মুনাফিকের আলামত

মুনাফিকের আলামত

মুনাফিকের আলামত

সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমে হজরত আবদুল্লাহ ইবন আমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন—‘চারটি খাসলাত এমন যার সবগুলো কারও মধ্যে থাকলে সে খালেস মুনাফিক, আর যার মধ্যে তার কোনো একটি থাকবে সে যতক্ষণ না তা পরিত্যাগ করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকির একটি খাসলাতই থাকবে। (খাসলাত চারটি হচ্ছে এই) যখন তার কাছে আমানত রাখা হয় সে তাতে খিয়ানত করে, যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন কোনো প্রতিশ্রুতি দেয় তা ভঙ্গ করে এবং যখন কারও সঙ্গে ঝগড়া করে গালাগালি করে। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৩৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৮৮)

এ হাদিসে মহানবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চারটি অপগুণকে মুনাফিকির আলামত সাব্যস্ত করেছেন। বোঝানো উদ্দেশ্য, যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করে তার মধ্যে এ চারটি গুণ থাকতে পারে না, থাকা উচিত নয়। কাজেই কারও মধ্যে এগুলো পাওয়া গেলে আইনের দৃষ্টিতে সে মুসলিম হলেও কাজে-কর্মে মুনাফিক।
তার মধ্যে প্রথম খাসলাত হলো আমানতের খিয়ানত করা। খিয়ানতের একটা রূপ তো সবারই জানা। অর্থাত্ অর্থ-সম্পদের খিয়ানত। কেউ নিজের কোনো অর্থ-সম্পদ কারও কাছে আমানত রাখল। তারপর আমানত গ্রহীতা তা যথারীতি মালিককে ফেরত দিতে গড়িমসি করল বা আত্মসাত্ করল। এটা তো খিয়ানতের সুস্পষ্ট ও নিকৃষ্টতম রূপ। এটাকে সবাই পাপ বলে জানে। কিন্তু ইসলামী শিক্ষায় খিয়ানত কেবল এতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং খিয়ানতের আরও বিভিন্ন রূপ আছে। যেমন—কারও গোপন কথা ফাঁস করে দেয়া। অন্যের গোপন কথাও আমানত। শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া তা প্রকাশ করা জায়েজ নয়। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদিসে ইরশাদ করেন—‘মজলিস-বৈঠক আমানতের সঙ্গে সম্পৃক্ত’। (সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং-৪২২৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং- ১৪১৬৬)।
অর্থাত্ কোনো মজলিসে যেসব কথা হয়, মজলিসে উপস্থিত লোকদের জন্য তা আমানতস্বরূপ। বিনা অনুমতিতে তা অন্যদের কাছে প্রকাশ করলে খিয়ানত বলে গণ্য হবে। সুতরাং কোনো মুসলিমের জন্য এটা জায়েজ নয়।
এমনিভাবে কেউ কোথাও চাকরি করলে ডিউটির সময়টা তার কাছে আমানত। কাজেই ডিউটির সেই সময়টা নিজ দায়িত্ব পালনে না লাগিয়ে ব্যক্তিগত কাজে খরচ করলে সে খিয়ানতকারী বলে গণ্য হবে। এভাবে খিয়ানতের অভ্যাস গড়ে তোলা কোনো মুসলিমের কাজ হতে পারে না। এটা কেবল মুনাফিক ব্যক্তিই করতে পারে।
হাদিসে মুনাফিকের দ্বিতীয় আলামত বলা হয়েছে মিথ্যা বলা। কোরআন ও হাদিসের পাতায়-পাতায় রয়েছে মিথ্যাকথনের নিন্দা। ঈমান ও মিথ্যাকথন চরমভাবে পরস্পরবিরোধী। হজরত সাফওয়ান ইবন সুলায়ম (রাযি.) থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করল, কোনো মুসলিম কি ভীরু হতে পারে? তিনি বললেন, হ্যাঁ (মুসলিম ব্যক্তি ভীরু হতে পারে)। জিজ্ঞেস করল, মুসলিম ব্যক্তি কি কৃপণ হতে পারে? তিনি বললেন, হ্যাঁ (মুসলিম ব্যক্তির চরিত্রে কৃপণতাও থাকা সম্ভব)। সবশেষে সে জিজ্ঞেস করল, কোনো মুসলিম কি মিথ্যুক হতে পারে? তিনি বললেন, না। (মুআত্তা মালিক, হাদিস নং-১৫৭১)। (অর্থাত্ ঈমানের সঙ্গে মিথ্যা বলার স্বভাব মিলিত হতে পারে না)।
