সুদ বিপদজনক মহামারী

সুদ বিপদজনক মহামারী

সুদ বিপদজনক মহামারী

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন ঃ

الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا

“যারা সুদ খায়, তারা তার মতই দাঁড়িয়ে যাবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, বেচা-কেনা সুদের মতই। অথচ আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।” সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৭৫
আল্লাহ তাআলা ব্যবসা-বাণিজ্যকে বৈধ বলে ঘোষণা করেছেন। অবশ্য কোন ব্যবসা বৈধ নয় তা তাঁর রাসূলের মাধ্যমে আমাদেরকে জানিয়েছেন। কিন্তু আল-কুরআন শুধু সুদের কথাই উল্লেখ করেছে। অন্যান্য অবৈধ কোন ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা উল্লেখ করেনি। এর কারণ হল ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেনের ক্ষেত্রে সুদই হল নিকৃষ্টতম হারাম। যত হারাম উপার্জন আছে তার মধ্যে সুদ হল সবচেয়ে বেশি হারাম।
সুদ কি পদ্ধতিতে হতে পারে সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, সেটা ঋণ পদ্ধতিতে হতে পারে। নগদ বিনিময়ে হতে পারে। আবার লেনদেনে যে কোন অতিরিক্ত মূল্যও হতে পারে, যেমন অবিকৃত স্বর্ণের বিনিময়ে সম-পরিমাণ স্বর্ণের অলংকার গ্রহণ।
মূসা আ. এর শরীয়তেও সুদ ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু অবাধ্য ইহুদি জাতির লোকেরা এ সুদকে বৈধ করে নিয়েছে। এ সুদের মাধ্যমে তারা এখন বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
ইসলাম এসে সাথে সাথেই সুদকে হারাম করেনি। তার নিয়মমাফিক সে ধীরে ধীরে সকল বিধি-বিধান চালু করেছে। যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ করা হয়েছে নবুয়তের অষ্টম বছরে। এর পূর্বে শুধু রাতে নামায পড়ার বিধান ছিল। পরে তা রহিত করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের বিধান দেয়া হল। এমনিভাবে মদ হারাম ঘোষিত হয়েছে হিজরতের তৃতীয় বছরে, অর্থাৎ নবুওয়াত প্রাপ্তির ষোলো বছর পরে। সুদও সে রকমই হিজরতের পরে নিষিদ্ধ হয়েছে। ইসলামের শুরুতে নয়।

ঋণের আদান-প্রদানে সুদ ঃ
মানবসমাজে যে সকল সুদ প্রচলিত আছে তার মধ্যে ঋণের মাধ্যমে সুদের লেনদেন সর্ব শীর্ষে। এর পদ্ধতি হল ঋণ দাতা এ শর্ত করে যে, ঋণের বিনিময়ে সে লাভবান হবে। সেটা ঋণের টাকার উপর টাকা বৃদ্ধি করে হতে পারে বা অন্য যে কোন সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে হতে পারে। উদাহরণ, কোন ব্যক্তি অন্য একজনকে দশ হাজার টাকা ঋণ দিল। এর বিনিময়ে ঋণ দাতা ঋণ গ্রহীতার বাড়িতে বসবাস করবে এবং ঋণের টাকা পরিপূর্ণভাবে ফেরত নেবে। ঋণ প্রদানের বিনিময়ে এ ধরনের যে কোন সুবিধা গ্রহণ সুদের মধ্যেই গণ্য। এটা ‘রেবা আল-কারজ’ বলে পরিচিত। এটা হল সর্ব নিকৃষ্ট সুদ। মুসলিম উম্মার সকল ইমাম এটা হারাম হওয়ার বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেছেন।
ঋণ গ্রহীতা যে ঋণ নিয়েছেন তার বেশি আদায় করা যেমন সুদ, তেমনি তার কম দেয়াও সুদ। কারণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,

وَإِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوسُ أَمْوَالِكُمْ لَا تَظْلِمُونَ وَلَا تُظْلَمُونَ

“তোমরা যদি (সুদ থেকে) তাওবা কর, তাহলে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই প্রাপ্য। তোমরা জুলুম করবে না এবং তোমাদের উপর জুলুম করা হবে না।” সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৭৯
তোমরা বেশি নিয়ে ঋণ গ্রহীতার উপর জুলুম করবে না। এমনিভাবে ঋণ গ্রহীতা কম দিয়ে তোমাদের প্রতি জুলুম করবে না।
এ আয়াত দ্বারা স্পষ্ট হল, ঋণের চেয়ে বেশি প্রদান যেমন জুলুম বা সুদ তেমনি কম প্রদান করাও সুদ।
যারা কিস্তিতে পণ্য সামগ্রী বিক্রি করে আর তাতে এ শর্ত থাকে যে, যদি কিস্তির টাকা তারিখ মত দেয়া না হয়, তাহলে এত টাকা বেশি আদায় করতে হবে। এ বেশি আদায়ও সুদ বলে গণ্য। এতে কারো দ্বিমত নেই।
কিস্তিতে পণ্য বিক্রি করায় সুদ হয় না। যেমন কেউ এক লক্ষ টাকায় একটি গাড়ি ক্রয় করল। পরে অন্য এক লোকের কাছে তা কিস্তিতে বিক্রি করল। শর্ত দিল যে গাড়িটির মূল্য এক লক্ষ টাকা, তবে কিস্তিতে নিলে প্রতি মাসে এত টাকা বেশি পরিশোধ করতে হবে। টাকার অংক ও সময় যদি নির্ধারণ করে দেয় তাহলে তাতে সুদ হয় না। এতে যদি এক লক্ষ টাকার গাড়িটিতে দু লক্ষ টাকা দাম আদায় হয় তাতেও কোন অসুবিধা নেই।
এমন অনেককে দেখতে পাওয়া যায়, যারা কাউকে ঋণ দেন। এর বিনিময়ে তার বাড়িতে থাকেন অথবা কম মূল্যে ভাড়া থাকেন, কিংবা ঋণ আদায় না করা পর্যন্ত তার গাড়িটি বিনা ভাড়ায় ব্যবহার করে থাকেন। এটা সর্বসম্মতভাবেই সুদ।

