিলেন না। এমনিভাবে তিনি বহু শত্রুর প্রতি দয়া করে তাদের শাস্তি থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। মানব ইতিহাসে এমন অন্য কাউকে দেখা যাবে না যিনি শত্রুর প্রতি এমন দয়া ও রহমতের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

শুধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনেই নয়, তাঁর সাহাবীদের জীবন-চরিতও ছিল রহম ও দয়া-মায়ায় ভরপুর।

হযরম উমর ও এক বৃদ্ধার ঘটনা:

উমর রাযি. মদীনার এক অন্ধ বৃদ্ধার ঘরে যেতেন। তার সেবা করতেন। তার পায়খানা-পেশাব পরিস্কার করতেন। একদিন তিনি দেখেন, আগে এসে এ কাজটি কে যেন সম্পন্ন করে গেছে। খবর নিয়ে দেখেন, আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. এসেছিলেন। তিনি তার আগে এসে বৃদ্ধার ঘর-বিছানা পরিস্কার করে গেছেন।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে তাঁর প্রিয় নবীর অনুকরণে মানুষের প্রতি রহম, দয়া, মায়া-মমতা ও করুণা করার তাওফীক দান করুন।

সহীহ মুসলিমে এসেছে আবূ হুরাইরা রাযি. থকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِي تَوَادِّهِمْ وَتَرَاحُمِهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ، مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى

‘ভালোবাসা, দয়া, সহানুভূতির দিক দিয়ে মুমিনদের দৃষ্টান্ত হল একটি দেহের ন্যায়। দেহের একাংশ আক্রান্ত হলে সমগ্র দেহ জ্বরগ্রস্থ ও নিদ্রাহীন হয়ে পড়ে’ (মুসলিম)।

এমনিভাবে একজন মুসলিম যখন বিশ্বের যে কোনো স্থানে আক্রান্ত হয়, বিপদে পড়ে, তখন অন্য সকল মুসলিমের কর্তব্য হল, তার প্রতি রহম ও ইহসান করা। তার ব্যথায় ব্যথিত হওয়া। তার সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আজ আমাদের মধ্যে এ গুণটি একেবারে অনুপস্থিত। বরং এর উল্টো বিষয় আমরা লালন করে থাকি। বিশ্বের কোনো স্থানে কাফির-মুশরিক কর্তৃক মুসলিমরা জুলুমের শিকার হলে আমরা জালেমের পক্ষ অবলম্বন করি।

আল্লাহ আমাদের হিদায়েত দান করুন। সকল মুসলমানকে তাদের মধ্যে পারস্পারিক রহম, মায়া-মমতা, করুণা ও ইহসান করার তাওফীক দান করুন।

সম্মানিত উপস্থিতি! ইসলাম শুধু মানুষের প্রতি দয়া ও ইহসানের আদেশ করে ক্ষান্ত হয়নি মানুষ ছাড়া অন্যান্য পশু-পাখির প্রতিও রহম ও দয়া প্রদর্শন করতে ইসালাম আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছে।

সহীহ মুসলিমে এসেছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :

إِنَّ اللهَ كَتَبَ الْإِحْسَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ، فَإِذَا قَتَلْتُمْ فَأَحْسِنُوَا الْقِتْلَةَ، وَإِذَا ذَبَحْتُمْ فَأَحْسِنُوا الذَّبْحَ، وَلْيُحِدَّ أَحَدُكُمْ شَفْرَتَهُ، فَلْيُرِحْ ذَبِيْحَتَهُ

‘প্রতিটি বস্তুর প্রতি দয়া-মায়া, ইহসান করা আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য ফরয করেছেন। তাই তোমরা যখন কোনো পশু হত্যা করবে তখন মায়া-মমতার সাথে সুন্দরভাবে হত্যা করবে। যখন জবেহ করবে তখন সুন্দরভাবে জবেহ করবে। অস্ত্র ধারাল করে নেবে আর জবেহ করা পশুটির যেন আরাম হয়, সে দিকে লক্ষ রাখবে’ (মুসলিম)।

এ হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পশু হত্যা বা জবেহ করার সময়ও তাদের প্রতি দয়া ও মমতা দেখাতে নির্দেশ দিয়েছেন। তারা যেন কষ্ট না পায় সে ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।

সহীহ বুখারীতে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

دَخَلَتْ امْرَأَةٌ النَّارَ فِيْ هِرَّةٍ حَبَسَتْهَا حَتَّى مَاتَتْ، فَلَا هِيَ أَطْعَمَتْهَا وَلَا هِيَ تَرَكَتْهَا تَأْكُلُ مِنْ خَشَاشِ الْأَرْضِ

‘একটি মহিলা একটি বিড়ালের কারণে জাহান্নামে গিয়েছে। সে তাকে আটকে রেখেছিল ফলে সে মারা যায়। সে তাকে খাবারও দেয়নি, আবার ছেড়েও দেয়নি যাতে সে জমিনের কীটপতঙ্গ খেয়ে বাঁচতে পারে’ (বুখারী)।

এ মহিলা বিড়ালটির প্রতি দয়া-মায়া ও রহম করেনি। এ কারণে তাকে জাহান্নামে যেতে হয়েছে। সহীহ বুখারীতে আরো এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: এক ব্যক্তি পিপাসার্ত কুকুরকে পানি পান করানোর কারণে জান্নাতে প্রবেশ করেছে।

পশুদের প্রতি দয়া-মায়া প্রদর্শন এবং তাদের অধিকার রক্ষার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পশুদের মধ্যে লড়াই বাধানো নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। হাদীসে এসেছে :

أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهَى عَنْ التَّحْرِيْشِ بَيْنَ الْبَهَائِمِ

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীব-জন্তুর মধ্যে লড়াই বাধাতে নিষেধ করেছেন (আবু দাউদ )।

 মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে রাসূল (সা.)-এর আদর্শ গ্রহণ করে জীবন পরিচালনা করার তাওফীক দান করুন। আমীন

 

Related Post