অনেক সময় মিথ্যা বলার কুফল ব্যক্তির নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, কিন্তু অনেক সময় তার ক্ষতি হয় অনেক বিস্তৃত। পরিবার, খান্দান ও জ্ঞাতি-গোষ্ঠী ছাপিয়ে গোটা সমাজ ও জাতিকেই তা ক্ষতিগ্রস্ত করে। কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতি হলে সে মিথ্যাও কবিরা গোনা বৈ কি! কিন্তু ক্ষতি যদি হয় সামষ্টিক পর্যায়ে, তবে অনেক সময় কেবল একবারের মিথ্যা অনেক মহাপাপের সমষ্টি হয়ে যায়।
মিথ্যা কথা এমনই গুরুতর জিনিস, ইসলাম যাকে হাসি-তামাশাচ্ছলেও অনুমোদন করে না। কাজেই ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিতভাবে যদি মিথ্যা বলে এবং এভাবে অন্যের ক্ষতি করতে চায়, তবে তা কতই না ন্যক্কারজনক হবে! এ কারণেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটাকে মুনাফিকির আলামত বলেছেন।
মুনাফিকির তৃতীয় আলামত বলা হয়েছে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা মুসলিম ও মুমিনের অনন্য বৈশিষ্ট্য। সে একবার কাউকে কোনো প্রতিশ্রুতি দিলে তা রক্ষার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করবে। যত বড় ক্ষতিই হোক না কেন, প্রতিশ্রুতি রক্ষার খাতিরে সে তা মেনে নিতে অকুণ্ঠ থাকবে। ইসলামের ইতিহাস এ জাতীয় ঘটনায় সমাকীর্ণ। এমন ভূরি ভূরি ঘটনা আছে, যাতে এ জাতি নিজ প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ত্যাগ স্বীকারেও পরওয়া করেনি। হজরত মুআবিয়ার (রাযি.) ঘটনা প্রসিদ্ধ যে, তিনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের আশঙ্কায় একবার নিজ দখলে আনা বিস্তৃত এলাকা রোমানদের হাতে ফেরত দিয়েছিলেন। (সুনান তিরমিযি, হাদিস নং-১৫০৬; সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং-২৫৭৮; মুসনাদ আহমাদ, হাদিস নং-১৬৪০।) সভ্যতার ইতিহাসে যা এক অদৃষ্টপূর্ব ঘটনা।
মুনাফিকির চতুর্থ আলামত বলা হয়েছে ঝগড়া-বিবাদে গালাগালি করা। মূলত মুনাফিক ব্যক্তিই অন্যের সঙ্গে কলহ-বিবাদে লিপ্ত হলে মুখ খারাপ করে এবং অবলীলায় অশ্রাব্য গালমন্দ শুরু করে দেয়। যাপিত জীবনে কত রকম মানুষের সঙ্গে মেলামেশা ও লেনদেন ইত্যাদি করতে হয়। তাতে মতের অমিলও দেখা দেয় এবং বহু ক্ষেত্রেই তা কলহ-বিবাদ পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু একজন সাচ্চা মুমিন কোনো অবস্থাতেই মুখ খারাপ করতে পারে না। খিস্তিখেউড় অন্তত তার মুখে শোভা পায় না। সর্বদা সে নিজ ভদ্রতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ব্যাপারে সচেতন থাকবে। এসব তার মহাধন। কোনো অবস্থাতেই সে এ ধন হাতছাড়া করবে না। দৃষ্টিভঙ্গিগত মতভেদ হোক, চিন্তা-চেতনার অমিল হোক, রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক বা খানদানি বিরোধ হোক—কোনো অবস্থাতেই একজন মুসলিম তার মুখ দিয়ে কুবাক্য উচ্চারণ করবে না, করতে পারে না। হাদিসের দৃষ্টিতে এরূপ করাটা মুনাফিকের আলামত। এটা কর্মগত মুনাফিকি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে মুনাফিকির খাসলাতগুলো থেকে বেঁচে থাকা তাওফিক দান করুন, আমিন।

 জাস্টিস আল্লামা তাকী উসমানী
অনুবাদ : মুহাম্মদ তৈয়্যেব হোসাইন

Related Post