সঠিক ঋণ পদ্ধতি ঃ
যদি ঋণ দিয়ে কোন রকম উপকৃত হওয়ার বা ঋণ গ্রহীতা থেকে কোন ধরনের সুবিধা গ্রহণের শর্ত বা নিয়ত না থাকে তাহলে এটা পরিশুদ্ধ ঋণ। যদি ঋণ গ্রহীতা, ঋণ দাতা তাকে উপকার করেছে এর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ঋণ পরিশোধের সময় কিছু বেশি দেয়, তাতে কোন অসুবিধা নেই। এ অতিরিক্ত সম্পদ সুদ বলে গণ্য হবে না।
কারণ কর্জ প্রদান একটি ভাল কাজ। কেউ ভাল কাজ করলে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বা তাকে পুরস্কার দেয়া না জায়েয হতে পারে না।

বীমা বা ইনসিওরেন্স ঃ
বর্তমানে বীমা পলিসি বা ইনসিওরেন্স ব্যাপকভাবে সমাজে চালু আছে। এর পদ্ধতি হল, আপনি বীমা কোম্পানিকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্ধারিত অংকের টাকা জমা দেবেন। শর্ত থাকবে যে, যদি আপনি কোন দুর্ঘটনার পতিত হন, কিংবা আপনার গাড়িটি দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে বীমা কোম্পানিটি টাকা খরচ করে আপনার ক্ষতি পুষিয়ে দেবে। তবে কথা হল, ভবিষ্যতে সে সত্যিই কোন দুর্ঘটনায় পতিত হবে কি না? হলে তাতে কত খরচ হবে ইত্যাদি বিষয় অজ্ঞাত থেকে যায়।
একজন মানুষ যখন অন্য একজন মানুষকে বৈধ পন্থায় যে সম্পদ প্রদান করে তা হতে পারে ঃ পণ্য কেনা-বেচার বিনিময়ে, কিংবা দান করার মাধ্যমে, বা সদকা করে, অথবা উপহার হিসাবে।
কিন্তু বীমার জন্য মানুষ যা প্রদান করে তা এর কোনটির মধ্যেই পড়ে না। কাজেই এটা এমন একটি ঋণ যার বিনিময়ে সুবিধা পাওয়ার নিয়ত করা হয়ে থাকে। শুধু নিয়ত নয়, বরং লিখিতভাবে শর্ত করা হয়। অতএব এটা ‘ঋণ আদান-প্রদানে সুদ’ বলেই গণ্য। আলী রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন ঃ
كل قرض جر منفعة فهو ربا
“যে সকল ঋণ দিয়ে সুবিধা পাওয়া যায় তার সকল কিছু সুদ বলে গণ্য।”
হাদীসটি ইমাম বায়হাকী বর্ণনা করেছেন। সনদ-সূত্রের দিক দিয়ে যদিও হাদীসটি দুর্বল কিন্তু সকল ইমামগণ এটা আমলের যোগ্য বলে মেনে নিয়েছেন।
সকল প্রকার সুদ থেকে মুসলিম ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে অবশ্যই মুক্ত থাকতে হবে। সুদ কম হোক বা বেশি সর্বাবস্থায় তা হারাম।
মুসলিমদের কখনো অমুসলিমদের মত দুনিয়ার সাথে ভোগ-বিলাসের প্রতি আসক্তি প্রকাশ করা উচিত নয়। যারা আখেরাতের বিনিময়ে দুনিয়া কিনে নিয়েছে মুসলিম সমাজ তাদের মত কখনো হতে পারে না। দুনিয়ার লোভ-লালসা, ভোগ-বিলাসের প্রতি সীমাহীন আসক্তি মানুষকে সুদি কারবার করতে উৎসাহ দেয়। অতএব সকলকেই সুদি কাজ-কারবার থেকে তাওবা করতে হবে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন ঃ

 وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّـهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَن يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّـهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَىٰ مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ – أُولَـٰئِكَ جَزَاؤُهُم مَّغْفِرَةٌ مِّن رَّبِّهِمْ وَجَنَّاتٌ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا ۚوَنِعْمَ أَجْرُ الْعَامِلِينَ   

“আর যারা কোন অশ্লীল কাজ করলে অথবা নিজদের প্রতি যুলম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে, অতঃপর তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর আল্লাহ ছাড়া কে গুনাহ ক্ষমা করবে? আর তারা যা করেছে, জেনে শুনে তা তারা বার বার করে না। এরাই তারা, যাদের প্রতিদান তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও জান্নাতসমূহ যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর আমলকারীদের প্রতিদান কতই না উত্তম!” সূরা আলে-ইমরান, আয়াত ১৩৫-১৩৬

Related Post