উত্তম কথা বলার ফজিলত

136136_gif

যে কথা সুন্দর, সে কথায় হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রু“তার লেশমাত্র নেই, যে কথা মানবতার কল্যাণের দ্বার উন্মোচিত করে তাই উত্তম কথা। আর উত্তম কথার মধ্যে সর্বোত্তম কথা কোনটি? মহান আল্লাহ বলেন, ‘তার কথার চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, সৎ কাজ করে এবং বলে আমি (আল্লাহর কাছে) আত্মসমর্পণকারীদের একজন।’ (হা-মীম সিজদাহ : ৩৩)।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর যুগে ঈমান গ্রহণের সাথে সাথেই ঈমানদাররা নিজ নিজ কওমের মধ্যে দাওয়াতি কাজ শুরু করে দিতেন। কখনো কখনো তারা মহানবী সা:-এর কাছ থেকে মোয়াল্লেম চেয়ে নিতেন। আর নবী-রাসূলদের প্রথম ও প্রধান কাজই হলো মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা। রেসালতের দায়িত্ব সম্পর্কে সর্বপ্রথম যে অহি নাজিল হয় তা হলো, ‘হে চাদরাবৃত, উঠুন, সতর্ক করুন। (সূরা মুদ্দাসসির : ১-২)।
অর্থাৎ হে রাসূল আপনি চাদরাবৃত হয়ে শুয়ে থাকবেন না, আপনি গাত্রোত্থান করুন এবং গোটা মানবজাতির কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিন আর দাওয়াত কবুল না করলে তার পরকালীন পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করুন। সূরা ইউসুফে নবীকে তাঁর কাজ সম্পর্কে আল্লাহ বলতে বলেছেন, ‘বলুন, আমার কাজই হলো আল্লাহর দিকে ডাকা’ (১০৮)।
যুগে যুগে নবীদের দাওয়াত : ‘হে দেশবাসী, একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো হুকুমকর্তা নেই’ (সূরা আরাফ)। মহানবী সা: কে দাওয়াতের বিষয়বস্তু সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন’ (সূরা : মুদ্দাসসির ৩)।
দাওয়াত হবে আল্লাহর আনুগত্য, রাসূল সা:-এর অনুসরণ ও আল্লাহর ‘রবুবিয়াত’ (হুকুম) প্রতিষ্ঠার দিকে। এ দাওয়াত কেবল নামাজ, রোজা বা কিছু আমলের আংশিক দাওয়াত নয়, দাওয়াত হবে দ্বীনের পূর্ণাঙ্গ দাওয়াত। পবিত্র কুরআন এ আহ্বানের ভাষা শিখিয়ে দিয়েছে, ‘তোমরা ইসলামের মধ্যে পরিপূর্ণ দাখিল হয়ে যাও’।
তাই দ্বীনের পূর্ণাঙ্গ দাওয়াতকে তিনটি দফায় ভাগ করা যায়
এক : দুনিয়ায় শান্তি ও আখিরাতে মুক্তি পেতে হলে জীবনের সব ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালাকে একমাত্র (হুকুমকর্তা) ও তাঁর রাসূল সা: কে একমাত্র আদর্শ নেতা মেনে নিন।
দুই : আপনি যদি সত্যি তা মেনে নিয়ে থাকেন তাহলে আপনার বাস্তব জীবন থেকে ইসলামের বিপরীত চিন্তা, কাজ ও অভ্যাস দূর করুন এবং আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর বিরুদ্ধে কারো আনুগত্য না করার সিদ্ধান্ত নিন।
তিন : সমাজ থেকে সব ধরনের জুলুম, শোষণ ও অবিচারের অবসান ঘটানোর জন্য নিয়মতান্ত্রিক সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন কায়েম করুন।
আল্লাহকে ‘রব’ ও ‘ইলাহ’ বলে মেনে নেয়ার দাবি মূলত এ তিনটি। কালেমার মাধ্যমে আমরা এ দাবি পূরণের ওয়াদা করি আল্লাহর সাথে। এ জন্য কালেমার তাৎপর্য ও তার অন্তর্নিহিত শক্তি অত্যন্ত ব্যাপক। এ কারণে রাসূল সা: কালেমাকে একটি মহীরুহের সাথে তুলনা করেছেন।যার শিকড় মাটির গভীরে প্রথিত এবং শাখা-প্রশাখা দিগন্ত প্রসারিত। মহানবী সা:-এর উপমা বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ। ঈমানের বীজ রোপিত হয় মুমিনের অন্তরে এবং তা সুশোভিত হয় তার চরিত্র ও কর্মে। আর তার সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে গোটা সমাজে। মুমিনের চরিত্রে ও কর্মে মুগ্ধ হয়ে এবং ঈমানের দাওয়াতে বিমোহিত হয়ে মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে গড়ে তোলে একটি শোষণহীন, ইনসাফপূর্ণ আদর্শ সমাজ। তাই ঈমানের পরিধি মুমিনের কলব (অন্তর) থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। তাই কালেমা কোনো মন্ত্র নয়, কালেমা শুধু অন্তর পরিষ্কারের হাতিয়ারও নয়, কালেমা চিন্তার পরিশুদ্ধি, চরিত্র গঠন ও আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের মূল চাবিকাঠি। কালেমায় আল্লাহকে একমাত্র ‘ইলাহ’ (হুকুমকর্তা) বলে সত্যিকারভাবে মেনে নেয়ার কারণে সাহাবী রা:-দের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন এসেছিল এবং তারা একটি সোনালি সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আরবি ভাষাভাষী কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠী কালেমার অর্থ ও চূড়ান্ত ফলাফল বুঝতে পেরেছিল। এরই ফলে তারা কালেমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং এর প্রচারকে সর্বশক্তি দিয়ে রুখতে চেয়েছিল। আজো যারা কালেমাকে যথার্থ অর্থে গ্রহণ করবে এবং এর প্রচার করবে, চিরাচরিত নিয়মে কায়েমি সুবিধাবাদীগোষ্ঠী সর্বশক্তি দিয়ে তাদের প্রতিহত করতে চাইবে। যদি কেউ কালেমাকে যথার্থ অর্থে গ্রহণ না করে একটি মন্ত্র ভাবেন অথবা হাজারবার সরবে বা নীরবে কালেমা জপ করে শুধু কলবকে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ করার কোশেশ করেন, ইসলামবিরোধী শক্তি তার বিরোধিতা তো করবেই না বরং ক্ষেত্র বিশেষে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবে। তাই ইসলামবিরোধী ও কায়েমি স্বার্থবাদীগোষ্ঠীর বাধা সত্য ও নির্ভেজাল দাওয়াত চেনার একটি সহজ উপায়। ইসলামের দাওয়াত যারা বুঝে শুনে গ্রহণ করবে তারা বলবে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সা: আল্লাহর রাসূল। এ কালেমা একজন মানুষের অন্তরে প্রশান্তি বয়ে আনবে, তার চরিত্রকে নির্মল করবে এবং তার পরকালীন মুক্তির অন্যতম কারণ হবে। আর কালেমাধারীদের সংখ্যাধিক্য ঘটলে সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা হবে। তাই দ্বীনের দাওয়াত মানবতার মহাকল্যাণের দ্বার উন্মোচিত কবে। সামগ্রিক আলোচনায় এটা সুস্পষ্ট হলো যে,
সর্বোত্তম কথা দাওয়াত ইলাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর দিকে আহ্বান।
সর্বোত্তম মানুষ দায়ী ইলাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী।
দাওয়াতের পদ্ধতি : মহান আল্লাহ বলেন, ‘ডাক দাও তোমার প্রভুর দিকে হিকমতের সাথে, সুন্দর সুন্দর কথার মাধ্যমে আর সর্বোত্তম যুক্তি প্রয়োগ করে।’ (সূরা আন নাহল-১২৫)
এ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দাওয়াতের তিনটি কৌশল শিক্ষা দিয়েছেন
এক : হিকমত অর্থাৎ মানুষের মনস্তত্ত্ব, পরিবেশ, গ্রহণ, মতা ইত্যাদি বুঝে দাওয়াত উপস্থাপন।
দুই : সুন্দর সুন্দর কথা অর্থাৎ দাওয়াতের ভাষা হবে প্রাঞ্জল, হৃদয়স্পর্শী ও আন্তরিকতায় ভরপুর।
তিন : সর্বোত্তম যুক্তি অর্থাৎ শক্তির ভাষায় নয়, যুক্তির ভাষায় কথা বলতে হবে।
দাওয়াতদাতার বৈশিষ্ট্য : দ্বীনের দাওয়াতকে মানুষের মধ্যে অতি দ্রুত গ্রহণযোগ্য করতে দাওয়াতদাতাকে কতগুলো মৌলিক গুণের অধিকারী হতে হবে।
এক : পরিশুদ্ধ চিন্তা ও বিশ্বাস,
দুই : ইসলামের স্বচ্ছ জ্ঞান,
তিন : কথা ও কাজের মিল,
চার : ধৈর্য।
এ গুণগুলো একজন দায়ীর মধ্যে একই সাথে পূর্ণমাত্রায় না-ও থাকতে পারে। দাওয়াত দেয়ার পাশাপাশি এ গুণগুলো অর্জনের অব্যাহত প্রচেষ্টা চালাতে হবে আমাদের। এ গুণ ছাড়াও আরো কতগুলো মানবীয় গুণাবলি অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, যে দায়ীর (দাওয়াতদাতা) মান যত ভালো, তার দাওয়াতের কার্যকারিতা তত বেশি। কারণ দায়ী হচ্ছেন দাওয়াতের জীবন্ত প্রতীক। সমাপ্ত

Related Post